ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মায়া কান্না কেন ॥ খুনীদের জন্য এত

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ৪ নভেম্বর ২০১৯

মায়া কান্না কেন ॥ খুনীদের জন্য  এত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কারাবন্দী খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ না করে বলেছেন, খুনীদের নিয়ে এত মায়াকান্না কেন? জেনারেল জিয়া একজন খুনী। তার স্ত্রী (খালেদা জিয়া) ও ছেলেও (তারেক রহমান) তাই। তারা (খালেদা জিয়া) শত শত মানুষকে হত্যা করেছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে, বিরোধী দলে থাকতেও অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়ে শত শত মানুষকে বীভৎস কায়দায় হত্যা করেছে, এতিমের টাকা আত্মসাত করার দায়ে দন্ডিত হয়ে যিনি এখন কারাগারে, তাদের নিয়ে এত মায়াকান্না কেন? চিকিৎসা নিয়ে এত কথা কেন? ভবিষ্যতে ১৫ আগস্ট এবং ৩ নবেম্বরের জেল হত্যাকান্ডের নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারী ও মদদদাতাদেরও বিচার হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ রহস্য উদঘাটন হবে এবং ষড়যন্ত্রকারীরাও ধরা পড়বে। বঙ্গবন্ধুর খুনী, ৩ নবেম্বর জেলহত্যাকান্ড এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিচারের রায় আমরা কার্যকর করেছি। এদের যারা দোসর বা ষড়যন্ত্রকারী, হয়তো আমরা আজকে করে যেতে পারলাম না, আমরা করার চেষ্টা করব বা আগামী যারা আসবে তারা করবে। কারণ ইতিহাস কোনদিন মুছে ফেলা যায় না। তখন এই ষড়যন্ত্রকারীরাও এক সময় ধরা পড়বে। তাদের সে রহস্য উদঘাটন অবশ্যই হবে। কেউ না কেউ এটা করবে, এটা আসবে, এটা হবেই। কেউ না কেউ এসে এদের বিচার করবে, কারণ ইতিহাস কাউকে কোনদিন ক্ষমা করে না। রবিবার রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করে আরও বলেন, একটি দলের (বিএনপি) নেত্রী যিনি এতিমের টাকা আত্মসাত করে দন্ডিত হয়ে কারাগারে রয়েছেন। বিএনপিতে কোন নেতা পেল না, যাকে (তারেক রহমান) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন করা হলো সেও দুর্নীতির মামলায় দন্ডিত পলাতক আসামি! বিএনপি একজন ভাল লোককে পেল না দলের দায়িত্ব দিতে। তাই যারা এখন বিএনপি করেন, এত মায়াকান্না করেন- আসলে তাদের মেরুদন্ড ও আত্মসম্মানবোধ আছে কিনা সন্দেহ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, কথাসাহিত্যিক-সাংবাদিক আনিসুল হক, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হক চৌধুরী নওফেল, কেন্দ্রীয় সদস্য আনোয়ার হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম রহমতুল্লাহ এমপি ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনের পরিচালনায় আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আলোচনার সভার শুরুতেই ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বর হত্যাকা-ের শিকার চার জাতীয় নেতার স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে চলমান সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেইনি, দেব না। দেশের মানুষ যেন সুন্দর ও উন্নত জীবন পায় সেজন্য কাজ করে যাচ্ছি। যারা যে স্বপ্ন নিয়ে এদেশকে স্বাধীন করেছেন, তাদের স্বপ্ন কখনও ব্যর্থ হতে পারে না। ভবিষ্যতেও হবে না। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দোসর ও মদদদাতাদের বাংলার মাটিতে স্থান হবে না। আর যেন খুনীদের দোসররা কোনদিন ক্ষমতায় আসতে না পারে, দেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, সেভাবেই দেশের মানুষকে চিন্তা করতে হবে, সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতার পাঁচ বছরের দুঃশাসন এবং পরবর্তীতে অগ্নিসন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী যেভাবে আমাদের দেশের মানুষকে হত্যা-নির্যাতন চালিয়েছে, ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়ারা একইভাবে দেশের মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করেছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করেছে, সারাদেশে একইসঙ্গে ৬৩ জেলার ৫শ’টি স্থানে বোমা হামলা করেছে। নৌকায় ভোট দেয়ার অপরাধে ৬ বছরের শিশুসহ অসংখ্য নারীকে গণধর্ষণ করেছে। ক্ষমতায় থাকতে এমন কোন অপকর্ম নেই যা তারা করেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চিহ্নিত রাজাকার, আলবদর প্রধানদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে লাখো শহীদের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন এই খালেদা জিয়া। ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনী পদচ্যুত খায়রুজ্জামানকে এনে পদোন্নতি দিয়ে ফরেন সার্ভিসে চাকরি দিয়েছিলেন। বিদেশে থাকা অবস্থায় মৃত খুনী পাশাকেও পদোন্নতি দিয়ে তার অবসরের সব সুযোগ-সুবিধাও দিয়েছিলেন তিনি। এ ধরনের জঘন্য অন্যায়-অবিচারও তিনি করে গেছেন। তিনি বলেন, ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরও তারা (বিএনপি-জামায়াত) থেমে থাকেনি। অসহযোগ আন্দোলনের নামে গুলশানের অফিসে বসে থেকে নির্দেশ দিয়ে সারাদেশে অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়েছেন খালেদা জিয়া। জীবন্ত মানুষকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ সর্বত্রই নাশকতা চালিয়েছে। খালেদা জিয়ার ডাকা সেই অসহযোগ, হরতাল ও অবরোধ এখনও কিন্তু বহাল রয়েছে। তাদের এত অন্যায়, জীবন্ত শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা আল্লাহও সহ্য করেননি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের কিছু মানুষ আছে তারা সহজেই অতীতের ঘটনা অল্প সময়েই ভুলে যান। এখন অনেকে কারাবন্দী দন্ডিত একজনকে নিয়ে মায়াকান্না করেন। কিন্তু তাদের কী ৭৫ পরবর্তী হত্যাকান্ডের শিকার পরিবার, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যার পর তাদের পরিবার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত ও পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা এবং অগ্নিসন্ত্রাসে বীভৎস কায়দায় হত্যার শিকার পরিবারের আর্তনাদের কথা কী চোখে পড়ে না? যারা এসব ঘটিয়েছেন, এতিমের টাকা পর্যন্ত আত্মসাত করেছেন, তাদের নিয়ে এত মায়াকান্না ও চিকিৎসা নিয়ে এত কথা কেন বুঝি না। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের জারি-জুরি জেনে গেছে। ওই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত মাত্র ২৯টি সিট পেয়েছিল। বিএনপি নেত্রীর নামে আরও অনেক দুর্নীতির মামলা রয়েছে। তিনি আদালতে যান না। কারণ উনি (খালেদা জিয়া) ভাল করেই জানেন আদালতে গেলে তার দুর্নীতির প্রমাণ হয়ে যাবে। কারণ তাদের দুর্নীতি আমরা নয়, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই খুঁজে বের করেছে, তার পুত্রের পাচারকৃত কিছু অর্থ আমরা ফেরতও এনেছি। খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে বিএনপি নেতাসহ কিছু মানুষের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, খালেদা জিয়া সেনা প্রধানের স্ত্রী হিসেবে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমানও সেনাপ্রধান ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া তাকে সিএমএইচএ চিকিৎসা পর্যন্ত নিতে দেননি। আমরা যে পদোন্নতি দিয়েছিলাম, সেটিও কেড়ে নিয়েছিলেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত সাবেক এই সেনাপ্রধানকে স্ট্রেচারে করে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। একজন সেনাপ্রধানের স্ত্রী হলেও আরেক সেনাপ্রধানকে চিকিৎসাও নিতে দেননি। এখন তার চিকিৎসা নিয়ে এত কথা কেন? কোন মুখে তারা কথা বলেন? প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা তুলে ধরে বলেন, দেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, এত দ্রুত দেশের উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব? জবাবে আমরা একটাই বক্তব্যে, যদি আন্তরিকতা থাকে, দেশ ও জনগণের প্রতি দরদ থাকে, কর্তব্যবোধ থাকে- তবেই অসাধ্যকে সাধন করা যায়। বাংলাদেশ সারাবিশ্বের সামনে এখন উন্নয়নের বিস্ময়। সেই মর্যাদা বাংলাদেশ পেয়েছে। এই মর্যাদা আমাদের ধরে রেখে দেশকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। বিএনপিকে উদ্দেশে করে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে যারা দল গঠন করে, সেই সামরিক স্বৈরাচারের হাতে গড়া দল ক্ষমতায় গেলে শুধু নিজেদের ভাগ্য গড়েছে, নিজেরা বিলাস-ব্যসনে মত্ত থেকেছে, দেশ ও জনগণের কোন উন্নতি তারা করেনি। এরা ক্ষমতায় থেকে নিজেদের আখের গুছিয়েছে, আর দেশের মানুষকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। ঋণখেলাপী, নির্বাচনের নামে প্রহসনসহ যত অপকর্ম তা খুনী জিয়াসহ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরশাসকরা করে গেছে। অবৈধ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে তারা একটি এলিট শ্রেণী তৈরি করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে বেইমান-মোনাফেক খুনী মোশতাকের সঙ্গে জিয়াও অতপ্রোতভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল বলেই খুনী মোশতাক জিয়াকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিল। মোশতাকের পতনের পর জেনারেল জিয়া একাধারে সামরিক শাসক এবং রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমকে হঠিয়ে অবৈধভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এই জিয়াই ক্ষমতায় এসে সংসদে ইনডেমনিটিকে আইনে পরিণত করেছিল। শহীদ জাতীয় চার নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারাগার হচ্ছে একটি সুরক্ষিত জায়গায়। সেই কারাগারে বন্দীদের হত্যা করার মতো জঘন্য ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। খুনী খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কারাগারে অস্ত্র নিয়ে ঢোকা যায় না। কিন্তু, তারা অস্ত্র নিয়ে ঢুকেছিল। প্রথমে জেল কর্তৃপক্ষ বাধা দেয়। তখন বঙ্গভবন থেকে বলা হয়েছিল, আলোচনা করতে যাচ্ছে। যেভাবে ঢুকতে চায়, সেভাবেই ঢুকতে দেয়া হোক। প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুনী মোশতাকের পতন যখনই অনিবার্য হয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের একটি প্লেনে করে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হলো। প্রথমে খুনীদের ব্যাঙ্ককে নিয়ে যায়। সেখানে বসে তাদের পাসপোর্ট দেয়া হয়। তাদের ভিসার ব্যবস্থা করে কোন দেশে যাবে সেটাও ঠিক করে দেয়া হয়। এর সঙ্গে কারা জড়িত, সেটাও কিন্তু ইতিহাসে আছে। একদিন তাদেরও বিচার হবে।
×