ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

আবার চাঁদে যাওয়া

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ৫ নভেম্বর ২০১৯

আবার চাঁদে যাওয়া

গত ২১ জুলাই চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম পদচারণার ৫০তম বার্ষিকী পালিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে মানুষ শেষবারের মতো চাঁদের বুকে পা রাখে। তারপর থেকে মানববাহী আর কোন চন্দ্রাভিযান হয়নি, যদিও নভোচারী ছাড়া অন্যান্য চন্দ্রাভিযান আরও বহু হয়েছে। আশার কথা চাঁদে আবার মানুষ পাঠানোর ব্যাপারে নতুন করে আগ্রহের সঞ্চার হয়েছে। আগে শোনা গিয়েছিল ২০২৮ সাল নাগাদ নাসা চাঁদে নভোচারী পাঠাবে। সেই ডেট লাইন এগিয়ে এনে এখন ২০২৪ সাল করা হয়েছে। গত ২৬ মার্চ মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেছেন যে, চাঁদে নভোচারী পাঠানোর টার্গেট ডেটকে যে কোনভাবেই হোক এগিয়ে আনা হয়েছে। আগের মার্কিন চন্দ্রাভিযানের নাম ছিল এ্যাপোলো মিশন। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী এ্যাপোলো হচ্ছে গ্রীক দেবতা। তার যমজ ভগ্নির নাম আর্টেসিস। নাসার চাঁদে মানুষ পাঠানোর নতুন মিশনের নাম হবে আর্টেসিস। আমেরিকার আর্টেসিস কর্মসূচী মানববাহী চন্দ্রাভিযানের একমাত্র কর্মসূচী নয়। অত তাড়াহুড়ো না করলেও চীনও ২০৩৫ সালে চাঁদে মানুষ নামানোর কর্মসূচী নিয়েছে। অন্যান্য মহাকাশ সংস্থা যেমন ইউরোপীয়, ভারতীয়, জাপানী ও রুশ সংস্থাও চন্দ্রাভিযানের নতুন কর্মসূচী নিয়েছে। তবে তারা মানুষ পাঠাবে না, পাঠাবে রোবোটযান। এমন অনেক চন্দ্রাভিযানের মধ্য দিয়ে চাঁদে একটা ঘাঁটি গড়ে উঠবে। কেউ কেউ এমন এক ঘাঁটিকে চন্দ্রপল্লী নাম দেয়ার পক্ষপাতী। এমন মানুষেরও অভাব নেই যারা সেই চন্দ্রপল্লীকে রূপক অবস্থা থেকে বাস্তবতায় রূপ দিতে চান। তাদের একজন হলেন আমেরিকার মানববাহী মহাকাশ অভিযানের অন্যতম উদ্যোক্তা ও এ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার রশর্ট জুবরিন। ড. জুবরিনের মতে চন্দ্রপল্লী বা চাঁদের ঘাঁটি বেশ তাড়াতাড়ি নির্মাণ করা যেতে পারে। ‘দি কেস ফর স্পেস’ গ্রন্থে সেই ঘাঁটির নীলনকশা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, এই ঘাঁটি হবে চাঁদের কোন একটা মেরুতে, যেখানে প্রায় চিরস্থায়ী সূর্যালোকে থাকা পর্বতশীর্ষে গড়ে তোলা যাবে সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র। আর চিরস্থায়ী ছায়া ঢাকা জ্বালামুখ বা বিশাল বিশাল গর্তে কয়েক শ’ কোটি বছর আগে আছড়ে পড়া ধূমকেতুগুলোয় যেসব বরফ জমা হয়ে আছে তা থেকে পাওয়া যেতে পারে খাবার পানি। পর্বত শীর্ষের সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুতের সাহায্যে যদি পানির মলিকুলগুলো বিভাজন করা হয় তাহলে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য পাওয়া যাবে অক্সিজেন এবং রকেটের জ্বালানির জন্য পাওয়া যাবে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন। ড. জুবরিনের হিসাবে বলে যে, এই ঘাঁটি গড়ে তুলতে ৭ বছর সময় লাগবে এবং খরচ হবে প্রায় ৭শ’ কোটি ডলার। এরপর থেকে সেটাকে টিকিয়ে রাখতে বছরে প্রয়োজন হবে ২৫ কোটি ডলার। নাসার অবশ্য অন্য পরিকল্পনা আছে। আর্টেমিসের জন্য কোন না কোন ধরনের ঘাঁটির দরকার আছে। তবে সেই ঘাঁটি চাঁদে হবে না। বরং হবে ‘লুনার অরবিটাল প্লাটফর্ম গেটওয়ে’ নামক স্পেস স্টেশনে, যেখানে মাঝে মাঝে ক্রুরা গিয়ে থাকবেন। এই স্টেশন চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে চলবে। আর্টেসিস এভাবে কাজ করবে। এর ক্রুবাহী যান ওরিয়ন হলো সেই ধরনের নভোযানের সংস্কার যা গোড়াতে কনস্টিলেশন প্রকল্পের জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছিল। প্রকল্পটি বর্তমানে পরিত্যক্ত। একইভাবে যে রকেটের সাহায্যে ওরিয়নকে মহাশূন্যে পাঠানো হবে সেই স্পেস লঞ্চ সিস্টেম বা এসএলএস হলো কনস্টিলেশনের ভারি রকেটের কাটছাঁট সংস্করণ। ভারি রকেটটির নাম ‘এরিস ভি’। যাই হোক, ওরিয়নের প্রথম গন্তব্য হবে ‘গেটওয়ে’, এর চারজন ক্রুর দু’জন স্টেশনে থাকবে। বাকিরা বিশেষ চন্দ্র খেয়াযানে করে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করবে। সেখানে তাদের যেসব কাজ করার কথা করবে। তারপর গেটওয়েতে ফিরে সেখান থেকে পরে মর্ত্যরে বুকে ফিরে আসবে। সবাই একত্রে আসবে। পরবর্তী মিশনের ক্রুরা না আসা পর্যন্ত স্টেশনটি ক্রুহীন অবস্থায় থাকবে। নাসার প্রশাসক জিম ব্রাইডেনস্টাইনের হিসাব অনুযায়ী আগামী ৫ বছরে এই প্রকল্পের জন্য নাসার অতিরিক্ত ২ হাজার থেকে ৩ হাজার কোটি ডলারের বাজেট লাগবে। সেই বাড়তি অর্থ মিলবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সব কিছু ঠিক থাকলে ওরিয়ন, এসএলএস এবং লুনার শাটল স্পেসের বর্ণিত সময়সীমার মধ্যে পরীক্ষিত এবং উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত হবে। এদিকে চীন ২০৩৫ সাল নাগাদ চাঁদে মানুষ পাঠাবে। আগামী এক দশকে মহাশূন্যে চীনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে তার নিজস্ব এমন এক মহাশূন্য স্টেশন তৈরি করা, যা পৃথিবীর চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করবে। চাঁদে মানববাহী নভোযান পাঠানোর কর্মসূচীর কাজ শুরু হবে সম্ভবত ২০২০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ এবং চীনের মানব চাঁদের বুকে গিয়ে নামবে সম্ভবত ২০৩৫ সালের মধ্যে। চীনের জাতীয় মহাকাশ বিজ্ঞান কেন্দ্রের সাবেক প্রধান ড. উ জি বলেন, ‘এ ব্যাপারে কোন তাড়াহুড়ো নেই। আমরা কারোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছি না। তাই ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। ২০৩৫ সাল নাগাদও যদি আমরা চাঁদের বুকে চীনের কোন মানুষ নামাই তারপরও তা হবে দারুণ ব্যাপার।’ চীন অবশ্য ইতোমধ্যে মানবহীন নভোযান চাঁদে নামিয়েছে। তার অতিসাম্প্রতিক মিশন চ্যাং ৪ গত জানুয়ারিতে চাঁদের সেই অংশটিতে নামিয়েছে, যা পৃথিবী থেকে কখনই দেখা যায় না। এই সিরিজের আরও দুটি নভোযান চাঁদে গিয়ে নমুনা নিয়ে আসবে এবং আরেকটি নভোযান চাঁদের দুই মেরু পর্যবেক্ষণ করবে। ওদিকে ভারতের চন্দ্র অভিমুখে দ্বিতীয় মিশন চন্দ্রযান-২ দক্ষিণ মেরুর কাছে একটি ল্যান্ডার ও একটি রোভার নামাবে। মিশনটি আগেই পাঠানোর কথা ছিল। তবে শীঘ্রই তা ঘটতে যাচ্ছে। ভারত একটি রোবোটিক মিশন পাঠানোর বিষয়ে জাপানের মহাকাশ সংস্থা জাক্সার সঙ্গেও কাজ করছে। চন্দ্রাভিযানের পরিকল্পনা রাশিয়ারও আছে। লুনা-২৫ দক্ষিণ মেরুতে পাঠানোর কথা ২০২১ সালে। চলতি দশকের মধ্যে আরও ৬টি লুনা মিশন চাঁদে পাঠানো হবে, যার মধ্যে কোনটি চাঁদে নামবে, কোনটি চাঁদ প্রদক্ষিণ করবে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ শুধু এই কারণেই যে, এর প্রতি মানুষের কৌতূহল আছে তা নয়। চাঁদ সৌরজগতের অতীত ইতিহাসের একটি জাদুঘরও বটে। চাঁদের বুকে ছড়িয়ে আছে এমন সব পাথর বা শিলারাশি, যা পৃথিবীতে সংরক্ষিত যে কোন কিছুর চাইতেও পুরনো। বহুকাল আগে পৃথিবীর সঙ্গে একাধিক গ্রহাণুর সংঘর্ষে এসব পাথর বা শিলারাশি মহাকাশের বুকে উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল। সেগুলোর কিছু চাঁদের বুকেও পড়েছিল। সূর্যের ইতিহাস, ৪৬০ কোটি বছর আগে সৌরজগৎ গঠিত হওয়ার পর থেকে মহাকাশের মধ্য দিয়ে যাত্রার সময় এটি যে মহাজাগতিক পরিবেশের সম্মুখীন হয়েছিল তার সূত্রাবলীও চাঁদ ধারণ করে থাকবে। তাছাড়া সৌরজগতের প্রথমদিকে প্রচুর পরিমাণে এমন বিশাল বিশাল বস্তুর অস্তিত্ব ছিল যে, সেগুলোর আঘাতে পৃথিবীতে কিংবা অন্যত্র প্রাণের আবির্ভাব ঘটে থাকতে পারে। সেই বস্তুগুলো সম্পর্কেও আমাদের ধারণা মিলতে পারে চাঁদের বুকে বয়ে যাওয়া সূত্র থেকে। যাই হোক, যে চন্দ্রপল্লীর কথা প্রথমদিকে বলা হয়েছে সে ব্যাপারে বেসরকারী সংস্থাগুলোরও আগ্রহের অভাব নেই। যেমন ইলন মাক্সের স্পেসএক্স ও জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন। এই দুই বিলিয়নিয়ারের বিশ্বাস চন্দ্রপল্লী বাস্তবে রূপ নেবে। স্পেসএক্স ইতোমধ্যে চাঁদে পর্যটনের জন্য চুক্তি করেছে। সংস্থাটি স্টারশিপ নামে একটি নভোযান তৈরি করছে, যা ২০২৩ সালের প্রথমভাগ নাগাদ চাঁদকে একবার ঘুরে আসার উপযোগী হবে। জাপানের সর্ববৃহৎ অনলাইন ক্লোথিং রিটেইলার জোজো টাউনের প্রতিষ্ঠাতা ইউসাকু মাইজাওয়া তার সঙ্গে একদল শিল্পীকে চন্দ্র ভ্রমণে নিয়ে যেতে চান এই স্টারশিপে করে। তার এই প্রকল্পের তিনি নাম দিয়েছেন ‘ডিয়ার মুন’। এদিকে ব্লু অরিজিন তার ব্লু মুন লুনার ল্যান্ডারের প্রতিরূপ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। কোম্পানি দাবি করে এর মাধ্যমে সাড়ে তিন টনেরও বেশি মালপত্র চাঁদের বুকে নামানো যাবে। এসব কথা মনে রেখেই ড. জুবরিনকে তার চন্দ্রঘাঁটি নির্মাণে সাহায্য করতে হবে। তবে এই ঘাঁটিতে প্রথম যে চন্দ্রমিশনটি হওয়ার কথা সেটি হবে আর্টেসিসের লুনার শাটল। এ দুটি বিশাল বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানও চন্দ্রপল্লীর বাণিজ্যিক দিকে জড়িত। তার মধ্যে একটি হচ্ছে পিটসবার্গের প্রতিষ্ঠান এস্ট্রোবোটিক। এটি ‘পেরিগ্রিন’ নামে মানবহীন একটি লুনার ল্যান্ডার তৈরি করছে। এটি মেক্সিকান মহাকাশ সংস্থার প্রথম চন্দ্রযান বহন করবে। নাসা তার কমার্শিয়াল লুনার পেলোড সার্ভিস কর্মসূচীর অংশ হিসেবে যে তিনটি কোম্পানিকে ঠিকাদারি দিয়েছে এস্ট্রোবোটিক তার অন্যতম। অন্য দুই কোম্পানি হলো টেক্সাসের হিউস্টনের ইনটুইটিভ মেশিনস এবং নিউজার্সির এডিসনের অরবিটবেয়ন্ড। নাসা এই দুই কোম্পানিকে চন্দ্রপৃষ্ঠে জরিপ করে দেখতে বলেছে কোন্ কোন্ স্থান ঘাঁটি নির্মাণের উপযোগী হতে পারে। ড. জুবরিনের পরিকল্পনা মতো চন্দ্রপল্লী যদি নাও গড়ে ওঠে তারপরও কয়েক দশকের মধ্যে চাঁদে স্থায়ী মানব ঘাঁটি গড়ে ওঠার জোর সম্ভাবনা আছে। সেখানে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও পর্যটক ঘনঘন যাওয়া-আসা করবে। এইভাবে চাঁদের সেই স্থানটা আজকের এন্টার্কটিকার মতো হয়ে দাঁড়াবে, যেখানে যাওয়া কঠিন হলেও টাকা-পয়সা ও সরকারী সহায়তা থাকলে অসম্ভব নয়। নতুন দিগন্ত অন্বেষায় নিয়োজিত অনেকের কাছে এন্টার্কটিকা যেমন যথেষ্ট নয়, তেমনি এসব চন্দ্রপল্লীর বাসিন্দার কারও কারও কাছে তখন মনে হবে না এসব পল্লীতে অবস্থান স্রেফ ধৈর্য, মানসিক অবস্থা ও প্রযুক্তির পরীক্ষা মাত্র, যার লক্ষ্য সুদূর মঙ্গলগ্রহে মানুষের বসবাসের উপযোগী ক্ষুদ্র পল্লী গড়ে তোলা। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×