ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ওমান-বধে জেমি ডের পরিকল্পনা-রণকৌশল ...

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ৭ নভেম্বর ২০১৯

 ওমান-বধে জেমি ডের পরিকল্পনা-রণকৌশল ...

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল এখন আর আগের মতো অসহায়ভাবে আত্মসমপর্ণ করে না, ম্যাচে হারার আগেই হেরে বসে না। শেষ মুহূর্তে বা সেটপিস থেকে আগের মতো ঘন ঘন গোল হজম করে না। বরং লড়াই করে, প্রতিপক্ষের সমীহ কুড়িয়ে নেয়, আক্রমণাত্নক খেলা উপহার দেয় এবং মাঝে মাঝে জেতেও! আর এটা সম্ভব হয়েছে একজনের কারণে। তিনি দলের কোচ জেমি ডে। জেমির সবচেয়ে গুণ-তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম কোচ, যিনি বাংলাদেশকে দুটি অর্জন এনে দিয়েছেন। একটি হলো এশিয়ান গেমসের দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া, আরেকটি হচ্ছে এএফসি অ-২৩ বাছাইপর্বে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে জয়ী করানো। এই ইংলিশ কোচের দর্শনে পাল্টে গেছে খেলার ধরণ, পরিবর্তন এসেছে মানসিকতায়। ভেবে-চিন্তে তাই জেমিকেই লম্বা সময়ের জন্য রেখে দিতে চায় বাফুফে। গত জুনের পর তার সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করে ফেলে বাফুফে। আগের ৯টি বাছাইপর্বে অংশ নিয়ে প্রতিবারই প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নিতে হয়েছিল বাংলাদেশ। এবার বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রাউন্ডে নেয়ার সেই দায়িত্ব-চ্যালেঞ্জ এখন জেমির কাঁধে। ফিফা বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের (‘ই’ গ্রুপ) এ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশ দল এখন অবস্থান করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে। সেখানে আগামী ১৪ নভেম্বর সিব শহরের আল-সিব স্টেডিয়ামে স্বাগতিক ওমানের মুখোমুখি হবে লাল-সবুজ বাহিনী। ওমান-বধে নানা পরিকল্পনা-রণকৌশল আঁটছেন তিনি। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দ্বিতীয় পর্বে বাংলাদেশ খেলছে গ্রুপ ‘ই’তে। গ্রুপের অন্য চার দল হলো কাতার, ওমান, আফগানিস্তান ও ভারত। ৫ দলের মধ্যে রাংকিংয়ে সব থেকে পিছিয়ে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে তারা আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে যায়। ১০ সেপ্টেম্বর তাজিকিস্তানে (নিরপেক্ষ ভেন্যু) অনুষ্ঠিত হয় ম্যাচটি। এরপর ১০ অক্টোবর ঢাকায় বিশ্বকাপের স্বাগতিক দল কাতারের বিপক্ষে কঠিন লড়াই করে ২-০ গোলে হেরে যায় তারা। ১৫ অক্টোবর ভারতের বিপক্ষে এ্যাওয়ে ম্যাচে জামাল ভুঁইয়াদের পারফরম্যান্সটা ছিল আরও চোখ ধাঁধানো। কোলকাতায় অনুষ্ঠিত ম্যাচে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র করে বাংলাদেশ। ৯ নভেম্বর ওমান ম্যাচের আগে সেখানে স্থানীয় একটি দলের সঙ্গে একটা প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার কথা রয়েছে বাংলাদেশ দলের। রাংকিংয়ে বাংলাদেশের (১৮৪) চেয়ে ১০০ ধাপ এগিয়ে ওমান (৮৪)। এই দলের বিপক্ষে লড়াই করার দৃঢ় মানসিকতা খেলোয়াড়দের। গ্রুপে ৫ দলের মধ্যে ৬ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে ওমান। সমান ম্যাচে ১ পয়েন্ট নিয়ে তলানিতে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপও এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে নিজেদের চতুর্থ ম্যাচকে সামনে রেখে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে দশদিন আগেই ওমান গেছে বাংলাদেশ দল। একদিন বিলম্বে (বিমানের যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে) গিয়ে পৌঁছালেও পুরো দমে দল অনুশলিন শুরু করে দিয়েছে জেমির অধীনে। শিষ্যদের ফিটনেস আগের মতোই ঠিকঠাক আছে সন্তুষ্ট জেমি। ভালো নাম জেমস ডে। সংক্ষেপে জেমি ডে। জন্ম লন্ডনের ব্রেক্সলিতে। খেলোয়াড়ী জীবনে খেলেছেন আর্সেনাল, বর্নমাউথের মতো নামকরা ফুটবল ক্লাবে। ইংল্যান্ডের অ-১৬, ১৭ ও ১৮ দলেও খেলেছেন। তবে চোটের কারণে ক্যারিয়ারের অকাল পরিসমাপ্তি ঘটে। তখন তার অভিলাষ হয় কোচ হবার। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের বিভিন্ন স্তরের ক্লাবকে কোচিং করানোর পর ২০১৮ সালে কোন দেশের জাতীয় দলের দায়িত্ব নেন। দেশটির নাম বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের অক্টোবরে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে ভুটানের কাছে ১-৩ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। এর ফলে পরের ১৮ মাস এএফসির অধীনে কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা থেকে বঞ্চিত হয় লাল-সবুজ বাহিনী। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের শুরু পর্যন্ত মোট ১৫টি ম্যাচ খেলা বাংলাদেশ জিতেছিল মাত্র ১টি ম্যাচে। ৩টি ম্যাচ ড্র। বাকি ১১টি ম্যাচেই হার! যার মধ্যে আছে জর্দানের কাছে ৮ গোল বা অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৫ গোলের বিশাল ব্যবধানে হার। সেই বাংলাদেশ দলই চলতি বছর ৮টি ম্যাচ খেলে। জয় পেয়েছে ৪টিতেই!। দুটি ম্যাচ ড্র করেছে জামাল ভুঁইয়ারা। যে দুটি ম্যাচে হেরেছে, সেখানেও প্রতিপক্ষকে সহজে জিততে দেয়নি দ্য বেঙ্গল টাইগাররা। লাওসের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলার মাধ্যমে আবারও আন্তর্জাতিক ফুটবলে পা রাখে বাংলাদেশ। কোচ এ্যান্ড্রু অর্ডের অধীনে সে ম্যাচে দুর্দান্ত খেলে ২-২ গোলে ড্র করে বাংলাদেশ। এরপর অর্ড দায়িত্ব ছেড়ে দিলে দৃশ্যপর্টে আবিভর্‚ত হন জেমি ডে, সেটা ২০১৮ সালের মে মাসে। জেমির প্রথম মিশন ছিল নীলফামারীতে। প্রীতি ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ওই ম্যাচে ভালো খেলেও হেরে যায় বাংলাদেশ (০-১)। জেমির শুরুটা হয় হার দিয়ে। ফলে দেশের ফুটবলামোদীরা ধরেই নেন কোচ হিসেবে অতি সাধারণ মানের হবেন তিনি। কিন্তু না, তাদের ধারণা ছিল পুরোপুরি ভুল। কেননা জেমি দেখাতে শুরু করেন ম্যাজিক। ধীরে ধীরে দেশের মরা ফুটবলে তিনি সঞ্চার করেন প্রাণের। তরুণ খেলোয়াড়দের প্রাধান্য দেয়া, ফিটনেসের অভাবনীয় উন্নতি, রাতারাতি খাদ্যাভাস পরিবর্তন, শৃক্সখলার প্রতি জোর দেয়া ... এসব দিয়েই জেমি নজর কাড়তে থাকেন। ফলাফল? এই ব্রিটিশ কোচের অধীনেই দ্বিতীয় সর্বাধিক ম্যাচে জিতেছে বাংলাদেশ। অ-২৩ জাতীয় দল খেলেছে ৭ ম্যাচ। ২ জয়, ১ হার ও ৪ ড্র। সিনিয়র জাতীয় দল খেলেছে ৮ ম্যাচ। জিতেছে ৪টিতেই। হেরেছেও সমসংখ্যক ম্যাচে। এর আগে বাংলাদেশ দল সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ জিতেছিল আর্জেন্টাইন কোচ দিয়েগো আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানির অধীনে, ৬ ম্যাচে (২০০৫-২০০৭)। ক্রুসিয়ানির রেকর্ড ভাঙ্গার অপেক্ষায় আছেন জেমি। মাঠের সাথে মাঠের বাইরেও উন্নতি এনেছেন জেমি। ড্রেসিং রুমের শৃংখলা ফিরিয়ে এনে দলে এনেছেন ভারসাম্য। জয় পাওয়ার মানসিকতা সৃষ্টির দলকে শিখিয়েছেন লড়াই করতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। জেমির হাত ধরেই দেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয়। ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক কাতারকে এশিয়ান হেমসে ১-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। ১৯৯৩ সালের ফিফা রাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৬ নম্বরে। যেটা ১৯৯৬ সালে ১১০-এ উঠে আসে। কিন্তু এরপরই শুরু হয় অবনমন। ২০০০ সাল নাগাদ ১৫১-তে অবস্থান নেয় বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ছিল ১৭৪তম স্থানে। কিন্তু নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে নিচে নেমে আসে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে। তখন রাংকিং দাঁড়ায় ১৯৭। সেখান থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৮৪। ওমানকে হারাতে পারলে যে রাংকিংয়ের আরও উন্নতি ঘটবে, সেটা কি আর নতুন করে বলার দরকার আছে?
×