ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফ্রয়েড এবং ‘আন্না ও’ কাহিনী

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৮ নভেম্বর ২০১৯

 ফ্রয়েড এবং ‘আন্না ও’ কাহিনী

‘আন্না ও’ এর কেস-হিস্ট্রিটিকে মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির সূচনাবিন্দু হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং তার জ্যেষ্ঠ সহযোগী যোসেফ ব্রয়ারের যৌথ গবেষণাকর্ম ‘Stadies on Hysteria’ (১৮৯৫) গ্রন্থের সবচেয়ে বিস্তারিত কেস-হিস্ট্রি এটি। ‘আন্না ও’ হচ্ছে কেস-হিস্ট্রির ছদ্মনাম। তার আসল নাম বার্থা পাপেনহেইম (১৮৫৯-১৯৩৬)। ভিয়েনার রক্ষণশীল ইহুদী পরিবারে তার জন্ম। তার বাবা ছিলেন সচ্ছল ব্যবসায়ী। ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি স্কুলে যেতে পেরেছেন। তারপর বাড়িতে সূচীকর্ম শেখেন এবং মাকে গৃহকর্মে সাহায্য করেন। ১৮৮০ সালে বার্থার পিতা অসুস্থ হয়ে পড়লে বার্থা তার শুশ্রƒষার দায়িত্ব নেন এবং নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার বাবা পরের বছর মারা যান। এতে তার অসুখের প্রকোপ আরও বাড়ে। তাকে চিকিৎসার জন্য ভিয়েনার নামকরা চিকিৎসক যোসেফ ব্রয়ারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তার রোগের লক্ষণ বহুবিধ, এবং একটির উপশম হলে অন্যটি দেখা দিত। তীব্র কাশি, মুখম-লের ব্যথা, শরীরের ডানপাশের অবশতা, দৃষ্টি ও শ্রবণের সমস্যা, কথা আটকে যাওয়া, গায়েবী আওয়াজ শোনা, কখনও বা বেঁহুশ হয়ে যাওয়া, এ সকলই ছিল তার অসুখের প্রকাশ। ব্রয়ার রোগটিকে ‘হিস্টেরিয়া’ বলে শনাক্ত করেন এবং সম্মোহন প্রক্রিয়ায় তার চিকিৎসা শুরু করেন। এ প্রক্রিয়ায় রোগীকে সম্মোহিত করে তার মনের কষ্ট ও দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে বলতে উৎসাহিত করা হয়। রোগী সম্মোহিত থাকার জন্যে, মনের বাধা কাজ করে না। এ অবস্থায় বেদনাদায়ক কিংবা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য স্মৃতি ও চিন্তাকেও বর্ণনা করা তার জন্য সহজ হয়। ব্রয়ার লক্ষ্য করেন, এতে রোগীর রোগ লক্ষণের উপশম হয়। তবে সমস্যা হলো আন্নার ক্ষেত্রে রোগ লক্ষণগুলো ফিরে ফিরে আসছিল, পুরো নিরাময় হচ্ছিল না। আন্না নিজেই লক্ষ্য করেন, তিনি সম্মোহন ছাড়াও নির্বাধভাবে তার স্মৃতি বর্ণনা করতে পারেন। আন্না ব্রয়ারকে এ কথা জানালে, ব্রয়ার তাকে সম্মোহিত না করেই অবাধে কথা বলার সুযোগ দেন। ফলাফল সম্মোহনের মতোই। এই প্রক্রিয়াটি সম্মোহনের বিপরীতে আবাধ-অনুসঙ্গ (free association) নামে খ্যাত। ফ্রয়েড সে-সময় ব্রয়ারের সঙ্গে কাজ করছিলেন। পরে তিনি এই পদ্ধতিটিকে বিকশিত করেন এবং মনঃসমীক্ষণের মূল পদ্ধতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। ‘আন্না ও’ এবং আরও কিছুসংখ্যক রোগীর কেস-হিস্ট্রি বিশ্লেষণ করে ব্রয়ার ও ফ্রয়েড সিদ্ধান্তে আসেন, মনের অচেতন দ্বন্দ্ব থেকেই হিস্টেরিয়ার রোগ লক্ষণের উৎপত্তি। সম্মোহন বা অবাধ-অনুষঙ্গের মাধ্যমে যদি রোগী তার মনের দ্বন্দ্বটিকে উগরে দিতে পারেন এবং দ্বন্দ্বটি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেন, তাহলে রোগ লক্ষণের উপশম হয়। ব্রয়ার আন্নাকে নিয়ে দুই বছর লেগেছিলেন এবং থেরাপিতে মোট ১,০০০ ঘণ্টা সময় ব্যয়িত হয়েছিল। কেস-হিস্ট্রিতে দাবি করা হয়, আন্না রোগ মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। আন্নার রোগ লক্ষণগুলো পরিবর্তিত হচ্ছিল কিংবা যাওয়া আসা করছিল। রোগ বৃদ্ধি পেলে ব্রয়ার তাকে ক্রেউজ্লিঙ্গেল-এ অবস্থিত বেলভিউ ক্লিনিকে রেফার করেন। তার পর তিনি আর আন্নার চিকিৎসা করেননি। বার্থা (আন্না) বেলভিউতে চিকিৎসাধীন থাকার সময় কার্লশ্রুতে তার কাজিনদের কাছে বেড়াতে যান। তার এক কাজিন (দিদি) সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনি বার্থাকে এসব কাজে উৎসাহিত করেন। বার্থা সেখানে কিছুদিন নার্সিং-এও প্রশিক্ষণ নেন। কিছুটা আরোগ্য হলে তিনি ক্লিনিক ছেড়ে ভিয়েনা চলে আসেন। সেখানে তিনি কয়েক বছর মায়ের সঙ্গেই ছিলেন। তিনি পুরো আরোগ্য লাভ করেননি। বার্থার পরিবার ১৮৮৮ সালে ভিয়েনা ছেড়ে মেইন তীরস্থ ফ্রাঙ্কফোর্ট নগরে চলে আসেন। এখানে তাদের রক্ষণশীল এবং উদার, দুই ধরনের ইহুদীদের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পরিবারটি সেখানকার বিজ্ঞান চর্চা, সংস্কৃতি চর্চা, সমাজসেবা প্রভৃতি কার্যক্রমে জড়িত হয়ে পড়ে। বার্থা নিজেও সাহিত্য রচনা শুরু করেন এবং সমাজসেবায় নিয়োজিত হন। অনাথ ইহুদী বালিকা ও নারীরাই ছিল তার কাজের ক্ষেত্র। সমাজসেবামূলক কাজের পাশাপাশি তিনি নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও শরিক হন। তিনি ‘International Council of Women’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নারী পাচারের রিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রথম জার্মান সম্মেলন (১৯০২) থেকে দায়িত্ব পেয়ে, নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত সামাজিক কারণগুলো চিহ্নিত করতে, তিনি নারী পাচারের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল গেলাসিয়াতে সরেজমিন তদন্তে যান। তারপর নারী পাচার ও পতিতাবৃত্তি রোধের জন্য কলম ধরেন এবং আন্দোলন সংগঠিত করেন। জার্মানিতে ‘ইহুদী নারী সমিতি’র তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সামাজিক কর্মের সঙ্গে বার্থার সাহিত্য-সাধনাও এগিয়ে চলে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ রচনার পাশাপাশি তিনি অনুবাদ কর্মেও হাত লাগান। তিনি নারী অধিকার আন্দোলনের শুরুর দিকের গুরুত্বপূর্ণ রচনা Mary Wollstonecraft Gi A Vindication of the Right of Women (1790) গ্রন্থটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। ইহুদী সমাজে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক যেসব প্রথা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তিনি এসবের বিরোধিতা করে, ইহুদী সমাজে নারীদের সমানাধিকার দাবি করেন। এতে রক্ষণশীল ইহুদীরা তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয় এবং তার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে। অনাথ ইহুদী বালিকা ও কুমারী মাতাদের জন্য তিনি ‘নিউ-ইসেনবুর্গ’ নামে একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল আশ্রিতদেরকে শিক্ষা দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলা। রক্ষণশীল ইহুদীরা এরও বিরোধিতা করেছিল। তারদের ধারণা, এতে সমাজের পাপকর্মকেই উৎসাহিত করা হয়। সেময় ইউরোপের ইহুদীদের মধ্যে জায়নবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তিনি এটি সমর্থন করতেন না। ইহুদীরা যে দেশ ও সমাজে বেড়ে উঠেছে, সেই সমাজের মধ্যেই আত্মীকৃত হওয়ার পক্ষে ছিলেন তিনি। জায়নবাদীরা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, প্যালেস্টাইনকে তাদের পিতৃপুরুষের দেশ আখ্যা দিয়ে, সেখানে ইউরোপ থেকে ইহুদীদের অভিবাসনকে উৎসাহিত করত। বার্থার বিরোধিতা করতেন। অবশ্য নাৎসীদের ইহুদীবিরোধিতা তীব্র হয়ে উঠলে তিনি তার অবস্থান পাল্টান। নাৎসী উত্থানের সময়টাতে ১৯৩৬ সালেই তার মৃত্যু হয়। ১৯৩৮ সালে নাৎসীরা তার অনাথ আশ্রম ‘নিউ ইসেনবুর্গ’ আক্রমণ করে, এবং ১৯৪২ সালে আশ্রমের সবাইকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। বার্থা বিবাহ করেননি। ১৯০৫ সালে তার মায়ের মৃত্যুর পর তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তার এই বেদনা ১৯১১ সালে রচিত তার একটি কবিতায় ধরা পড়েছে। Love did not come to me - So I vegetate like a plant, In a cellar, without light. Love did not come to me - So I resound like a violin, Whose bwo has been broken. Love did not come to me - So I immerse myself in work, Living myself sore from duty. Love did not come to me - So I gladly think of death, As a friendly face. ১৯৫৪ সালে জার্মান পোস্টাল বিভাগ তাদের ‘মানবহিতৈষী’ সিরিজের ডাকটিকেটের একটি, মার্থার প্রতিকৃতিসহ প্রকাশ করে, তার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তার মৃত্যুর ৫০তম বার্ষিকীতে জার্মানিতে সেমিনারের মাধ্যমে তার কর্মকান্ডকে স্মরণ করা হয়। ১৯৯৭ সালে তার প্রতিষ্ঠিত ‘নিউ ইসেনবার্গ’ অনাথ আশ্রমটিতে তার নামে সেমিনার রুম ও স্মারক চিহ্ন উদ্বোধন করা হয়। বার্থা তার অনাথ আশ্রমের বাসিন্দাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থাও রেখেছিলেন। তিনি সেখানে চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে মনঃসমীক্ষণ প্রয়োগের অনুমতি দিতেন না। তিনি তার নিজের মনঃসমীক্ষিত হওয়া নিয়ে কোন গল্পও করতেন না। তার মতে, ‘একজন ক্যাথলিক যাজকের হাতে কনফেশন যা, একজন ডাক্তারের হাতে মনঃসমীক্ষণও তাই। এটি একটি ভাল যন্ত্র হয়ে উঠবে না দু’ধারি তোলায়ার হয়ে উঠবে তা নির্ভর করে, কে এটি ব্যবহার করছেন এবং কী চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে তার উপর।’ ‘আন্না ও’ কাহিনীটি যেমন মনঃসমীক্ষণ সূচনার কাহিনী, তেমনি-এর সীমাবদ্ধতার কাহিনীও। মনঃসমীক্ষণ যে সমস্যাটির সমাধান করতে পারেনি, সেটি সমাধান করেছিল সমাজমুখী আদর্শ এবং সে অনুযায়ী কাজ। মনঃসমীক্ষণ রোগীর অচেতনের ও অতীতের ঘাঁটাঘাঁটিতে নিয়োজিত থাকায়, বর্তমান জীবন ও সমাজ এবং এতে ব্যক্তির ভূমিকাটি ভুলে যায়।
×