ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রারম্ভিক মূল্যায়নে সিপিডি

প্রবৃদ্ধি নিয়ে এবারও প্রশ্ন সিপিডির

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ৪ নভেম্বর ২০১৯

 প্রবৃদ্ধি নিয়ে এবারও প্রশ্ন সিপিডির

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক নিম্নমুখী হলেও দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ব্যাংকিং খাত, পুঁজিবাজার, রফতানি প্রবৃদ্ধি এবং ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ সন্তোষজনক হারে বৃদ্ধি না পেলেও সামষ্টিক প্রবৃদ্ধি কিভাবে হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, প্রবৃদ্ধি এখন সুতাকাটা ঘুড়ির মতো। বাস্তবতার সঙ্গে সুতার যে সংযোগ থাকে সেটা এখানে নেই। যে সব তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হচ্ছে তা জনগণের সামনে তুলে ধরার দাবি জানিয়েছে সিপিডি। তাহলে যেসব পরিমিতির ওপর নির্ভর করে অর্থনীতির কৌশল নির্ধারণ হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে বলে মনে করে সংস্থাটি। রবিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়নে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বাধীন পর্যালোচনা, ২০১৯-২০ অর্থবছর প্রারম্ভিক মূল্যায়ন শীর্ষক সেমিনারে সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। সেমিনারে বাংলাদেশের রাজস্ব খাত, ব্যাংক, পুঁজিবাজার এবং বৈদেশিক লেনদেনের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে চারটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবদনগুলো তুলে ধরেন যথাক্রমে সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, খেলাপী ঋণ আদায় হলে তার মাধ্যমে আলাদাভাবে বাংলাদেশের চলমান অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল। যেমন, তিনটি পদ্মা সেতু অথবা তিনটি পদ্মা রেলওয়ে ব্রিজ, তিনটি মাতারবাড়ি পাওয়ার প্লান্ট, পাঁচটি মেট্রোরেল অথবা সাতটি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। গবেষণায় আরও তুলে ধরা হয়, ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতেও খেলাপী ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে মোট খেলাপী ঋণের ৪২ শতাংশ ছিল বেসরকারী ব্যাংকের। কিন্তু ২০১৮-১৯ এসে বেসরকারী ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ শতাংশে। ব্যাংকিং খাতের মূলধন সম্পর্কে বলা হয়, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মূলধনের অপর্যাপ্ততা একটি বড় সমস্যা। ঋণ বিতরণের তুলনায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এ কারণে দিন দিন বেড়েছে চলেছে কল মানি (আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার) থেকে দৈনিক ভিত্তিতে টাকা ধার করার প্রবণতা। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, কিছু বিশেষ ব্যাংকে সরকারী প্রণোদনার মাধ্যমে আমানত বৃদ্ধি করা হচ্ছে যা আর্থিক খাতের জন্য মোটেও সুখকর নয়। ২০০৯-১৭ সাল পর্যাপ্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংকে ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা তারল্য সরবরাহ করেছে সরকার। এ কারণে খারাপ ব্যাংকগুলো আরও উৎসাহিত হবে বলে ধারণা সিপিডির। ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া আগের তুলনায় অনেকটাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পর্যাপ্ত তথ্য না পাওয়ায় সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বিচার ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও সক্রিয় করার পরামর্শ দিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। যা ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। শক্ত হাতে খেলাপী ঋণ দমন করা গেলে আমাদের দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি হতে পারত। এ বিষয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, প্রবৃদ্ধির আলোচনায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হারে ২৩ শতাংশ মধ্যেই ওঠানামা করছে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ। অথচ প্রবৃদ্ধি ৮ থেকে ১০, ৬ থেকে ৭ এবং ৭ থেকে ৮ এ চলে গেল। বাড়তি বিনিয়োগ ব্যতিরেকে এই প্রবৃদ্ধি বাড়ার কারণটা কী? আর ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ সবচেয়ে কম, অথচ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের ক্ষেত্রে তারল্য সমস্যা রয়েছে, অথচ উনারা বলছেন প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। তিনি বলেন, দেশে ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবাহ সর্বকালের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে কম, অথচ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সেই টাকা ফেরত দিচ্ছে না, ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কট রয়েছে। ব্যক্তি শ্রেণী বলছে, তারা ব্যবসায় লাভ করতে পারছেন না। তারপরেও প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, এটা কিভাবে সম্ভব হচ্ছে? তিনি বলেন, সরকার আর্থিক খাত সংস্কার না করে প্রণোদনার পথে যাচ্ছে। কিন্তু এক সময় প্রণোদনা দেয়ার ক্ষমতাও সরকারের কমে যাবে। কারণ রাজস্ব আয় কমে গেছে, দেশে এত প্রবৃদ্ধি হলো তাহলে আয় গেল কোথায়, বর্ধিত আয়ের ট্যাক্স কোথায়? হিসাব হলো, রাজস্ব আয় যদি কমে যায়, বাজেট ঘাটতি যদি বেড়ে যায় ব্যাংকিং খাতে যদি বিপর্যয় নেমে আসে, তাহলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে কিভাবে? তিনি বলেন, অর্থনীতি সংস্কারের বিপরীতে তথাকথিত প্রণোদনা ভিত্তিক অর্থনীতি টেকসই হওয়া মুশকিল। দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনীতির পুরোটাই এখন কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থ বাজার, ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত না দেয়ার অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে কিভাবে ১০ টাকার জিনিস হাজার টাকায় কেনা যায় সেই অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন খাতে যে ঘাটতি রয়েছে, সরকার সে সব ঘাটতি মোকাবেলায় কখনও প্রণোদনা দিয়ে, না হয় টাকার সঞ্চার করে কিংবা কর রেয়াদ দিচ্ছে। অর্থাৎ অর্থনীতির ভেতরে এক ধরনের প্রণোদনার আসক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতার বিপরীতে এই ধরনের আর্থিক প্রণোদনা আর্থিক আসক্তি তৈরি হচ্ছে। এর বড় কারণ হলো সরকার আর্থিক খাতে কোন সংস্কার করছে না সেজন্য ব্যক্তি খাত ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই ধরনের ব্যয় করছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার জনগণের কাছ সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল গত তিন মাসে তা বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সংস্কারের অভাবে যারা লাভবান হয়েছেন, তারাই সংস্কার করতে দিচ্ছেন না। অর্থাৎ যারা কর না দিয়ে, টাকা বিদেশে পাচার করে এবং ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না, পুঁজিবাজারের টাকা নিয়ে ফটকাবাজি করেন, সরকারী প্রকল্পের টাকা নিয়ে অতিমূল্যায়িত করছেন, তারা সংস্কারের শত্রু হিসেবে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছেন। এই রাজনৈতিক অর্থনীতির দুষ্টচক্র যদি ভাঙ্গতে না পারে তাহলে অর্থনীতিতে কোন সমাধান আসবে না। আমরা চাই সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করুক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে তথ্য উপাত্তের লব্ধতা ক্রমান্বয়ে দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। যে সব তথ্য উপাত্ত আমরা পাচ্ছি তা চলমান সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারপরেও যেসব তথ্য উপাত্ত আসছে তার নিভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমানে চলমান ক্যাসিনো অভিযান সম্পর্কে দেবপ্রিয় বলেন, অভিযানে প্রাপ্ত টাকা এবং আর্থিক খাতের চুরি যাওয়া টাকাকে আমি ভিন্নভাবে দেখতে চাই না। এইগুলো পুঁজিবাজার লোপাট করা টাকা, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়া টাকা এবং বিদেশে পাচার করার উদ্দেশ্যে লুকিয়ে রাখা টাকা, ট্যাক্স ফাঁকির টাকা। আর্থিক খাতের এসব সমস্যা সমাধান করতে বিদ্যমান ফৌজদারি আইনের মাধ্যমে নয় বরং অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ বেছে নেয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
×