ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণের বোঝা বাড়ছে জিপিএইচ ইস্পাতের

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ৬ নভেম্বর ২০১৯

ঋণের বোঝা বাড়ছে জিপিএইচ ইস্পাতের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ শেয়ারবাজারের জিপিএইচ ইস্পাতে এখন ঋণের বোঝা বাড়ছে। নিয়মিত মুনাফার সবটুকু কোম্পানিতে রেখে দেয়া এবং রাইট ইস্যুর মাধ্যমে বড় অর্থ সংগ্রহের পরেও কোম্পানিটির কাঁধে এখন হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝা। জিপিএইচ ইস্পাত শুধুমাত্র ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যে ২০১২ সালে শেয়ারবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) ৬০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। তবে শেয়ারবাজারে আসার পরে সেই লক্ষ্য থেকে সরে গেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পূর্বে ২০১০-১১ বছর শেষে কোম্পানিটির ৩১১ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণ ছিল। সেই কোম্পানিটির ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১১১ কোটি টাকায়। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৩০৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা ও স্বল্পমেয়াদী ৮০৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা। কোম্পানিটিকে ঋণ পরিশোধের জন্য শেয়ারবাজারে আনা হলেও এখন আরও বেড়েছে ১ হাজার ৭৯৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বা ৫৭৮ শতাংশ। শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসা থেকেই বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে। ঋণ পরিশোধ করবে বলে গ্রহণ করা আরেকটি প্রতারণা। তাই শুধু আইপিও অনুমোদন নয়, এরপরে কোম্পানিগুলো কি করে তা বিএসইসির নজরদারি করা উচিত। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার অর্থবছরে (২০১২-১৩) কোম্পানিটি ৪৪ কোটি ১৩ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ করে। এরপরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৫ কোটি ১১ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১১১ কোটি ৭২ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২২১ কোটি ৮২ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯১১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৯ মাসে ৫১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকার ঋণ সংগ্রহ করা হয়েছে। অপরদিকে শেয়ারবাজারে আসার আগে ২০১০-১১ হিসাব বছরে কোম্পানিটির সুদজনিত ব্যয় হয় ৩০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। যা ২০১১-১২ হিসাব বছরে ৩৭ কোটি ৩৮ লাখ, ২০১২-১৩ বছরে ৩৮ কোটি ৫২ লাখ, ২০১৩-১৪ বছরে ৩২ কোটি ৯০ লাখ, ২০১৪-১৫ বছরে ৩৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ১৮-মার্চ ১৯) ৫২ কোটি ১৮ লাখ টাকা সুদজনিত ব্যয় হয়েছে। এতে করে শেয়ারবাজারে আসার উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ধোঁকা দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। দেখা গেছে, কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পরে ৭ বার (২০১২-১৮) ঘোষণা করা লভ্যাংশের মধ্যে ৪ বারই শুধুমাত্র বোনাস শেয়ার দিয়ে মুনাফার সবটুকু কোম্পানিতে রেখে দেয়। আর ২ বার নগদ লভ্যাংশ ও ১ বার বোনাস এবং নগদ উভয় লভ্যাংশ দেয়া হয়। ওই ৭ বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা অর্জন হয়েছে ২৫৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর বিপরীতে মাত্র ৭৪ কোটি ২২ লাখ টাকার নগদ লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়েছে। বাকি ১৮১ কোটি টাকাই কোম্পানিতে রেখে দেয়া হয়েছে। এদিকে কোম্পানিটির ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ব্যবসায়ও পর্ষদ নগদের পাশাপাশি বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে। ওই অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি ২.২৪ টাকা হিসেবে মোট ৮০ কোটি ৬৮ লাখ টাকার নিট মুনাফা হয়েছে। এরমধ্যে থেকে ৫ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ০.৫০ টাকা হিসাবে মোট ১৮ কোটি ১ লাখ টাকার নগদ লভ্যাংশ বিতরণ করা হবে। অর্থাৎ মুনাফার ২২.৩২ শতাংশ শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বিতরণ করা হবে। আর ৫ শতাংশ বোনাস বা শেয়ারপ্রতি ০.৫০ টাকা হিসাবে ১৮ কোটি ১ লাখ টাকা বা মুনাফার ২২.৩২ শতাংশ দিয়ে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো হবে। মুনাফার বাকি ৪৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বা ৫৫.৩৬ শতাংশ রিজার্ভে রাখা হবে। নিয়মিত বোনাস শেয়ার প্রদান ও ২০১৬ সালে রাইট ইস্যুর মাধ্যমে কোম্পানিটির বর্তমানে পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩৬০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। যার পরিমাণ আইপিও পূর্ব ছিল মাত্র ৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ তালিকাভুক্তির পরে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো হয়েছে ৩১০ কোটি ১৯ লাখ টাকা বা ৬২০ শতাংশ। রাইট ইস্যুর আগে কোম্পানিটির লভ্যাংশ ঘোষণা বেড়ে যায়। এর আগের ৩ বছর শুধুমাত্র বোনাস শেয়ার প্রদান করা কোম্পানিটি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ব্যবসায় নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এছাড়া এর আগে ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ৫ শতাংশে নেমে আসা কোম্পানিটি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ব্যবসায় ১৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এরপরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাইট ছাড়ার অনুমোদন পায়। এই শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের পরে কোম্পানিটির লভ্যাংশ কমে এখন ১০ শতাংশ এবং বোনাসে ফিরে এসেছে। জিপিএইচ ইস্পাত ২০০৮ সালে ব্যবসায় শুরু করে। এরপরে ৪ বছরের মাথায় ২০১২ সালে শেয়ারবাজারে আসে। এ সময়ে কোম্পানিটি ব্যবসায়িক সাফল্যে ৩০ টাকা (প্রিমিয়াম ২০ টাকা) দরে শেয়ার ইস্যু করে ৬০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। কিন্তু কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে আসার আরও ৪ বছরের পরে এসে ১৪ টাকা দরে ১৮ কোটি ৭১ লাখ ১০ হাজার রাইট শেয়ার ইস্যু করে। এর মাধ্যমে কোম্পানিটি ২৬১ কোটি ৯৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে। এদিকে কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে আসার আগে ২০১১ সালে ৬১ কোটি ১৭ লাখ টাকার ইক্যুইটি বা নিট সম্পদ ব্যবহার করে মুনাফা করে ১৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা। কিন্তু শেয়ারবাজারে এসে নিয়মিত বোনাস শেয়ার দিয়ে মূলধন বৃদ্ধি ও সংরক্ষিত আয় বাড়িয়ে ইক্যুইটি বাড়লেও মুনাফার পরিমাণ সেভাবে বাড়েনি। দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গড় ৫২৮ কোটি ২৩ লাখ ইক্যুইটি ব্যবহার করে মুনাফা হয়েছে ৬৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পূর্বের ২৯.৪৯ শতাংশ রিটার্ন অন ইক্যুইটি পরে নেমে এসেছে ১২.১৮ শতাংশ। এ বিষয়ে জিপিএইচ ইস্পাতের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) এইচএম আশরাফুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নেয়া হয়েছে। আইপিওতে যাওয়ার সময় ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা ছিল না। এর বাহিরে কিছু না।
×