ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে জোড়া খুন ॥ সন্দেহের তীর নতুন গৃহকর্মীর দিকে

প্রকাশিত: ১০:৩৯, ৩ নভেম্বর ২০১৯

 ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে জোড়া খুন ॥ সন্দেহের তীর নতুন গৃহকর্মীর দিকে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানীর ধানমন্ডির আবাসিক ফ্ল্যাটে শিল্পপতি তারিমের শাশুড়ি আফরোজা বেগম (৬৫) ও কিশোরী গৃহকর্মী দিতিকে (১৫) কয়েকজন মিলে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। পুলিশের সন্দেহের তীর নতুন গৃহকর্মীর দিকে। হত্যার পর সিসিটিভি ফুটেজে ফুটে উঠেছে নতুন গৃহকর্মী বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য পুলিশকে ভাবিয়ে তুলেছে। কারও সহযোগিতা ছাড়া এই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটানো অসম্ভব। ফলে নতুন ওই গৃহকর্মীকে গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলার একাধিক টিম মাঠে নেমেছে। তবে পুলিশ বলছে, টাকা ও সোনার অলঙ্কার চুরি করতেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। বাড়ির ঘনিষ্ঠ লোকজন ছাড়া এমন নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটতে পারে না। খুনের মুখ্য টার্গেট গৃহকর্ত্রী আফরোজা বেগম। ঘটনা দেখে ফেলায় গৃহকর্মী দিতিকেও মিস কিলিংয়ে পড়তে হয়েছে। সন্ধ্যা সাতটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জোড়া খুনের ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি। এদিকে চার সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যালে মর্গে দুই লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। বোর্ড প্রধান ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ড. সোহেল মাহমুদ জানান, দুই নারীর গলায়, বুকে ও পিঠে একাধিক ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল। আর অতিরিক্ত আঘাতজনিত রক্তক্ষরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। তার ধারণা হত্যা মিশনের একাধিক ব্যক্তি জড়িত ছিল। ধানমন্ডি থানার ওসি আবদুল লতিফ জনকণ্ঠকে জানান, বাড়ির নতুন ওই গৃহকর্মীকে ধরতে অভিযান চলছে। বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজে ওই গৃহকর্মীর পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শিল্পপতি তারিমের পিএস বাচ্চু ও বাড়ির ইলেক্ট্রিশিয়ান বেলায়েত ও নিরাপত্তাকর্মীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ওসি জানান, আমরা জানতে পেরেছি, বাচ্চুই নতুন গৃহকর্মীকে নিয়ে আসে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে গৃহকর্মীর ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। তাকে ধরার জন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। দুই মরদেহের ময়নাতদন্ত ও দাফন নিয়ে পরিবারের লোকজন ব্যস্ত। সম্ভবত পরিবারের লোকজন রাতে থানায় এলে মামলা হবে। শুক্রবার রাতে ধানমন্ডি ২৮ নম্বর সড়কের ২১ নম্বর বাসার পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে ক্রিয়েটিভ গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিমের শাশুড়ি আফরোজা বেগম ও গৃহকর্মী দিতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ছয়তলা ওই এ্যাপার্টমেন্টে তারিমের চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচতলা ডি-৪ ফ্ল্যাটে থাকতেন আফরোজা। তারিম অভিযোগ করেন, ওই ফ্ল্যাটে যে টাকা ও সোনার অলঙ্কার ছিল, তা পাওয়া যাচ্ছে না। আফরোজা ও দিতিকে হত্যার পর খুনীরা এগুলো নিয়ে পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। পুলিশ জানায়, টাকা ও সোনার অলঙ্কার চুরি করতেই দুজনকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাদের সন্দেহের তীর ওই বাসার নতুন গৃহকর্মীর দিকে। কিছুদিন আগেই তারিমের শ্বশুরের পিএস বাচ্চু ওকে নিয়োগ দিয়েছিল। ঘটনার পর থেকেই সেও পলাতক। পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল্লাহ হিল কাফি জানান, লবেলিয়া নামে ছয়তলা এ্যাপার্টমেন্টের এফ-৪ ফ্ল্যাট থেকে গৃহকর্ত্রী আফরোজা বেগম ও গৃহকর্মী দিতির গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। আফরোজা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও ক্রিয়েটিভ গ্রুপের ডিএমডি মনির উদ্দিন তারিমের শাশুড়ি। টিনটেক নামে একটি গার্মেন্টসের মালিক কাজী মনির উদ্দিন। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে হত্যায় জড়িতদের তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, নিহত আফরোজা বেগমের স্বামী আশরাফ হোসেন অনেক আগেই মারা গেছেন। তিনি ছিলেন ঠিকাদার । তাদের তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে স্বামীসহ ভবনের পঞ্চম তলায় থাকেন। অন্য দুই মেয়ের একজন কানাডা, অন্যজন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী। আফরোজা বেগমের মেয়ে দিলরুবার গৃহকর্মী রিয়াজ জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে ম্যাডাম আফরোজা বেগম ফোন ধরছিলেন না তাই দিলরুবা ম্যাডাম আমাকে পাঁচতলা থেকে চারতলায় নেমে দেখে আসতে বলেন। আমি গিয়ে দেখি, ম্যাডাম (আফরোজা বেগম) ফ্লোরে পড়ে আছেন, রক্তমাখা। আমি দৌড়ে ওপরে গিয়ে বিষয়টি জানাই। তখন বাসার অন্য গৃহকর্মী আপেল ও দিলরুবা ম্যাডামও চারতলায় আসেন। তারা নতুন গৃহকর্মীকে খুঁজছিলেন, কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। দরজা খোলা ছিল। তিনতলা পর্যন্ত ফ্লোরে রক্তমাখা পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবনের চতুর্থ তলা থেকে লিফট দিয়ে নামার পথে স্থানে স্থানে রক্তের দাগ লেগে ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ঘাতক পালিয়ে যাওয়ার সময় তার শরীরে লেগে থাকা রক্ত থেকে ওই দাগের সৃষ্টি। দুই লাশের ময়নাতদন্ত ॥ শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যালে মর্গে আফরোজা বেগম ও তার গৃহকর্মী দিতির লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। চার সদস্যের বোর্ড গঠন করে এ ময়নাতদন্ত করা হয়। বোর্ডের প্রধান ছিলেন ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ড. সোহেল মাহমুদ। সঙ্গে ছিলেন প্রভাষক প্রদীপ বিশ্বাস, কবির সোহেল ও ডাঃ দেবিকা। ময়নাতদন্ত শেষে কবির সোহেল জানান, দুই মরদেহের শরীরে ছুরিকাঘাতের একাধিক জখম ছিল। বোর্ড প্রধান ড. সোহেল মাহমুদ জানান, আফরোজা বেগমের বাঁ হাতে, পেটে, বুকে, পিঠে ও গলায় ছুরিকাঘাত করা হয়। এর মধ্যে একটি আঘাত তার কিডনি ভেদ করে যায়। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু ঘটে। গৃহকর্মী দিতিকে ডান দিকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। তার ডান পাশের বুক, পিঠ ও গলায় ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। গলা কাটার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। তাদের ভিসেরা সংগ্রহ করা হয়েছে। মৃত্যুর আগে গৃহকর্মী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল কিনা তা জানতেও পরীক্ষা করা হচ্ছে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ দুটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে মরদেহ দুইটির সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন ধানম-ি থানার এসআই এনামুল হক।
×