ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

আলোচনায় মোদি-শির বৈঠক

প্রকাশিত: ১২:০০, ৬ নভেম্বর ২০১৯

আলোচনায় মোদি-শির  বৈঠক

গত ১২ অক্টোবর চেন্নাই থেকে ৫০ মাইল দূরে মামাল্লাপুরামে অনুষ্ঠিত হলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে ঘরোয়া শীর্ষ বৈঠক। ভারতের পত্রপত্রিকায় দুই রাষ্ট্রনায়কের একত্রে হাস্যোজ্জ্বল ছবি ছাপা হয়েছে। তবে সেই হাসির কতটা কৃত্রিম কতটা আন্তরিক তা ব্যাখ্যা করার অবকাশ থাকে। কারণ এশিয়ার দুই বৃহৎ প্রতিবেশী এবং বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল এই দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক যে খুব বেশি অন্তরঙ্গ বা উষ্ণ নয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পরস্পরের মধ্যে অস্বস্তিকর বিষয়ের তালিকা বেশ দীর্ঘ। উভয়েই এমন সব ভূখ-ের দাবিদার যা রয়েছে অপরের নিয়ন্ত্রণে। চীন ভারতের গোটা অরুনাচল প্রদেশের ওপর অধিকার দাবি করে। উভয়ের রয়েছে এমন সব বন্ধু যাদের অপরজন ঘৃণা করে। ভারতের চিরশত্রু পরমাণু অস্ত্রধারী পাকিস্তানের কাছে আর্থিক, সামরিক ও কূটনৈতিক দিক দিয়ে চীন উত্তরোত্তর গুরুত্বপূর্ণই শুধু নয় বরং অপরিহার্য। অন্যদিকে ভারত কয়েক দশক ধরে দালাইলামাসহ তিব্বতের বিশিষ্ট নির্বাসিত নেতাদের নিজ ভূখ-ে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। চীন তার ঋণে নির্মিত অবকাঠামোর মাধ্যমে এশিয়াকে অখ- ও একীভূত করার লক্ষ্যে বেল্ট ও রোড উদ্যোগের প্রতি ভারতের বিরোধিতায় ক্ষুব্ধ। ভারতও আবার দু’দেশের ৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বাণিজ্যে চীনের ৫৩০ কোটি ডলারের উদ্বৃত্তের জন্য বিরক্ত। দু’দেশের জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগের চীনা প্রস্তাবসহ অন্যান্য প্রস্তাব ভারত প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। ভারত সন্দেহ করে যে গবেষণা ক্ষেত্রে সহযোগিতার মতো চীনা প্রস্তাবগুলোর আড়ালে কোন কপট উদ্দেশ্য রয়েছে। চীন থেকে প্রতিবছর যে প্রায় ১৫ কোটি ট্যুরিস্ট বিদেশে ভ্রমণ করে থাকে তার অতি সামান্য অংশ মাত্র আড়াই লাখ যায় ভারতে। দু’দেশের সামরিক শক্তির ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিয়েও ভারত শঙ্কিত। চীনের অর্থনীতি ভারতের ৫ গুণ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রয়েছে এর শিল্পের ভিত্তি ও প্রতিরক্ষা বাজেট। এ অবস্থায় চীন দ্রুত ছাড়িয়ে যাচ্ছে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রটিকে যে কিনা এখনও আমদানি অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। ভারত মহাসাগরকে ভারত তার নিজের মহাসাগর হিসেবে দেখে। সেই মহাসাগরে চীনের যুদ্ধাজাহাজ ও সামমেরিন শুধু যে আনাগোনা করছে তাই নয়, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো ছোট ছোট যেসব দেশকে ভারত তার পশ্চাদভূমির অংশ হিসেবে দেখে চীনের অর্থ তাদের অভিভূত এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিপুলভাবে ঋণগ্রস্ত করে ফেলেছে। ওদিকে চীন তার তিন প্রতিপক্ষ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতাকে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে। কারণ অংশত এই যে ভারত নিজেকে ভাবী পরাশক্তি হিসেবে গণ্য করে। অংশত অন্য কারণ হলো নিজের বৃহত্তর প্রতিবেশীকে উস্কানি না দেয়ার আগ্রহ থেকে ভারত আনুষ্ঠানিক জোট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু গোলমেলে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলেও আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্রমাগত জোরদার হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক প্রতিরক্ষা চুক্তি। ব্রুকলিন ইনস্টিটিউটের গবেষক কনস্ট্যান্টিনো জেভিয়ার বলেন, দিল্লীর কেউই এই বিভ্রমে ভোগেন না যে চীন ভারতের এক নির্ভরযোগ্য অংশীদার। কিংবা আমেরিকার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দ্বিধাগ্রস্ত সম্পর্ক, জাপানের সঙ্গে গভীরতম অংশীদারিত্ব এবং ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য মধ্যস্তরের শক্তির সঙ্গে বলিষ্ঠতর সম্পৃক্ততার বিকল্প হতে পারে চীন। এই দেশগুলোও চীনের নিরবচ্ছিন্ন ও ক্রমবর্ধমান সাম্ভে উত্থানে সমভাবে উদ্বিগ্ন। উত্তেজনা ও টানাপোড়েনের এতসব উৎস থাকার পরও মোদি ও শি জিনপিং কি কারণে আলোচনায় বসলেন এবং কি নিয়ে আলাপ করলেন এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। হতে পারে যে তারা আসল বিরোধীয় ইস্যুগুলোকে বাদ দিয়ে গৌণ সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা করেছেন। লক্ষ্য করার ব্যাপার হলো হংকং ও সিনকিয়াংয়ে চীনের বিতর্কিত নীতি নিয়ে ভারত তেমন কিছুই বলছে না এবং নির্বাসিত তিব্বতীদের তার ভূখ-ে আশ্রয় দেয়া কমিয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে ভারত আশা করেছে যে কাশ্মীর ইস্যুতে চীন তার সুর নরম করবে। কিন্তু এদিক দিয়ে শি মোদিকে হতাশা করেছেন। কারণ সফরের আগেই শি কাশ্মীর পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তানের ভূমিকাকে সমর্থন করেছেন। ভারত থেকে শি গেছেন কাঠমা-ুতে। সেখানে নেপালের সঙ্গে ১৮টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে যার মধ্যে সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে চীনা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও আছে। নেপালে চীন-ভারতের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে শ্রীলঙ্কা। চীন সেখানকার বন্দর ও অন্যান্য অবকাঠামোগত বেশ কিছু ঘোলাটে চুক্তি করে নিজেই পানি ঘোলা করে ফেলেছিল। এতে যে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয় তা ভারতের অনুকূলে আসে। এখন আবার পেন্ডুলাম চীনের দিকে দুলছে। নবেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত রাজাপাকসের ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রবল সম্ভাবনা আছে সেটা ভারতের জন্য নিশ্চয়ই সুখকর নয়। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×