ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি সর্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছেন- অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন ॥ কাদের ;###;বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ

জাবিতে অচলাবস্থা ॥ সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিক্ষোভ সমাবেশ

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ৬ নভেম্বর ২০১৯

জাবিতে অচলাবস্থা ॥ সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিক্ষোভ সমাবেশ

জাবি সংবাদদাতা ॥ উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের জের ধরে পাল্টাপাল্টি হামলার অভিযোগের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক জরুরী সিন্ডিকেট সভা ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার মধ্যেই হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এদিকে জাবি পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী পর্যবেক্ষণ করছেন জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন। এর আগে রবিবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের আলোচনায় কার্যত কোন সমাধান না আসায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামকে অবরুদ্ধ করে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। সোমবার সন্ধ্যা থেকেই উপাচার্য অধ্যাপক ফারাজানা ইসলামের বাসভবন ঘেরাও করে রাখে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। মঙ্গলবার উপাচার্যপন্থী শিক্ষকরা উপাচার্যের বাসভবনে ঢোকার চেষ্টা করেও পারেননি। এরপর ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী ঘটনাস্থল থেকে আন্দোলনকারীদের হটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে তখন কয়েকজন আহত হয়। এ হামলার ঘটনায় চার সাংবাদিক ও ছয় শিক্ষকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে। গুরুতর আহত আট জনকে সাভারের একটি বেসরকারী হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনার পর সিন্ডিকেটের জরুরী সভা ডাকা হয়। ওই সভায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ফিরোজ উল হাসান। তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া আন্দোলনের নামে নিষিদ্ধ সংগঠন ‘শিবিরের’ তৎপরতা শুরু হয়েছে। এর পেছনে বড় দুর্ঘটনা ঘটানোর চক্রান্ত থাকতে পারে। এসব কারণে সিন্ডিকেট অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বন্ধ থাকবে এবং আল্টিমেটলি ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ থাকবে। এর আগে বেলা এগারোটার দিকে উপাচার্যপন্থী শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শহীদ মিনার থেকে একটি মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের দিকে যায়। মিছিলটি উপাচার্যের বাসভবনে ঢুকতে চাইলে সেখানে অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা রাস্তায় বসে তাদের ওপর দিয়ে যেতে বলেন। এ সময় উপাচার্যপন্থী ও আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মধ্যে একপর্যায়ে উত্তপ্তবাক্য বিনিময় হয়। এদিকে বেলা পৌনে বারোটার দিকে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচীর অংশ হিসেবে জাবি শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে যায়। মিছিলটি উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এসে পৌঁছালে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আন্দোলনে শিবির আছে এমন অভিযোগে ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনার এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলা করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। হামলায় আহত শিক্ষকরা হলেনÑ নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানাসহ কয়েকজন। আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে দর্শন বিভাগের মারুফ মোজাম্মেল, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাহাথির মুহাম্মদ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাইমুম ইসলাম, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের রাকিবুল ইসলাম রনি, ইংরেজী বিভাগের আলিফ মাহমুদ, অর্থনীতি বিভাগের উল্লাস, দর্শন বিভাগের রুদ্রনীল, প্রতœতত্ত্ব বিভাগের সৌমিক বাগচীর নাম জানা গেছে। এছাড়া সরকার ও রাজনীতি বিভাগের মারিয়াম ছন্দা ও সাউদা নামে দুই ছাত্রীকেও মারধর করতে দেখা গেছে। এ সংবাদ সংগ্রহকালে আহত সাংবাদিকরা হলেনÑ প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মাইদুল ইসলাম, বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি আজাদ, বার্তাবাজারের প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমু ও বাংলা লাইভ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল। হামলা চলাকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। আন্দোলনে হামলার বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ রকম ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ উস্কানিতে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ছাত্রলীগ যখন আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে তখন ভিসিপন্থী শিক্ষকরা তাদের স্বাগত জানিয়ে হাততালি দিয়েছেন।’ এ বিষয়ে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা বলেন, আমরা শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। হামলার বিষয়ে আন্দোলকারীদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, আন্দোলনে কোন শিবির সংশ্লিষ্টতা নেই। যে কোন শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য শিবির অপবাদ দেয়াটা ওদের পুরনো অপকৌশল। বুয়েটের আবরারকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে, সেখানেও একই অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছে।’ প্রশাসন দুর্নীতি ঢাকার অপকৌশল হিসেবে এ হামলা করিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হামলা করে এ আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। আমাদের শেষ রক্তবিন্দু অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’ হামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ঘটনাস্থলে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা চেষ্টা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তবে বড় ঘটনা এড়াতে আমরা তৎপর আছি। মারধরের ঘটনার আধাঘণ্টা পরে উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম সমর্থক শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে তার কার্যালয়ে যান। পরে সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর কোন হামলা হয়নি। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সুশৃঙ্খলভাবে আন্দোলনকারীদের আমার বাসভবনের সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, আন্দোলনকারীদের পেছনে জামায়াত-শিবির রয়েছে। তারা গত কয়েকদিন ধরে আমাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আমি বের হতে পারিনি। আমি এখন অফিস করব। আমার সহকর্মী ও ছাত্রলীগ কর্মীদের ‘গণঅভ্যুত্থান’ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ জানান। বিকেল তিনটায় এক জরুরী সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিকেল পাঁচটার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে হল বন্ধ ঘোষণা ও হামলার প্রতিবাদে বিশ^বিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল চারটায় আন্দোলনকারী পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এদিকে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের অপসারণ দাবির এ আন্দোলন প্রধানমন্ত্রী পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার দুপুরে সেতু ভবনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, এটা প্রধানমন্ত্রীর নজরে আছে। এর সর্বশেষ খবর প্রধানমন্ত্রী জানেন। কোন ব্যবস্থা নিতে হলে তিনি খোঁজ-খবর নিয়ে নেবেন। সরকার প্রধান এ বিষয়ে খুব সজাগ। তিনি বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করছেন, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন। ফের ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান ॥ মঙ্গলবার রাত ১০টায় উপাচার্যের বাসভবন সংলগ্ন রাস্তায় ফের অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন- সিনেট সদস্য আবুল কালাম আজাদ, আনোয়ার হোসেন মৃধা ও ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন।
×