ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিশিরে সিক্ত ভোর- গাছিদের রস আহরণের প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ৩ নভেম্বর ২০১৯

শিশিরে সিক্ত ভোর- গাছিদের রস আহরণের প্রস্তুতি

শরীরে এখন শিরশিরে অনুভূতি। যেন শীতল ছোঁয়া লেগেছে গায়ে। প্রকৃতি যেন জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। উত্তরের মৃদু হাওয়ার সঙ্গে যেন ধীর কদমে উঁকি দিচ্ছে শীত। এরইমধ্যে ভোরের দুর্বাঘাসে শিশির ফোটার আস্তরণ। এবার হেমন্তের শুরু থেকে উত্তরের প্রকৃতিতে জানান দিয়েছে শীতের বার্তা। দ্রুত কমে যাচ্ছে দিনের পরিধি। বেলা বাড়ার পর সূর্যের আলোকরশ্মির তীর্যক ভাবও ম্লান। সকাল থেকে সূর্য উঁকি দিতে পারেনি আকাশে। এরই মধ্যে এ অঞ্চলের খেজুর গাছে গাছে শুরু হয়েছে গাছিদের প্রস্তুতি। কার্তিকের টানা বৃষ্টির পর সকাল-সন্ধ্যায় শরীরের শিরশিরে অনুভূতি জানান দিচ্ছে শীত আসছে। আসবেই না কেন- এরই মধ্যে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে শরত বিদায় নিয়েছে। হেমন্তের শুরু থেকেই শিশির বিন্দুতে সাদা কাশফুলের রংও এখন ধূসর প্রায়। শীতের আগমনী বার্তায় হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে ভোরের সোনা রোদ। বিকেল পাঁচটা না বাজতেই পশ্চিমে ঢলে পড়ছে সূর্য। গোধূলী লগ্ন পেরিয়ে জলদিই নেমে আসছে সন্ধ্যা। ভোরের আলো ফুটতেই স্নিগ্ধ শিশিরে ভেজা সবুজ ঘাস আর ধানের পাতাগুলো নুয়ে পড়ছে বাতাসে। সাঁঝ-সকালে বয়ে আসা হিমেল হাওয়ায় টের পাওয়া যাচ্ছে, ধীর পায়ে শীত নামছে উত্তরের প্রকৃতিতে। ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রকৃতিতে ভর করেছে কুয়াশা। সব মিলিয়ে এখনই এ অঞ্চলে বিরাজ করছে শীত শীত ভাব। কার্তিকের প্রথম সপ্তাহে এবার উত্তরে পদ্মাপাড়ের শহর রাজশাহীতে শীতের আবহ তৈরি হয়েছে অনেকটা এমনই। গরম যাই যাই করতেই ঠিক শীতের প্রভাব। তবে ভোরের কুয়াশাচ্ছন্নতায় পদধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে শীতের। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, ডিসেম্বরের আগে শীত নয়। অর্থাৎ অগ্রহায়ণ পেরিয়ে পৌষ মাস এলেই নামবে কাঁপানো শীত। তবে আবহাওয়ার কারণেই এবার হেমন্তেই কড়া নাড়ছে শীত। এরইমধ্যে গতি কমে গেছে ঘরের সিলিং ফ্যানের। কংক্রিটের নগরে বন্দী থাকা মানুষগুলোর শরীরে শেষ রাতে উঠেছে কাঁথা। গ্রামের চিত্র আরও সুশোভিত। পাখিদের ডানা ঝাঁপটানো শব্দ আর কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙছে কৃষকের। হালকা কুয়াশা ভেদ করে মাঠে নেমে পড়ছেন কৃষক। গাছিরা কোমরে রশি বেঁধে উঠে পড়ছেন খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধার প্রস্তুতিতে। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা বলেন, নবেম্বর মাসে দেশে হাড় কাঁপানো শীত খুব একটা পড়ে না। এর কারণ হচ্ছে সূর্য যত দক্ষিণ গোলার্ধের দিকে যাবে শীতের তীব্রতা ততটাই বাড়তে থাকবে। তাছাড়া দিনের ব্যাপ্তি কমে আসায় সাধারণত ডিসেম্বর মাস থেকেই শীত পড়তে শুরু করে। তখন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাতাস বাংলাদেশের দিকে আসায় তাপমাত্রা আরও কমে আসে। এর সঙ্গে যদি সাইবেরিয়া থেকে আসা হিমেল বাতাস যোগ হয় তাহলেই হাড় কাঁপানো শীত পড়বে। তাই এমন পরিস্থিতি ডিসেম্বরের আগে সাধারণত হয় না। তবে উত্তরাঞ্চলে প্রতিবারই একটু আগেই অনুভূত হয় শীতের। সেই রেশ ঘনিয়ে আসছে। এখন দিন যাচ্ছে আর ক্রমেই অনুভূত হচ্ছে শীতের পরশ। আর এর মাত্রা যোগ করেছে গত দুদিনের টানা বৃষ্টিপাত। এদিকে প্রকৃতিতে শীতের আগাম বার্তায় খেজুর গাছে শুরু হয়েছে পরিচর্যা, কাটা-ছিলা। রাজশাহীর পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শীতের আগমনী বার্তায় গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার জন্য প্রাথমিকভাবে প্রস্তুতি শুরু করেছে হেমন্তের শুরু থেকেই। প্রথমে চলছে খেজুর গাছের মাথা পরিষ্কার। এরপর শুরু হবে রস সংগ্রহ। চিরাচরিত সনাতন পদ্ধতিতে মাটির ভাঁড়ে রাত ভর রস সংগ্রহ করা হয়। ভোরের সূর্য ওঠার আগে গাছিরা রস ভর্তি মাটির ভাঁড় গাছ থেকে নামিয়ে পরে মাটির হাঁড়িতে কিংবা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি তৈরি করেন। রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ইতিমধ্যে গাছিরা খেজুর গাছ চাঁছা-ছিলার কাজ শুরু করেছেন। অল্প দিনের মধ্যে বাজারে নতুন খেজুর রসের গুড়-পাটালি পাওয়া যাবে। রাজশাহীর খেজুর গাছ অধ্যুষিত এলাকা পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘায় চোখ মেললেই এখন দেখা মিলছে খেজুর গাছ চাঁছা-ছিলার কাজ। গাছিরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। কিছুদিন পরই মধুবৃক্ষ থেকে সুমধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হবে পাটালি তৈরির উৎসব। গ্রামে গ্রামে খেজুরের রসের পিঠা, পায়েস, মুড়ি-মুড়কি ও নানা রকমের মুখরোচক খাবার তৈরি করার ধুম পড়বে। সকালে এবং সন্ধ্যায় কাঁচা রস খুবই মজাদার। রসে ভিজা চিতই পিঠার স্বাদই আলাদা। পাটালি ও দানা গুড়ের সুমিষ্ট গন্ধেই যেন অর্ধ ভোজন। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। পাটালি গুড়ের মধ্যে নারিকেল কোরা, তিল ভাজা মিশালে আরও সুস্বাদু লাগে। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়-পাটালির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। চিনির দাম কম হলেও এখন পর্যন্ত বাঙালীর কাছে খেজুর গুড়-পাটালির কদর কমেনি। আবহমান কাল থেকে তাই নবান্নের উৎসব পালনে খেজুর গুড়ের কদর সবচেয়ে বেশি এখনো। রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট, পুঠিয়া ও দুর্গাপুর এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে গাছিরা গাছ পরিষ্কার বা চাঁছা-ছিলার কাজে ব্যস্ত। বাঁটাল, রশি ভাঁড় (মাটির ঠিলে) ক্রয় ও রস জ্বালানো জায়গা ঠিক করে রাখছেন। এ অঞ্চলের গাছিরা জানান, আর এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে খেজুরের রস আহরণ শুরু হবে। এরই মধ্যে মাঠে মাঠে শুরু হয়েছে আমন ধান কাটার কাজ। সাঁঝ-সকালে কৃষক মাঠে নামছেন ধান কাটার কাজে। অনেক এলাকার উঠানে এখনই ম ম গন্ধে ভরে উঠতে শুরু করেছে নতুন ধান। শহরের মোড়ে মোড়ে ভাপা পিঠার পসরাও বসতে শুরু করেছে এরই মধ্যে।
×