ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মিহির কুমার রায়

লোকজ সংস্কৃতির বাহক যাত্রাপালা

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৭ নভেম্বর ২০১৯

 লোকজ সংস্কৃতির বাহক যাত্রাপালা

(পূর্ব প্রকাশের পর) বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে বাঙালীর এককালের বিনোদনের প্রধান অনুুষঙ্গী যাত্রাপালা। আকাশ সংস্কৃতির প্রভার, হাতের কাছে বিনোদনের সহজলভ্যতা, অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আর্বতে পড়ে বাঙালীর লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্য আজ সঙ্কটাপন্ন। এদিকে নেত্রকোনার যাত্রাশিল্পী গৌরঙ্গ আদিত্য আমাকে জানালেন খুবই করুণ অবস্থা দিন কাটাতে হচ্ছে গানের টিউশনি করে। অথচ এককালে বিবেকের অভিনয় করে সুরেলা কণ্ঠে আসর মাতাতেন সেই গৌরাঙ্গ। এক সময় দেখা যেত যাত্রার ওপর বাংলাদেশ টেলিভিশনএ এক সপ্তাহে না হলেও মাসে দু-এক বার অনুষ্ঠান হতো কিন্তু এখন আর হয় না। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে রমনা বটমূলে সংলগ্ন মাঠে যাত্রাপালার আয়োজন করা হতো। কিন্তু এখন আর দেখা যায় না। যারা পালাকার ছিল তারা আর নেই, যারা নৃত্যের মাস্টার ছিল তারা পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছে, যারা বাদ্যযন্ত্রী ছিল তারা মারা যাওয়ায় তাদের প্রজন্ম এ পেশায় আসতে ইচ্ছুক নয়। এমতাবস্থায় এই পেশাগুলোকে যদি আকর্ষণীয় না করা যায় তবে শিল্প হিসেবে এর বিকাশ কোনভাবেই সম্ভব হয়ে উঠবে না এই অপসংস্কৃতির যুগে এখন প্রয়োজন দেশীয় লোকজ সংস্কৃতি রক্ষায় সকলের ঐকমত্য বিশেষত শিল্পী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে যা সময়ের দাবি এবং এর জন্য যা প্রয়োজন তা হলো- এক : সরকারী বাজেটের আওতায় পৃষ্ঠপোষকতা ছারা যাত্রা শিল্পকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয় এটাই সত্যি। এখন বিষয়টি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতায় শিল্পকলা একাডেমি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান যারা প্রতিবছর যাত্রা দলগুলোর কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়ে থাকে সত্যি কিন্তু তার পরিবর্তে যাত্রা দলগুলো কি সুবিধা ভোগ করছে তা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠানকে তাদের বাজেট থেকে অনুদান দিয়ে থাকে যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। তাই যদি হয় তবে লোকজ সংস্কৃতির বাহক হিসেবে যাত্রা দলগুলো তাদের সংগঠিত করার জন্য সরকারী অনুদান পেতে পারে যা সময়ের দাবি। দ্বিতীয়ত : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা বিভাগ যাত্রাশিল্পীর ক্ষেত্রে এত উদাসীন কেন? এই প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত সুবিধা রয়েছে এবং কেবল উদ্যোগের অভাবে আগের জাতীয় যাত্রা উৎসব আয়োজনে তারা পিছপা হচ্ছে তা সংস্কৃতির অঙ্গনের জন্য ক্ষতিকর। দর্শকের কাছ থেকে যে চাঁদা আহরিত হবে তা দিয়ে এ সকল আয়োজনের খরচ মেটানো সম্ভব । তৃতীয়ত : যাত্রা, চলচিত্র, নাট্যকলা, সঙ্গীত প্রভৃতির সমধর্মী হলেও এদের মধ্যে পদ্ধতিগত কিংবা শ্রেণীগত পার্থক্য রয়েছে। একমাত্র যাত্রা শিল্প ছাড়া অন্য শিল্পগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব ইনস্টিটিউট রয়েছে যার মাধ্যমে এই সকল শিল্পের কলা-কুশলীর প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও গবেষণা পেয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কিছু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত ও নাট্যকলা বিভাগ রয়েছে সত্যি কিছু নাট্য কলার হিসেবে যাত্রা বিষয়ে কোন পড়াশোনা কিংবা প্রশিক্ষণ আছে বলে মনে হয় না। এমনকি শিল্পকলা একাডেমি এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও এ নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের ভাবনার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় বদ্ধ পরিকর। সেই হিসেবে সুস্থ ধারার সংস্কৃতিক চর্চা পালনে নীতি সহায়তা প্রদান সরকার করে যেতে পারে যদিও এর বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে; চতুর্থত : সমালোচকরা বলছেন সমসাময়িককালে যাত্রা শিল্পের অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ অসাধু যাত্রাপালার ব্যবসায়ীদের প্রিন্সেস আমদানি আর জুয়া হাউজি চালু যা পূর্বের সময়ে এগুলো ছিল না যা চিরায়িত যাত্রাপালার মৃত্যুর কারণ। প্রশাসন এ ব্যাপারে কঠোর হলেও স্থানীয় সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সহায়তায় এই অশোভন কাজগুলো চলতে থাকে জেলা উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন যদি সক্রিয় হয় তবে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সুস্থ ধারার যাত্রাপালা আয়োজন করা সম্ভব হবে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে নয়; পঞ্চমত : যাত্রাপালা সাহিত্য সস্কৃতির তথা লোকজ শিক্ষার বাহক বিধায় এর ওপর প্রয়োগধর্মী গবেষণা একেবারেই অপ্রতুল এমনকি দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার পাঠ্যসূচীতে এ বিষয়টির তেমন কোন উপস্থিতি লক্ষণীয় হয় না যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি দুর্বল দিক। আবার যারা সাহিত্য কিংবা নাট্যকলা বিভাগে গবেষণা করে তাদের যাত্রাশিল্পের ওপর এমফিল কিংবা পিএইচডি করতে দেখা যায় না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চতর গবেষণা বিভাগগুলোকে এই বিষয়ে প্রাধান্য দিতে হবে। যষ্টত : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বাংলাদেশের যাত্রা দলগুলোর ওপর একটি পঞ্জিকা বা ডিরেক্টরি তৈরি করতে পারে যেখানে তাদের দাফতরিক ঠিকানাসহ কলা-কুশলীদের জীবনবৃত্তান্ত ও পালাকারদের পরিকল্পনা উল্লেখ থাকবে। সর্বশেষ বলা যায় যে সরকার এই প্রাচীন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখবে তার বাজেটারি কাঠামোতে এবং যাত্রাশিল্প ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে যা শিল্পী, কলা-কুশলীদের প্রশিক্ষণ তথা গবেষণার ক্ষেত্র হতে পারে। সমাপ্ত
×