ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রেসিডেন্সিয়াল মডেলে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে ছাত্রের মৃত্যুতে বিক্ষোভ

প্রকাশিত: ১০:৪০, ৩ নভেম্বর ২০১৯

রেসিডেন্সিয়াল মডেলে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে ছাত্রের মৃত্যুতে  বিক্ষোভ

আজাদ সুলায়মান ॥ বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকান্ডের রেশ না কাটতেই আরেক আবরারের অপমৃত্যুতে ফুঁসে উঠছে রাজধানীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ক্যাম্পাস। শুক্রবার বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও শান্ত হচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। সহপাঠীরা এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে অব্যাহত রেখেছে বিক্ষোভ কর্মসূচী। একটি ম্যাগাজিনের অনুষ্ঠানে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে নাইমুল আবরার রাহাতের (১৫) মৃত্যুতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে ফাঁস হচ্ছে অুনষ্ঠান আয়োজকদের চরম অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বহীনতা ও চিকিৎসায় গাফিলতির মতো নানা অভিযোগ। শনিবার বিকেলে ফেসবুকে একটা ইভেন্ট খুলে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবি ঘোষণা করে। এসব দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচী দেয়া হবে বলে জানানো হয়। জানা গেছে, শুক্রবার বিকেলে কলেজ ক্যাম্পাসে ওই সাময়িকীর একটি অনুষ্ঠান চলাকালে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্র নাইমুল আবরার প্রাণ হারালেও কর্তৃপক্ষ এখনও আয়োজকদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নেয়নি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণেই আবরারকে মারা যেতে হয়েছে। শনিবার সকালে কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের পাশাপাশি অনুষ্ঠানে সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা চিত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দিতে আয়োজক কর্তৃপক্ষ দাবি করে। তখন কলেজের অধ্যক্ষ এসে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের বিষয়ে আশ্বস্ত করলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শান্ত হন। কিন্তু ফের তারা অশান্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে আবরারকে ঘটনাস্থলের কয়েক গজের আওতায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে না নিয়ে মহাখালীর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মানতে পারছে না। একজন শিক্ষার্থীকে বিক্ষুব্ধ চিত্তে বলতে শোনা যায়, কেন হাতের কাছে হাসপাতাল রেখে মহাখালীর একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো আবরারকে? এটা চরম রহস্যজনক। আগে এটা খুঁজে বের করতে হবে। যদি সঠিক সময়ে তাৎক্ষণিক তাকে নিকটবর্তী সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো তাহলে হয়ত বা তাকে রক্ষা করা যেত। শিক্ষকদের অভিযোগ, ‘কি আনন্দ’ শিরোনামেও ওই অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করা মঞ্চের পেছনে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হন আবরার। আয়োজকরা তাকে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ওই অনুষ্ঠান আয়োজনের অংশীদার ছিল। মূলত হাসপাতালে রোগী পাঠিয়ে আর্থিকভাবে ফায়দা লুটা ও হাসপাতালের ব্যাপক প্রচারের জন্যই আবরারকে কাছের হাসপাতাল রেখেও নেয়া হয় মহাখালীতে। এ সম্পর্কে কলেজটির অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম আহমেদ বলেন, নাইমুল আবরার রাহাতের মৃত্যুর ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তারপর দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে এ ঘটনায় প্রথম আলোর কাছে চার দফা দাবি তুলে ধরেছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ফেসবুকে একটা ইভেন্ট খুলে তারা এসব দাবি জানিয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে তূর্য নামের একজন গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন- চার দফা মানতে হবে। কারণ, একটা ছেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। দুঃখিত মৃত্যু না, তাহসান অর্ণবের সুরের মূর্ছনার ভিড়ে একটা ঠান্ডা মাথায় খুন হয়ে গেছে। পনেরো বছরের একটা বাচ্চা হারিয়ে গেছে, এই জরুরী খবর জানানোর চেয়ে গান চালানোই জরুরী মনে হয়েছে তাদের। একটা মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, কোন বিজ্ঞপ্তি নেই। নামেমাত্র দায়সারা ‘আমরা দুঃখিত’ বলে প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে ভুলে ভরা একটা বিজ্ঞপ্তি দেয়া পর্যন্তই। (এমনকি ইভেন্ট পেজ ও মূল পেজ থেকে দুইবার পোস্ট ডিলিট করে নতুন করে দেয়া, একের পর এক কমেন্ট ডিলিট করা চলছেই।) ১২ ঘণ্টা অপেক্ষার পরেও যখন আনিসুল হক নামক ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায় না, বরং ‘ধাতস্থ হলে বলবো’ উত্তর আসে, তখন বোঝাই যায়, তাদের ধাতস্থ হওয়ার অর্থ ঘটনা ধামাচাপা পড়া। ১২ ঘণ্টা পরেও উত্তর না পাওয়ার পর আমরা উত্তর চাইও না। এবার এসেছি নিজেদের দাবি-দাওয়া জানাতে। কিছু সুস্পষ্ট দাবির জন্য ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। তারপর আমরা পিছু হটার কথা ভাববো, তার আগে পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই। তূর্য বলেন, আমাদের সব দাবি এর মধ্যেই টিভি মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে। তবে সেখানে একটি ভিত্তিহীন কথা বলা হয়েছে, সেটি হলো কলেজ কর্তৃপক্ষ নাকি আমাদের সঙ্গে নেই। তাদের বলতে চাই কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গেই আছেন। আমাদের সম্মানীয় অধ্যক্ষ মহোদয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম ফরহাদ তার সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন আমাদের প্রতি। যেখানে অধ্যক্ষের সম্মতি আছে সেখানে শিক্ষকদের বাধা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। সময় নিউজের করা খবরে এই অংশের সঙ্গে আমরা দ্বিমত প্রকাশ করছি। তারা আমাদের পুরো কার্যক্রমে আমাদের পাশেই আছেন। আমাদের কলেজ কর্তৃপক্ষের এখানে কোন গাফিলতি বা কোন সমস্যা নেই। বরং আমাদের দাবি সম্পূর্ণ কিশোর আলো ও প্রথম আলোর প্রতি, তারা সকলে এই দাবি মেনে নিলে আমরা আমাদের কার্যক্রমের পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। জানা গেছে, কলেজের দিবা শাখার ছাত্র আবরারের বাড়ি নোয়াখালী। ঢাকার আগারগাঁওয়ে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তিনি। পরিবারের আবেদনে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান মোহাম্মদপুর থানার ওসি জিজি বিশ্বাস। এ বিষয়ে কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে কিশোর আলোর অনুষ্ঠান দেখতে এসে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল কলেজের ক্লাস নাইনের ছাত্র নাইমুল আবরার বিদ্যুতায়িত হয়। ওখানেই জরুরী মেডিক্যাল ক্যাম্পে তাকে নেয়া হয়। দুজন এফসিপিএস ডাক্তার দেখেন। তারা তাদের জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে বলেন। এরপরই তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে না নিয়ে দীর্ঘ সময় লাগিয়ে নেয়া হয় মহাখালীতে। তারপর সেখানে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র নাইমুল আবরার শুক্রবার বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছে। নাইমুল আবরার শুক্রবার ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের মাঠে ওই অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিল। বিকেলে মাঠের এক প্রাান্তে দুর্ঘটনাটি ঘটে। ওই মাঠে স্থাপিত জরুরী মেডিক্যাল ক্যাম্পের দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নাইমুলকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে মহাখালীর বেসরকারী ইউনিভার্সেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃৃত ঘোষণা করেন। রাতেই রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের মাঠে জানাজা শেষে নাইমুলের মরদেহ গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ধন্যপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। নাইমুল আবরার দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট। তার বাবা মজিবুর রহমান প্রবাসী। তবে তিনি বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এদিকে নাইমুলের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম ফরহাদ। অধ্যক্ষ জানান, কলেজ কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক নাইমুলের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি হাসপাতালে যান এবং নাইমুলের মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি এই পরিবারকে তার নিজের এবং কিশোর আলোর পরিবার হিসেবে গ্রহণ করার কথা তাদের জানান। তিনি বলেন, নাইমুল আবরারকে চিরকাল স্মরণ করা হবে। এ জাতীয় দুর্ঘটনা কেন ঘটল, তা কঠোরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
×