পূর্ব প্রকাশের পর
নেটে সার্চ করে দেখেছে, ইউরোপে বিদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি টুরিস্ট আসার ক্ষেত্রে প্যারিসের পরেই আছে ক্র্যাকাও।
ওয়ারসোতে গত দুদিন হোটেলে ফিরতে রাত হয়ে যাওয়ায় আজকের মত সন্ধ্যার আড্ডা বসেনি। হর্স চেষ্টনাট গাছের নিচেই রেস্তোরাঁটি, হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে না। আড্ডার অনুষঙ্গ হিসেবে পরাগের অর্ডার ছিল ওয়ারসোর বিখ্যাত পানীয় স্থানীয় ভোদকা কিন্তু সমীর কিনে এনেছে পর্তুগালের ‘স্পেশাল পোর্ট ওয়াইন’। ওয়াইন দেখে পরাগ বলে -শেষ পর্যন্ত শরবত খাওইয়াবা দোস্ত?
গ্লাসে ঢালতে ঢালতে সমীর হাসে,
- এইটা ওয়াইন হইলেও সেভেনটিন পার্সেন্ট অ্যালকোহল আছে, সোহেল খাইবা নাকি দু’এক পেগ?
সোহেল না-সূচক মাথা নাড়ে, বোতলের লেভেল পড়তে পড়তে পরাগ বলে-
- অন্য ওয়াইনে কত পার্সেন্ট থাকে?
- বার পার্সেন্টের বেশি না। অরিন্দম? বস্ইবা নাকি একটা দুইটা?
অরিন্দম মৃদু হেসে বলে-
- না দাদা।
- কেন মন খারাপ? তখন থিকা দেখতাছি চুপচাপ?
- দাদা, আমি কালকে রাতে শিন্ডলার্স লিস্ট সিনোমাটা দেখলাম, সোহেল ভাইয়ের ল্যাপটপে।
- ছবি দেইখা মন খারাপ?
- মন খারাপ না দাদা ছবিতা দেখে অনেক চিন্তা আসলো মনে, সেগুলাই মনে মনে ভাবতেছি।
- শিন্ডলারের কারখানাটাও কিন্তু ক্রাকাওতে।
- আমি শুনেছি দাদা, পরাগ ভাইয়ের কাছে।
সমীর ওয়াইনসহ গ্লাস পরাগকে দিয়ে, আরেকটি গ্লাসে ঢালতে ঢালতে অরিন্দমের দিকে তাকায়-
- তুমি দো-চোয়ানি খাও?
- কখনও খাই নাই দাদা।
পরাগ ওর পিঠে হাত রেখে বলে
- গুড বয় ...!
সমীর নিজের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলে
- তাইলে তো এই মালও খাইবা না ...
গরম গরম তুর্কিদের রেস্তোরাঁর ‘ল্যাম্ব’ (ভাজা ভেড়ার মাংস) আর রেড ওয়াইন সেবন করতে করতে আড্ডা জমে ওঠে। পরাগের মুড চলে আসতে সময় লাগে না, গুনগুন করতে করতে সমীরের কাঁধে হাত রাখে-
- দোস্ত, ঐদিন কইছিলা, যুদ্ধের পরে ইহুদীরা কেন পোল্যান্ড ছাড়লো তার উত্তর নাকি শিন্ডলার্স লিস্ট সিনোমাতে আছে?
সমীর মগ্নভাবে জবাব দেয়-
- ঠিক উত্তর না, তবে উত্তরের ক্লু আছে।
সোহেলও কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়, মুখ থেকে পেপসির ক্যান নামিয়ে রাখে-
- কিসের ক্লু দাদা? কালকে রাতে দ্বিতীয়বার শিন্ডলার্স লিস্ট দেখলাম।
- যুদ্ধ শেষ হবার পর যে রাতে শিন্ডলার মিয়া বিদায় নিয়া চইলা গেল তার পরের দিন সকালে একটা রাশিয়ান সৈন্য আসে মনে আছে?
সোহেল হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ে-
- ঘোড়ায় চড়ে?
- অ্যাবসোলিউটলি রাইট, লোকটা কি বলছিল মনে আছে?
-কোন কথাটা?
- ইহুদী একটা লোক যখন রাশান সৈন্যরে জিগাইলো- হোয়ার শুড উই গো?..আমরা কই যামু..
রাশানটা কোন চিন্তা না কইরাই কইল- ‘পূর্ব দিকে যাইয়ো না, আমি নিশ্চিত...ওই দিকের মানুষ তোমাগো ঘিন্না করে’ এর পরে একটু থাইমা কইলো, ‘আমি হইলে পশ্চিমেও যাইতাম না।’
পরাগের হো হো করা হাসিতে আসে পাশের টেবিলের লোকজন ফিরে তাকায়, সমীর চাপা স্বরে বলে
- আস্তে হাস, এত মজা পাইলি কিসে?
- পূর্বেও জায়গা নাই, পশ্চিমেও জায়গা নাই তাইলে শালা যাইবো কই?
- কথাটা ঠিকই, ২ নম্বর বিশ্ব যুদ্ধের পরে নতুন কইরা এই প্রশ্ন ইউরোপের ইহুদীগো সামনে আইছে।
- দুই হাজার বছর খ্রিস্টানগো সঙ্গে থাইকাও ওগো মন পাইলো না (পরাগের কণ্ঠে আফসোস)...
- ‘এখন তো খ্রিস্টানরাই ওদের বড় বন্ধু’ আপত্তির সুরে বলে ওঠে সোহেল ...‘দুই গ্রুপ মিলে মুসলমানদের মারছে’
পোর্ট ওয়াইনে জম্পেস চুমুক দিয়ে সমীর বলে-
- এখনকার অবস্থা দিয়া তখনকার অবস্থা বুঝবা না, দুই হাজার বছর ইউরোপে থাকার পর হলকাস্টের মতো ঘটনা, শুধু ধর্মের কারণে বিনা অপরাধে লাখ লাখ মানুষরে নৃশংসভাবে মারছে।
সমীরের কথায় নড়েচড়ে বসে পরাগ।
- কথা ঠিক, দুই হাজার বছর ধইরাই ওরা খ্রিস্টানগো লাত্থিগুতা খাইছে, ঘেটোতে থাকতে হইছে, পোগ্রম (Pogrom) হইছে, জেনোসাইড হইছে, দেশ থিকা বাইর কইরা দিছে...হলোকাস্টের সময় তো কথাই নাই...
পরাগের মুখের উপর সোহেল বলে ওঠে-
- হলকাস্টে বাকি শয়তানগুলাকে মেরে ফেললে, ভাল হতো...
- এইডা কি কইলা ছোট ভাই, মুসলমানগো এই এক সমস্যা... নিজেরটা ছাড়া কিছু বোঝে না...
পরাগের কথায় বিরক্তির ছায়া পড়ে সোহেলের মুখে
- আপনিওতো মুসলমানের ছেলে...
এতক্ষণ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ওদের কথা শুনছিল সমীর। সোহেলকে চটতে দেখে বলে ওঠে-
- বিষয়টা শুধু মুসলমানের না বুঝছ সোহেল, সবাই নিজের সম্প্রদায়ের স্বার্থটাই দেখে, অন্যেরটা দেখে না... প্যালেস্টাইনে মুসলমান বেশি, অল্প কিছু খ্রিস্টানও আছে, বেশির ভাগ খ্রিস্টান হইলে দেখতা পশ্চিমা দেশের ওরাও ইসরাইলরে গাইলাইতাছে।
সোহেল এখনও গম্ভীর হয়ে আছে, ওর কাঁধে হাত রাখে পরাগ-
- ছোট ভাই, মাইন্ড কইর না আমি খালি মুসলমানের দোষ ধরতাছি না, আমার দোস্ত ঠিকই কইছে আমরা সবাই নিজের জাতিরেই বেশি ফেভার করি।
সমীর হালকা দীর্ঘশ্বাস আর মৃদু হাসি দিয়ে সোহেলের দিকে তাকায়-
- নিজের উপর না পড়লে কিছুই বোঝা যায় না
পরাগ আবার জোরে হেসে ওঠে-
- বুঝছো সোহেল, এতক্ষণে বুঝলাম, ইহুদীগো প্রশ্নের গুরুত্বটা আমার দোস্তে বুঝল, সিনামাটা দুইবার দেইখাও আমি কেন বুঝলাম না।
সোহেল কৌতূহলী চোখে পরাগের দিকে তাকায়
- কোন প্রশ্নটার কথা বলছেন?
- ওইযে ইহুদী বেটা কইল, ‘আমরা এখন কোথায় যামু?’ এই প্রশ্নটা আমার দোস্তেই ভাল খেয়াল করছে, আমরা করলাম না...
সমীর আর অরিন্দমও পরাগের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকায়-
... কারণ সে হিন্দুর পোলা... প্রশ্নটা মাঝে মাঝে তাগো মনের মধ্যেও আসে... কি অরিন্দম তোমাগো মনেও আসে নাই কখনও?
সমীর মৃদু হেসে তার প্রিয় বন্ধুটির দিকে তাকায়, অনেক বিষয়েই ও স্পষ্ট ও নৈর্ব্যক্তিক চিন্তা করতে পারে, এখন এ্যালকোহলের নেশায় সত্য কথাগুলো ওর মুখ দিয়ে আরো ধারালো হয়ে বের হচ্ছে। অরিন্দম কিছুটা চমকে ওঠে, গত রাতে দেখা সিনেমায় ঐ দৃশ্যটি কল্পনা করতে থাকে। সমীরদা ধরিয়ে না দিলে এই দৃশ্যটি ওকে বিশেষভাবে ভাবাতো না।
সোহেল একটু নড়ে চড়ে বসে-
- আমাদের দেশের হিন্দুদের মনে তো কোথায় যাবে এই প্রশ্ন নেই, তাদের তো যাওয়ার নির্দিষ্ট জায়গা আছে, ‘পুণ্যভূমি’... সোহেলের কণ্ঠে ব্যঙ্গ ঝড়ে পড়ে...
সমীর মৃদু হাসে, সমীর জানে পরাগই সোহেলের কথার জবাব দেবে। মুখ থেকে গ্লাস নামিয়ে কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল পরাগ, তার আগেই অপ্রত্যাশিত অরিন্দমের গলা শোনা যায়...
- সোহেলদা, মানুষ কম দুঃখে নিজের দেশ বাপ-দাদার ভিটা ছাড়ে না, নতুন জায়গায় জ্ঞাতিগোষ্ঠী থাকলেও নতুন করে বসবাস করা অনেক কঠিন... যারা গেছে তাদের কাছ থেকে আমরা শুনছি... আমার বাবা বলেছিল বিভুয়ে থাকার মত কষ্টের কিছু নাই... হয়ত মরণের চেয়ে কিছুটা ভাল...
- সাবাস পাহাড়ী ঘোড়সওয়ার (পরাগের কণ্ঠে নেশার ইউফোরিয়া)... লা জওয়াব... সোহেল বুজছো... বুঝবানা এখন পুরাপুরি... নিজের উপরে পড়লে সবাই বুঝে...
ওয়ারসোর শেষ রাতের আড্ডা ইহুদী থেকে শুরু হয়ে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাহীন মানুষের নানা সমীকরণের দিকে এগোতে থাকে। ওদের কথোপকথনে উঠে অসতে থাকে কাছের এবং দূরের নানা জাতি গোষ্ঠীর বঞ্চনা আর নিপীড়নের বৃত্তান্ত। নিজেদের অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ আরও জীবন্ত করে তোলে ওদের এই আদান প্রদান। স্বার্থ আর অহমের দৌরাত্ম্য যেমন ব্যক্তিকে পীড়িত করে, তেমনি গোষ্ঠীর জীবনকেও বিষিয়ে তোলে অস্তিত্বের নানা সংকটে। এই উপলব্ধি যখন ওদের ওপর ভর করছিল তখন বৃষ্টি নেমেছে, ঠা-া কাঁপুনি জগানো বাতাস ছুটেছে, বৃষ্টির ছাট আর হর্সচেষ্টনাট গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়া জলের শব্দের আবহে অনন্য এই রাত ওদের ভাসিয়ে নিতে থাকে দূর-দূরান্তরে।
নিপীড়িত পাহাড়ী গোষ্ঠীর সন্তান অরিন্দম আত্মীয়তা বোধ করতে থাকে আবহমান কালের অবিচার-জর্জরিত জানা অজানা সব মানব-গোষ্ঠীর সঙ্গে।
(৪)
ট্রেনে ওয়ারসো থেকে সকালে রওনা দিয়েও এখানে হোটেলে পৌঁছাতে ওদের প্রায় দুপুর হয়ে গেল। ক্র্যাকাও, পুরনো এক শহর। অনেক প্রাচীন নিদর্শন আছে এখানে কিন্তু এ শহরকে বিখ্যাত করেছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি। জার্মানদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধকালীন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প অস্উইচ আর বার্কিনাও এ শহর থেকে অল্প কিছু দূরে। এখন এগুলোই দর্শনীয় স্থান, যা দেখতে সারা পৃথিবী থেকে পর্যটক আসে। ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন শিন্ডলারের যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারখানা এখন ক্র্যাকাওয়ের ২য় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর। এটাও ক্র্যাকাওয়ের অন্যতম আকর্ষণ।
একটা পুরানো বিল্ডিংএ ওদের হোটেল, বড় বড় জানালা। হোটেলের লবিতে পরাগ অরিন্দমের পিঠে হাত রেখে বলে- ‘বুঝছো ঘোড়সওয়ার, এইখানেই শিন্ডলারের ওই কারখানা’ অরিন্দম মৃদু হাসে। স্পিলবার্গের অসাধারণ সিনেমা শিন্ডলার্স লিস্ট সবারই দেখা। ক্র্যাকাও তাই অন্যরকম আগ্রহ জাগায় ওদের মনে। সিনেমাতে অস্উইচ ও বার্কিনাও ক্যাম্পের ঘটনাও আছে। আসার সময়ে ট্রেনেও শিন্ডলারের কথা ভাবছিল অরিন্দম। পাশের সিটে সমীরদাকে দেখলো উইকিপিডিয়ায় অস্কার শিন্ডলারের পাতাটা দেখছে। নিজের মোবাইলে ও শিন্ডলারের ‘বায়োগ্রাফি’ দেখতে থাকে।
সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সাল, বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই পোল্যান্ডের বেশিরভাগ দখলে নিয়েছে জার্মানরা। এর কিছুদিনের মধ্যেই ক্র্যাাকাওয়ে আসেন জার্মান নাগরিক অস্কার শিন্ডলার। তিনি তখন জার্মানির একজন উঠতি ব্যবসায়ী, বুদ্ধিমান, সুযোগসন্ধানী, ধান্ধাবাজ বললেও ভুল হবে না। একাধারে হিটলারের দল ক্ষমতাসীন নাজি পার্টির সদস্য এবং জার্মান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট। রাজনীতি শিন্ডলারের ঢাল, আসল উদ্দেশ্য ব্যবসা। (চলবে)
শীর্ষ সংবাদ: