ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বালু খেঁকোদের কবলে দিনাজপুরের পুনর্ভবা নদীর ব্রীজ হুমকির মুখে

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ৯ নভেম্বর ২০১৯

বালু খেঁকোদের কবলে দিনাজপুরের পুনর্ভবা নদীর  ব্রীজ হুমকির মুখে

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ দিনাজপুরের পুনর্ভবা নদীতে অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে শহরের বাঙ্গীবেচা ব্রীজ। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ব্রীজের পিলারের কাছে সৃষ্টি হয়েছে ১০ ফুটের মত গভীর গর্ত। ভেঙ্গে যেতে শুরু করেছে ব্রীজের মাটির নিচের পিলারের অংশ। বেরিয়ে এসেছে লোহার রড। গত ৪ বছরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে সৃষ্ট গর্তে পড়ে ৯ জন শিশু, কিশোর ও বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। প্রভাবশালী বালু খেকোদের কারণে এই নদীতে মাছ পর্যন্ত শিকার করতে পারছেন না মৎস্যজীবীরা। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে সর্বনিম্ন এক কিলোমিটারের মধ্যে ড্রেজার মেশিন বা অন্যান্য যন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন করা যাবে না। অথচ দিনাজপুর পুনর্ভবা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ব্রীজের একদম পাশ ঘেষে বালু তোলা হচ্ছে। দিনাজপুর শহরের মাঝাডাঙ্গা এলাকায় বাঙ্গীবেচা ব্রীজের কাছ থেকে ২টি বড় ধরনের ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে ব্রীজটি। সরেজমিনে বাঙ্গীবেচা ব্রীজে গিয়ে দেখা গেছে, ব্রীজে রয়েছে মোট ৬টি পিলার। এর মধ্যে ৪টি পিলারই রয়েছে ঝুকিতে। বালু খেঁকোদের কবলে পড়ে সে সব পিলারের মাটির নিচে থাকা প্রায় ১০ ফিটের মত অংশ বেড়িয়ে পড়েছে। ব্রীজের পিলার নিচে বালু সরে যাওয়ায়, মাটির নিচের পিলারে দেখা দিয়েছে ফাটল। অনেক জায়গায় ভেঙ্গে গিয়ে লোহার রড বেড়িয়ে এসেছে। সম্প্রতি বালু খেকোদের হাত থেকে বাঙ্গীবেচা ব্রীজকে রক্ষা করতে একত্রিত হয়েছেন ব্রীজের উপর দিয়ে চলাচল করা ১৩টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। গঠন করা হয়েছে ব্রীজ রক্ষার জন্য একটি কমিটি। নাম দেয়া হয়েছে ‘সুইহারী-মাঝাডাঙ্গা ব্রীজ রক্ষা কমিটি’। এই কমিটিতে রয়েছে মাঝাডাঙ্গা, নতুনপাড়া, নবীনপাড়া, তেলিপাড়া, খালপাড়া, চকচকা, গোসাইপুর, মালঝাড়, উত্তরপাড়া, পূর্বপাড়া, মোল্লাপাড়া, সর্দারপাড়া ও জুম্মাপাড়া নামে ১৩টি মহল্লার মানুষ। ওই ব্রীজের পাশে গড়ে উঠেছে সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের বসতি দেশের সর্ববৃহৎ মানবপল্লী। নদীর পাশে মানবপল্লীটি অবস্থান হওয়ায় তারাও রয়েছে চরম দুশ্চিন্তায়। বাঙ্গীবেচা ব্রীজ সংলগ্ন গড়ে ওঠা মানবপল্লীর বাসিন্দা তৃতীয় লিঙ্গ সোহাগ জানান, আমাদের ঘর যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। আমরা চরম দুশ্চিন্তায় আছি। জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের প্রচেস্টায় এখানে মানবপল্লী গড়ে উঠেছে। ব্রীজের কাছে অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে, আমাদের বসতির তীরের বালু ধ্বসে পড়ছে। নদীতে একটু বেশি পানি হলেই, আমাদের এই বসতি নদীর গর্ভে বিলিন হয়ে পড়বে। আন্দোলনরত ১৩ গ্রামের বাসিন্দারা জানান, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গর্তে পড়ে গত ৪ বছরে শহরের ৯ জন শিশু, কিশোর ও বয়স্ক ব্যক্তির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বালু উত্তোলনকারীরা এতই শক্তিশালী যে, তারা আমাদের কোন কথাই শোনে না। আমরা প্রতিবাদ করলে তারা আমাদেরকে হুমকি দেয় যে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে ব্রীজ পার হতে দেবে না। দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করতে দেবে না। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর মাঝখানে সৃষ্টি হয়েছে ৪০ থেকে ৬০ ফুটের মত বিশাল আকারের গর্ত। এই গর্তে যে কেউ পড়লে আর উঠতে পারে না। আমরা তাদেরকে অনেকবার নিষেধ করেছি, কিন্তু তারা কর্ণপাত করেনি। ব্রীজ রক্ষা কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম জানান, বাঙ্গীবেচা ব্রীজের কাছে শহরের লালবাগ এলাকার বাসিন্দা জনৈক মোঃ মাহাফুজ দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। মাহাফুজ আলম দিনাজপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার ছত্রছায়ায় এই বালু উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বাঙ্গীবেচা ব্রীজের উপর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ মানুষ যাতায়াত করে। এছাড়াও কয়েক হাজার ছোট বড় যানবাহন চলাচল করে। অথচ বালু খেকোদের কারণে ব্রীজটি আজ হুমকির মুখে পড়েছে। তারা জানান, বালুখেকোরা ১৩টি মহল্লার সকল মসজিদে ৩ লাখ টাকা করে উৎকোচ দিতে চেয়েছিল। তা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। তারা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমাদের আন্দোলনের ফলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। তবে যে কোন সময় তারা আবারও বালু উত্তোলন করতে পারে। প্রশাসনের কাছে আমাদের একটাই দাবী, বাঙ্গীবেচা ব্রীজটি রক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে দিনাজপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ খলিলুর রহমান জানান, অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালুর উত্তোলনের ব্যাপারে ইতিপূর্বে আমরা জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। আমাদের একটি টিম খুব শিঘ্রই বাঙ্গীবেচা ব্রীজের সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে যাবে। তারা আমাকে রিপোর্ট দিলে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
×