ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এসএ রেকর্ডে ত্রুটি

ঠাকুরগাঁওয়ে ভূমি রেজিস্ট্রেশন সেবা বিপর্যস্ত

প্রকাশিত: ০৯:১০, ৬ নভেম্বর ২০১৯

ঠাকুরগাঁওয়ে ভূমি রেজিস্ট্রেশন সেবা বিপর্যস্ত

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও, ৫ নবেম্বর ॥ কিছু মানুষের অনৈতিকতা, অতিমাত্রার লোভ, ফরটিসিক্স বা এসএ রেকর্ডের ত্রুটি এবং যুগোপযোগী সরকারী নীতি না থাকায় ঠাকুরগাঁওয়ে ভূমি রেজিস্ট্রেশন সেবা বিপর্যস্ত হতে চলেছে। দিন দিন বেড়েই চলেছে ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্য। খোদ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বলছেন, ভূমি সেবার সমন্বয় সাধন প্রয়োজন। আর জেলা রেজিস্ট্রার বলছেন জনদুর্ভোগ কমাতে প্রয়োজন যুগোপযোগী সরকারী নীতিমালা। ঠাকুরগাঁওয়ে ভূমির মালিকানা নির্ধারিত হয় ১৯১৭ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ (সিএস) রেকর্ডের ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ফরটিসিক্স (এসএ) রেকর্ড এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন দলিলাদি, খারিজ ও হাল নাগাদ খাজনা পরিশোধের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ রেকর্ডে প্রথম পাতায় বিভিন্ন দাগের বিপরীতে মালিকদের প্রাপ্য অংশের উল্লেখসহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দাগ দখলের উল্লেখ থাকে। কিন্তু ফরটিসিক্স রেকর্ডে প্রথম পাতায় শুধু মালিকদের নাম উল্লেখ থাকে। এদিকে জেলার সাব-রেজিস্ট্রাররা জমি কেনা-বেচায় রেজিস্ট্রি করার ক্ষেত্রে শুধু সাফ কবলা দলিলে ফরটিসিক্স রেকর্ড এবং সঙ্গে খারিজ অথবা খাজনা পরিশোধের যেকোন একটি দেখে থাকেন। অন্যদিকে হেবা, হেবা বিল এওয়াজ ও পাওয়ার অব এটর্নি দলিলসহ অন্যান্য দলিল রেজিস্ট্রি করার ক্ষেত্রে শুধু ফরটিসিক্স রেকর্ডে মালিকদের নাম উল্লেখ দেখেন তারা। অন্যকিছু দেখেন না। এতে বিপর্যস্ত হতে চলেছে জেলার ভূমি রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থাপনা। চরম দুর্ভোগে পড়ছে সাধারণ মানুষ। দিনে দিনে বাড়ছে মামলাজট। কারণ ভূমি মালিকানা নির্ধারণে আদালত ও ভূমি রেজিস্ট্রেশনের নিয়মনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদিকে মামলার দীর্ঘসূত্রতা আর ফরটিসিক্স রেকর্ডের দুর্বলতায় উৎসবে মেতেছে অসৎ, লোভী আর ভূমিদস্যুরা। তারা ওই রেকর্ডে পূর্ব পুরুষদের নাম আছে এ রকম ওয়ারিশ এবং জের ওয়ারিশদের টাকার লোভ আর বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে, তাদের জমি থাক বা না থাক অন্য ওয়ারিশের প্রিয় জমিটুকুর বিপরীতে দলিল সৃষ্টি করছে এবং শক্তি প্রয়োগ করে দখল করে নিচ্ছে। এতে প্রকৃত মালিকরা হারাচ্ছে তাদের যতেœ গড়া মার্কেট, ঘরবাড়ি আর ভূ-সম্পত্তি। আদালত প্রাঙ্গণে বাড়ছে মানুষের পদচারণা আর দীর্ঘশ^াস। মামলার রায় পেতে বছরের পর বছর কেটে যায়। হাইকোর্ট সুপ্রীমকোর্ট তো আছেই। এ বিষয়ে শহরের আশ্রমপাড়ার ভুক্তভোগী আব্দুল মজিদ বলেন, ১৯৯০ সালে আমি রেকর্ডীয় মূল মালিকের কাছ থেকে জমি কিনেছি। সে অনুযায়ী খারিজ করেছি আর হাল নাগাদ খাজনা পরিশোধ করছি। কেনার সময় কাগজপত্র দেখেশুনে কিনেছি অথচ যাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কিনেছি তাদের নাতি-পুতিরা এখন ফরটিসিক্স রেকর্ডের বলে মালিকানা দাবি করছে। আমার জমি ফাঁকা থাকার কারণে তারা রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে বিভিন্ন দলিল সৃষ্টি করে আমাকে জমি থেকে বেদখল করে ঘরবাড়ি তুলেছে। এই ফরটিসিক্স রেকর্ডের কারণে রেজিস্ট্রেশনে অত্যাধিক সমস্যা হচ্ছে বলে জানান তিনি। রেজিস্ট্রি অফিস কাগজপত্র ঠিকমতো যাচাই না করে শুধু ফরটিসিক্স রেকর্ডে পূর্বপুরুষদের নাম দেখে ওয়ারিশদের জমি থাক বা না থাক রেজিস্ট্রি করে দলিল সৃষ্টি করছে। মূলত ভূমিদস্যুরাই রেকর্ডের মালিকদের ওয়ারিশদের লোভে ফেলে তাদের দিয়ে এসব করাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পরবর্তীতে জমি দখল করছে। এতে প্রকৃত মালিকরা নিরুপায় হয়ে মামলা করছে আর এতে মামলাজট সৃষ্টি হচ্ছে। একই অবস্থায় সদর উপজেলার ভূলন্টি বাজারের বাসিন্দা ইয়াকুব আলী, শহরের শাহাপাড়ার শরিফুল ইসলাম, দক্ষিণ সালন্দরের ফয়জুল ইসলাম ও শাহাপাড়ার মনসুর আলীসহ আরও অনেকের। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা জজ কোর্টের সিনিয়র এ্যাডঃ মহসিন আলী বলেন, আদালত আর রেজিস্ট্রেশন আইনে জমির মালিকানা নির্ধারণ সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। জমির মালিকানার যে ধারাবাহিকতা রয়েছে সেটা সহকারী কমিশনার ভূমি ও সাব-রেজিস্ট্রারকে একই নীতি অনুসরণ করতে হবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা ভূমি সেবা দিতে গিয়ে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। জমির অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে বাটোয়ারা না থাকা এবং ফরটিসিক্স খতিয়ানের কিছু ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে একজনের জমি আরেকজন দলিল সৃষ্টি করছে। তিনি আরও বলেন, যে তিনটি ডিপার্টমেন্ট ভূমি সেবা দিয়ে থাকে সেগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছে সরকার। ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা রেজিস্ট্রার মোঃ আবু তালেব সরকার জানান, ফরটিসিক্স রেকর্ডে পূর্বপুরুষের নাম থাকার কারণে আমরা বাধ্য হয়ে রেজিস্ট্রেশন করছি। জমির ওয়ারিশ বেশি থাকলে তারা পারিবারিক বন্টক করে, খারিজ, খাজনা পরিশোধ করে যদি হস্তান্তর করতে আসে তাহলে মামলা জট থাকবে না। সব ধরনের দলিল সৃষ্টিতে খারিজ, খাজনা বাধ্যতামূলক করা উচিত।
×