ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পরের আসর হবে আরও জাঁকজমকপূর্ণ

প্রকাশিত: ১১:৫৫, ৬ নভেম্বর ২০১৯

পরের আসর হবে আরও জাঁকজমকপূর্ণ

দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম শীর্ষ নাম চট্টগ্রাম জেলা। প্রায় সব খেলাতেই এ জেলার ক্রীড়াবিদরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। রাজধানী ঢাকার পর বন্দর নগরীর চট্টলাতেই সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খেলাধুলা। যার সবশেষ নমুনা দেখা গেছে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ ফুটবলে। গত ১৯ থেকে ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে বসেছিল শহীদ শেখ কামালের নামে আয়েজিত আন্তর্জাতিক ক্লাব ফুটবলের তৃতীয় আসর। ফাইনাল মহারণের মধ্য দিয়ে সফলভাবে শেষ হয়েছে এবারের আসর। দেশীয় ক্লাব চট্টগ্রাম আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও এবারের জমজমাট পারফর্মেন্সে সবাই উচ্ছ্বসিত। শুধুমাত্র মালদ্বীপের টিসি স্পোর্টস বাদে বাকি সাতটি দলই ছিল চৌকষ। যে কারণে প্রায় প্রতিটি ম্যাচই হয়েছে উপভোগ্য। ম্যাচগুলো দেখতে গ্যালারিতে দর্শক উপস্থিতিও ছিল প্রত্যাশামতো। এই বিষয়গুলোকে বড় তৃপ্তি হিসেবে দেখছেন আয়োজকরা। তাই তো এমন আয়োজন বার বার চান দর্শকরা। তৃতীয় আসরের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে মালয়েশিয়ান ক্লাব টেরেঙ্গানু এফসির কাছে ২-১ গোলে হেরে রানার্সআপ হয়েছে আয়োজক চট্টগ্রাম আবাহনী। আর অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবে ভেসেছে টেরেঙ্গানু। এই জয়ে নিজেদের ৬৩ বছরের ক্লাব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ট্রফি জিতেছে কোচ নাফুজি বিন জাইনের দল। অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের ২২ নবেম্বর টেরেঙ্গানু ক্লাব প্রতিষ্ঠা হওয়ার দেশের বাইরে এটা তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা। এই হারে শিরোপা পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল বন্দর নগরীর জায়ান্টদের। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম আসরে চট্টগ্রাম আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হলেও ২০১৭ সালে দ্বিতীয় আসরে ফাইনালেই খেলতে পারেনি। এবার শিরোপা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়ে মিশন শুরু করলেও রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে চট্টলা আবাহনীকে। শিরোপা জিতে টেরেঙ্গানু এফসি প্রাইজমানি পেয়েছে ৫০ হাজার ইউএস ডলার। রানার্সআপ চট্টগ্রাম আবাহনী পেয়েছে ২৫ হাজার ইউএস ডলার। আর প্রতিটি দল অংশগ্রহণ মানি হিসেবে পেয়েছে ১০ হাজার ইউএস ডলার। পুরো টুর্নামেন্টে চোখ ধাঁধানো পারফর্মেন্স প্রদর্শন করে সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন টেরেঙ্গানুর ব্রিটিশ ফরোয়ার্ড লি টাক। শুধু তাই নয়, দলটির অধিনায়ক ৬ গোল করে আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছেন। আর ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন দলের ডিফেন্ডার হাকিম বিন মামাট। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সুশৃঙ্খল দলের পুরস্কার ফেয়ার প্লে ট্রফি জিতেছে স্বাগতিক চট্টগ্রাম আবাহনী। ফাইনাল লড়াই দেখতে এমএ আজিজ স্টেডিয়াম দর্শকে টইটুম্বর হয়ে যায়। ৩০ হাজার আসন বিশিষ্ট গ্যালারি কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়। ফাইনালের জমজমাট লড়াই দেখতে দর্শকদের মধ্যে ছিল ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। প্রিয় তারকাদের খেলা দেখার জন্য দুপুরের পর থেকেই স্টেডিয়াম এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের চাপও বাড়তে থাকে। ম্যাচ সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হলেও ঘণ্টাখানেক আগেই গ্যালারি ভরপুর হয়ে যায়। দর্শকের ঢল এতটাই বেশি ছিল যে, আরও কয়েক হাজার দর্শক স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারেননি। দর্শকের এই জোয়ার দেখে আয়োজকের চোখেমুখে দেখা গেছে তৃপ্তির হাসি। শেখ কামাল ফুটবলের টুর্নামেন্ট কমিটির প্রধান সমন্বয়ক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা দর্শকবিহীন মাঠে টুর্নামেন্ট করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই বিষয়টা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাই না। আমরা সেই জায়গা থেকে চেষ্টা করেছি মাঠে যেন দর্শক আসে। এতে আমরা সফল হয়েছি। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পরের ম্যাচগুলোতে প্রচুর দর্শক খেলে দেখেছেন। ফাইনালে তো সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে’। ফাইনালে দর্শকের চাপ এতটাই বেশি ছিল যে, টিকেটের জন্য হাহাকার সৃষ্টি হয়। ১০ ও ২০ টাকার টিকেট কালোবাজারিতে ১০০, ১৫০ থেকে শুরু করে ২০০ টাকাতেও বিক্রি করতে দেখা গেছে। জামাল, আরিফুল, ইয়াসিন, রহমত, লি টাকদের খেলা খেলতে বেশি মূল্যে টিকেট কিনেও অভিযোগ করেননি ফুটবলপ্রেমীরা। সব ধরনের ভক্তদের মাঠে দেখা গেছে। শিশু থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বয়স্করাও স্টেডিয়ামে জড়ো হন। তবে অনেক ভক্ত-সমর্থক অভিযোগ করেন, টিকেট থাকা সত্ত্বেও তারা গ্যালারিতে প্রবেশ করতে পারেননি। এ সংখ্যা কয়েক হাজারের মতো। ফাইনাল মহারণকে সামনে রেখে স্টেডিয়ামপাড়ায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাসহ চট্টগ্রাম আবাহনীর ছোট ছোট আকাশী-হলুদ রঙের পতাকায় ছেয়ে যায় পুরো এলাকা। আবাহনীর পতাকা মাথায় জড়িয়ে থাকা আরাফাত রহমান বলেন, ‘এবার খেলা দেখে আমরা অনেক আনন্দ পেয়েছি। অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলা হয়েছে। চট্টগ্রাম আবাহনী ভাল খেলেছে। বিদেশী দলগুলোর খেলাও ভাল লেগেছে’। মেহেদি মাসুদ নামের এক ভক্ত বলেন, ‘যে কোন খেলাধুলাতেই চট্টগ্রাম এগিয়ে। শেখ কামাল কাপের মধ্য দিয়ে আরেকবার এটা প্রমাণ হয়েছে।’ সানজিদা সেতু নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণী বলেন, ‘অনেক আগ্রহ নিয়ে ফাইনাল খেলা দেখতে এসেছি। আশা করছি তৃপ্তি নিয়েই ঘরে ফিরব’। ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে একটা সময় দেশের ফুটবলে দর্শক খরা ছিল চরমে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দলের সাফল্যে আবারও মাঠে আসছেন দর্শকরা। শেখ কামাল কাপ এর বড় প্রমাণ। মূলত বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দারুণ পারফর্মেন্স এতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। বাছাইপর্বে এখন পর্যন্ত খেলা তিনটি ম্যাচেই দারুণ খেলেছেন জামাল ভুঁইয়া, সাদ উদ্দিন, নাবীব নেওয়াজ জীবন, ইয়াসিন খানরা। ভারতের বিরুদ্ধে সবশেষ ম্যাচে তো দুই মিনিটের জন্য জয় হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপরও বাংলাদেশী তরুণদের খেলায় ভীষণ উচ্ছ্বসিত দেশের মানুষ। অনেকদিন পর বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা লক্ষ্য করা গেছে। সর্বসাধারণ বলছেন, ভাল খেললে দর্শক ঠিকই মাঠে আসবে। সে প্রমাণ পাওয়া গেল বন্দর নগরীর শহরে। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই গ্যালারিতে দর্শক ছিল আশা জাগানিয়া। তবে ফাইনাল মহারণে সব ছাপিয়ে গেছে। ম্যাচটি দেখতে রীতিমতো জন¯্রােত বয়ে যায় এমএ আজিজ স্টেডিয়াম এলাকায়। ছিল না তিল ধারণের জায়গা। ভারতের বিরুদ্ধে জাতীয় দলের ম্যাচই দর্শকদের আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য তারা সরাসরি মাঠে বসে জামাল, ইয়াসিনদের খেলা দেখার সুযোগ হাতছাড়া করেননি। স্বাগতিক ক্লাব শিরোপা জিততে না পারলেও তাই হতাশ নন আয়োজকরা। টুর্নামেন্ট কমিটির প্রধান সমন্বয়ক তরফদার রুহুল আমিন বলেন তাই তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলেন, আমরা দীর্ঘ চার মাসের প্রস্তুতি নিয়ে অক্টেবরের ১৯ তারিখে আসরটা মাঠে গড়াতে সক্ষম হয়েছি। অনেক বাধাবিপত্তি ছিল, ঘটন অঘটনও ছিল, শঙ্কাও ছিল। শেষ মুহূর্তে ঢাকা আবাহনী নাম প্রত্যাহার করে নিল। সবকিছু মিলিয়ে আমরা শঙ্কার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। একই সময়ে আমাদের মনোবলটা ছিল দৃঢ়। যে কোন মূল্যে টুর্নামেন্টটা করতে হবে। যখন ঢাকা আবাহনী নাম প্রত্যাহার করলো তখন সত্যিকার অর্থেই আমরা বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপরও আমরা ভাল একটা দলকে (গোকুলাম কেরালা) আনতে সক্ষম হয়েছি। টুর্নামেন্ট এত ভাল হবে সেটা আমরাও কল্পনা করিনি। আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালকে ব্র্যান্ডিং করা। শেখ কামাল বাংলাদেশের আধুনিক ফুটবলের কারিগর। শেখ কামালের স্বপ্ন ছিল বিশ্বাঙ্গনে দেশের ফুটবল মাতানো। সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমরা বাংলার ঝিমিয়ে পড়া ফুটবলকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। দক্ষিণ এশীয় পর্যায়ে একটা ক্লাবের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হয় না। আমরা সেটা করছি। দর্শকবিহীন মাঠে আমরা টুর্নামেন্ট করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই বিষয়টা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাই না। আমরা সেই জায়গা থেকে চেষ্টা করেছি মাঠে যেন দর্শক আসে। সেটা করতে হলে ভাল খেলা দিতে হবে, ভাল আয়োজন কতে হবে। সে লক্ষ্যে আমরা এগুচ্ছি। ২০১৫ সালে আমরা শুরু করেছিলাম। সেটা ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। সফল এই ক্রীড়া সংগঠক বলেন, ২০১৭ সালে আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী আয়োজন করতে পারিনি। কিন্তু ২০১৯ সালে এসে আমরা ভাল একটা টর্নামেন্ট করতে চেয়েছিলাম আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে নিয়ে। সেটা আমরা করতে পেরেছি। ঢাকা আবাহনী নাম প্রত্যাহার করার পরও গোকুলামকে পেয়েছি, যা টুর্নামেন্টের আবহটাই পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমরা মাঠে গতিময় ফুটবল দেখতে পেয়েছি। এটা অবিশ্বাস্য ছিল। এতে করে হয়েছে কি, দর্শকের ভাল একটা সমাগম আমরা দেখতে পেয়েছি। আর চট্টগ্রাম আবাহনীর ম্যাচে তো আমরা স্টেডিয়ামে দর্শকের জায়াগাই দিতে পারিনি। প্রতিটি ম্যাচই হয়েছে দারুণ উপভোগ্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। সবকিছু মিলিয়ে আমি মনে করি, আমাদের প্রাপ্তি প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আরও ভাল মানের দল আনতে চায় আয়োজকরা। এ বিষয়ে তরফদার বলেন, ২০১৭ সালে আমরা যেভাবে দল এনেছিলাম। ২০১৯ সালে কিন্তু আমরা অন্যভাবে দলগুলোকে আনার চেষ্টা করেছি। সামনে এটাকে আমরা আরেকটু বাড়াব। হয়ত বা আটটা থেকে দশটা দলে উন্নীত হতে পারে। অথবা দল আটটা রেখেই এরিয়া বাড়াব আমরা। এক দেশ থেকে তখন হয়ত বা একটা করে দল আসবে। পরের আসরেই আমরা এটা করার চেষ্টা করব। এবার আমরা দেখব যে দলগুলো এখানে এসে ভাল খেলছে, এক দুই তিনের মধ্যে আছে তাদেরই আমন্ত্রণ জানানো হবে। আর নিঃসন্দেহে এবারের আসর আগের দুই আসরের চেয়ে ভাল হয়েছে। এবারের টুর্নামেন্ট অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশে আগে কখনও এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলা হয়নি।
×