ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ৫ নভেম্বর ২০১৯

ঢাকার দিনরাত

কিছুদিন আগেও মনে হচ্ছিল হেমন্ত এসেছে, এবার বুঝি হিমহিম বাতাস বয়ে যাবে, প্যাঁচপেঁচে গরম থেকে রাজধানীবাসীর মুক্তি মিলবে। ঘন ঘন বৃষ্টিও আশা জাগাচ্ছিল। কিন্তু ক’দিন বাদে আবহাওয়া পেছনের দিকে যাত্রা করেছে। আবারও গরম পড়তে শুরু করেছে। দিনের বেলা রোদের এমন তেজ থাকছে যে মনে হচ্ছে এখন বুঝি চৈত্র মাস। বোমা বিস্ফোরণে শিশুদেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার মতোই খুনের দায় এসে পড়েছে আবারও ঢাকা মহানগরীর ওপর। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে মিরপুরের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা মর্মান্তিক। একটি ভ্যানগাড়িতে করে এক ব্যক্তি মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে গ্যাস বেলুন বিক্রি করতেন। বুধবার বিকেলে রূপনগর ১১ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় বস্তির সামনে বেলুন বিক্রি করতে আসেন তিনি। তাকে দেখামাত্রই বস্তির শিশুরা তাকে ঘিরে ধরে। এ সময় সিলিন্ডারে পাউডার জাতীয় কিছু একটা ভরছিলেন ওই বেলুন বিক্রেতা। এর পর পরই হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে আশপাশে থাকা ১০-১২ জন প্রায় ১৫ ফুটের মতো ছিটকে পড়েন। বিস্ফোরণের পর পরই ঘটনাস্থলে চার শিশুর ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া যায়। পেটে আঘাত পাওয়া আরেক শিশু দৌড়ে সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরই সে লুটিয়ে পড়ে। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। কী মর্মান্তিক! এরই মাঝে বিশ্ব শহর দিবস বা ওয়ার্ল্ড সিটিজ ডে পেরিয়ে এলাম। এ নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। শহরের দুর্দশা নিয়ে স্যাটায়ার করা যেত। রাগ-ক্ষোভ-অনুরাগও প্রকাশ করা যেতে পারত। দিবসটি স্মরণে মনে মনে চোখ বুজে শহরটার চাঁদির ওপর হেলিকপ্টারে উঠে একবার নিচের দিকে তাকালে মন্দ লাগার কথা নয়। দেখতে শহরটা বেশ অপরূপ হয়ে উঠেছে যদি খুব খতিয়ে না দেখি। উড়াল সড়কের পাশাপাশি উড়াল রেলের কাজ চলছে মহাবিক্রমে। শহরের গতি বাড়বে এতে একদিন। কিন্তু নগরবাসীর জন্য চাই ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা। সেক্ষেত্রে আমরা কোথায় রয়েছি? রাজধানীর সড়ক থাকুক নিরাপদ বছরের শুরুতে রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ভাল কিছু উদ্যোগ গ্রহণের তথ্য নোট করে রেখেছিলাম। এই শুক্রবার থেকে নতুন সড়ক পরিবহন আইন চালুর সময়ে সেই নোটগুলোয় আবার চোখ ফেরানো যাক। এবার ঢাকা মহানগরের ট্রাফিক-সংক্রান্ত ভৌত অবকাঠামোর ওপরও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে নগরের বেদখল হওয়া রাস্তা উদ্ধার, রাইড শেয়ারিং এ্যাপে চলা যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ফার্মগেট থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত রাস্তাটিকে গাড়ি চলাচলের জন্য পুরোপুরি খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাস্তাটির ওপরে ট্রাক রেখে স্ট্যান্ড বানানো হয়েছিল। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ওই রাস্তা থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করেছিলেন। মডেল করিডর হিসেবে ঘোষিত বিমানবন্দর থেকে শহীদ জাহাঙ্গীর গেট, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, কদম ফোয়ারা, পুরনো হাইকোর্ট হয়ে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ভিআইপি সড়কের সংযোগগুলোয় দূর নিয়ন্ত্রিত ও স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি কার্যকর করা হবে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ২৯টি পয়েন্টে চেকপোস্টের কার্যক্রম চলবে, গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি পদচারী-সেতু ব্যবহারে পথচারীদের উদ্বুদ্ধকরণে পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবেন। স্টপেজ ছাড়া অন্য সময় চলন্ত বাসের দরজা বন্ধ থাকবে। স্টপেজ ছাড়া যত্রতত্র বাস থামলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাঁ পাশের লেন ঘেঁষে নির্ধারিত স্টপেজেই যাত্রী ওঠানামা করাতে হবে। এখন ঢাকাবাসী পাঠকই বিবেচনা করবেন জানুয়ারি খেবে নবেম্বরÑ এই সময়ের মাঝে কতটা এগুলাম আমরা। তবে নতুন সড়ক আইন যথাযথভাবে কার্যকর করা গেলে অবস্থার লক্ষ্যযোগ্য পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। এই কলামের সঙ্গে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জরিমানার তুলনামূলক একটি তালিকা যুক্ত করছি। ঢাকাবাসী পাঠক সহজেই বুঝবেন নতুন আইন কতটা নিরাপদ সড়কবান্ধব। এই জরিমানার তালিকার বেশি বেশি প্রচারও দরকার নতুন আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে। আমরা যাই বলি না কেন, সড়কে কোন যানবাহন নামানোর আগে প্রাথমিক শর্ত থাকে। যানটি যথাযথভাবে নিবন্ধিত কিনা, তার ফিটনেস সনদ আছে কিনা সেটি সবার আগে দেখার বিষয়। এর পরই রয়েছে চালকের সুস্থতা ও সনদের বিষয়টি। গণপরিবহনের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। তাতে বহু মানুষ আরোহণ করে থাকেন। প্রত্যেকেরই জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা চাই। সড়কে আইন না মেনে চললে একটি মোটরযান ভয়ঙ্কর দানব ও হন্তারক হয়ে উঠতে পারে তার হাজার হাজার দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের সামনে। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে আইন ভাঙ্গার জন্য শাস্তি ও জরিমানা যথেষ্ট বাড়ানো হয়েছে। এতে কেবল চালক-চালকের সহকারী বা যানবাহনের মালিকই নয়, পথচারীর জন্যও দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলে সতুন আইনে দায়ী চালকের সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর কারাদ-। আসামির জামিন হবে না। পুরনো আইনে জামিনের সুযোগ ছিল। এটি চালকের ওপর ইতিবাচক প্রভাব রাখবে এবং তাকে বেপরোয়াভাব বাদ দিয়ে দায়িত্বশীল হতে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়। চালক সতর্ক থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে। আর নতুন আইন এই সতর্কতা বাড়ানোয় প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে সাধারণভাবে আশা করা যায়। সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়ার ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ সড়ক পরিবহনে বিশৃঙ্খলা, দায়িত্বহীনতা ও অপরাধ প্রতিরোধের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নে বাধাদানের ইতিহাস। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের শুরুতে দায়িত্ব নেয়ার পর একটি যুগোপযোগী সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ শুরু করে। একের পর এক আইনের খসড়া তৈরি করা হয়, কিন্তু সড়ক পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর প্রবল বাধার মুখে আইনটি চূড়ান্ত করার উদ্যোগ বার বার স্থগিত হয়ে যায়। অবশেষে ১ নবেম্বর থেকে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কার্যকর হয়ে গেছে। উপসংহারে কয়েকটি কথা না বললেই নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো সব পক্ষের দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতাই পারে সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে। অহেতুক সড়ক দুর্ঘটনা শূন্য পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য চাই সব পক্ষের সহনশীলতা, সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা। কোন চালক যদি ভাবেন যে তিনি সাবধান না হলে এই যাত্রাটিই হতে পারে তার অন্তিমযাত্রা, তবেই কেবল তিনি সতর্ক থাকবেন। সেই শুভবোধটি জাগিয়ে তোলার জন্য চাই কার্যকর সামাজিক আন্দোলন। কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলা ঢাকা লিট ফেস্ট শুরু হচ্ছে এ সপ্তাহেই। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কবি শামীম রেজা যোগাযোগ করে চমৎকার প্রস্তাব দিলেন। ত্রিশজন কবি কবিতা শোনাবেন একটি অধিবেশনে, সেটির সঞ্চালনার দায়িত্ব আমাকে দিতে চান। হিসাব করে দেখলাম যে সময়ে ওই কবিতা পাঠ হবে সেই মুহূর্তে আমি থাকব কলকাতার মোহরকুঞ্জে, বাংলাদেশ বইমেলায়। অগত্যা অপারগতা প্রকাশ করতে হলো। ঢাকার বহু লেখক ইতোমধ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। গেছেন কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলায়। এই মেলা উপলক্ষে আমাদের অনেক প্রকাশকই নতুন বই প্রকাশ করে থাকেন। আমার নির্বাচিত কবিতার সংগ্রহ বের করছে ধ্রুবপদ। এর প্রকাশক ফিরোজ সাহেব নিজেও লেখক, যদিও তাঁর নিজের বই নয়, তিনি বের করছেন কামাল রাহমান ও হামিদ কায়সারের দুটি বই, আমারটা তো আছেই। এই মেলায় আমার কখনও যাওয়া হয়নি, তাই ভাবলাম ধ্রুবপদের প্রকাশক-লেখকদের সঙ্গে কয়েকদিনের জন্য ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। সারা বছরে একবারও কলকাতায় যাওয়া হয়নি। পাঠক হিসেবে আমাদের সুবিধা রয়েছে ঢাকায় বসে ভারতের সদ্য প্রকাশিত বাংলা বইগুলো কেনার। আমাদের পুস্তক বিক্রেতারা যথেষ্ট তৎপর। কিন্তু কলকাতায় বাংলাদেশের বই তেমন একটা পাওয়াই যায় না। অথচ ভারতীয় বাঙালি পাঠকদেও যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশের লেখক এবং গ্রন্থজগত সম্পর্কে বাংলাদেশের বই সম্পর্কে যেসব পাঠকের আগ্রহ রয়েছে তারা এই ‘বাংলাদেশ মেলা’-র প্রতীক্ষায় থাকেন সারা বছর। কেমন হচ্ছে মেলা খোঁজ নিতে চেষ্টা করি। উদ্বোধনের সংবাদ পড়ে ভাল লাগে। কাগজ লিখেছে বিস্তারিত। পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করা যাক। বইমেলার উদ্বোধনী দিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের লেখা বই ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’-এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। ৯ বছরে পা দেয়া এই মেলা শেষ হবে ১০ নবেম্বর। গত দুই বছরের মতো এবারের মেলাও বসেছে কলকাতার রবীন্দ্রসদনের কাছে ঐতিহ্যবাহী মোহরকুঞ্জ প্রাঙ্গণে। বাংলাদেশে প্রকাশিত বিভিন্ন বই নিয়ে প্রতিবছর এই বইমেলার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের বইকে কলকাতার বইপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরা এবং দুই বাংলার সাংস্কৃতিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করার লক্ষ্যে আয়োজন করা হয় এই মেলা। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন এবং বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সম্মিলিত উদ্যোগে এই বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় প্রতিদিন থাকছে বিষয়ভিত্তিক সেমিনার, কবিতা পাঠ এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিদিন বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে। তবে শনি ও রবিবার মেলা চলবে ২টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। এবারের বইমেলায় বইপ্রেমীদের জন্য বাংলাদেশের ৮০টি সরকারী ও বেসরকারী প্রকাশনা সংস্থার প্রায় ৩০ হাজার বই থাকছে। ৩ নবেম্বর ২০১৯ [email protected]
×