ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের কলঙ্ক জেলহত্যা

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ৩ নভেম্বর ২০১৯

ইতিহাসের কলঙ্ক জেলহত্যা

আজ ৩ নবেম্বর, শোকাবহ জেলহত্যা দিবস। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম দেশটিকে পরাজিত শক্তিরা তাদের কব্জায় নেয়ার জন্য ইতিহাসের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল ১৯৭৫ সালে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় সপরিবারে ১৫ আগস্ট ভোরে। এর আড়াই মাস পর আজকের এই দিনে কারাগারে আটক রাখা জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে কেন এবং কী কারণে হত্যা করা হয়েছিল তা সহজেই বোধগম্য। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। দেশী-বিদেশী অপশক্তিগুলো একত্রে কাজ করে নির্মমতার বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছিল। হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে প্রতিবিপ্লবীরা অর্জিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি শুধু পরিবর্তনই নয়, দেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় পরিচালিত করে। রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন পেশার বাংলাদেশবিরোধীরা হত্যাকান্ডের ক্ষেত্র তৈরি ও ষড়যন্ত্রে জড়িত এবং সহায়ক ছিল। কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে দেশবাসীর পক্ষ থেকে। এবারও এই দাবি উঠেছে সরকার ও বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে। হত্যাযজ্ঞে মোশতাক ও জিয়ার ভূমিকা ছিল স্পষ্ট এবং তা তাদের কর্মকান্ডে প্রমাণিত যে, এরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল এবং এরাই বেনিফিসিয়ারি। রক্তাক্ত পরিস্থিতিতে জিয়া ক্ষমতা দখলের পরই দেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল। জিয়া-মোশতাক একই লক্ষ্যে কাজ করেছে। এ ছাড়া হত্যাকান্ডে রাজনীতির গভীর সম্পৃক্ততা ছিল। আর তা ছিল বলেই হত্যাকান্ডের পর প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি সংশ্লিষ্টদের। তারা পাকিস্তানী ভাবাদর্শে যে লালিত তাদের কর্মেই তা পরিস্ফূটিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিশন গঠন করার কথা আইনমন্ত্রী ঘোষণাও করেছিলেন। জনগণের দীর্ঘদিনের এই দাবিটি ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বরের হত্যাকান্ডের সুগভীর ও পুর্ণাঙ্গ ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিশন গঠন আদৌ হবে কিনা সে নিয়ে সময়ক্ষেপণ এবং অবহেলার কোন কার্যকারণ মেলে না। যথাযথ তদন্ত হলে স্পষ্ট হবে জাতির পিতা এবং জাতীয় চার নেতা হত্যার প্রকৃত ইন্ধনদাতা কারা, কারা ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। যদি তাদের চিহ্নিত করা না যায় তবে জাতিকে কলঙ্কের ভার আরও বহুকাল বয়ে যেতে হবে। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী কয়েকজনের সাজা হলেও বাকিরা পলাতক। এই হত্যাকারীরাই জেল হত্যায়ও জড়িত ছিল। এই হত্যার আগে গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করে কারাগার থেকে চার নেতাকে মুক্ত করে নতুন সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। এই গুজবে বিভ্রান্ত হয়েছিল দেশবাসীও। পরদিন লালবাগ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছিল জেল কর্তৃপক্ষ। ক্ষমতা দখলকারী জিয়া তিন বিচারপতির সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের ক’দিন পর তা বাতিল করে দেয় এবং খুনীদের নিরাপত্তার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হয়। অনেককে দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয় পুরস্কারস্বরূপ। এই ঘটনায় ১৯৯৮ সালে নতুন করে দায়ের করা মামলার চার্জশীট দেয়া হয় ওই বছরের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনকে অভিযুক্ত করে। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ প্রদত্ত রায়ে পলাতক চারজনকে মৃত্যুদন্ডাদেশ ও ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। আপীলে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ২ জনকে ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ৪ জনকে খালাস দেয়া হয়। ২০১৩ সালে আপীলের পুনরায় শুনানির পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। জেল হত্যার নেপথ্যে সংগঠিত ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন এখন অন্যতম জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কারা ষড়যন্ত্রকারী, কারা প্ররোচনাদানকারী- সেসব তদন্তও জরুরী। কলঙ্ক মোচনে সরকার এ ব্যাপারে সক্রিয় হবে- দেশবাসীর সেটাই প্রত্যাশা।
×