ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরিত্যক্ত কলাগাছ ও কচুরিপানা থেকে তৈরি হচ্ছে কফিন

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ২ নভেম্বর ২০১৯

 পরিত্যক্ত কলাগাছ ও  কচুরিপানা থেকে  তৈরি হচ্ছে কফিন

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী ॥ ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে নীলফামারীতে তৈরি কফিন রফতানি হচ্ছে। উদ্ভিদ জাতীয় উপকরণ এই কফিন তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে ডোবার কচুরিপানা ও পরিত্যক্ত কলাগাছ এখন আর ফেলে দেয়ার তালিকায় নেই। কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত- খনার সেই বচন এখন বাস্তবতা। এতদিন কলা ফলনের পর কৃষক যে গাছগুলো কেটে ফেলে দিতেন, সেই ফেলে দেয়া গাছই জীবিকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। কলাগাছ ও কচুরিপনা। শিল্পের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে এসব মূল্যহীন জিনিস কফিন তৈরির কাঁচামালে পরিণত হয়েছে। রফতানিমুখী কফিন আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় সুখবর বয়ে এনেছে। লক্ষ্মীছাড়া পানাই, আর কলা ফলানোর পর কেটে ফেলা কলাগাছ এখন নীলফামারী জেলা সদরের লক্ষ্মীচাপ গ্রামের লক্ষ্মী! কারণ এক সময়ের আবর্জনা এখন আর্থিক সুফল নিয়ে আসছে। কচুরিপানা ও কলাগাছ দিয়ে। তৈরি এই কফিনই সমাদৃত হয়েছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এসব কফিন তৈরির কারিগরা হলেন লক্ষ্মীচাপ গ্রামের অসহায় পরিবারের নারী-পুরুষ। কফিনগুলো সম্পূর্ণ এগ্রিকালচার বেজড হওয়ায় এর ৭৫ শতাংশ কাঁচামাল এ অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি কফিনের ওজন সর্বোচ্চ ২০ কেজি। তিন ধরনের কফিন তৈরি হচ্ছে ব্যাম্বু (বাঁশ) কফিন, সি গ্রাস (হোগলা) কফিন ও উইলো কফিন। পরিত্যক্ত কলাগাছ, কচুরিপানা, বাঁশ ও হোগলা স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত হয়। শুধু উইলো আমদানি করতে হয়। উইলো দেখতে প্রায় পাটখড়ির মতো। এটি পাটখড়ির মতো ভঙ্গুর হলেও এটিকে পানিতে ভেজানোর পর বেতের মতো বাঁকানো যায়। ওই কফিনগুলো ভেজিটেবল ডাই ব্যবহার করে রং করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নীলফামারীর সোনারায় ইউনিয়নে ২১৩ দশমিক ৬৬ একর জায়গায় উত্তরা ইপিজেড স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৯৯ সালের ১ জুলাই এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে এখন বড় ইপিজেডে পরিণত হয়েছে উত্তরা ইপিজেড। আর এখানেই যুক্তরাজ্যের ডেভিড হাউ গড়ে তুলেছেন ‘ওয়েসিস কফিনস’ নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় সহজলভ্য উপাদান দিয়ে কফিন তৈরি করে তা ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বিক্রির করে ওয়েসিস কফিনস। এটিতে সহায়তা করছে এল জেরি ও ফিয়ানার গড়া প্রতিষ্ঠান টিন্ডার ক্যাপিটাল। সঙ্গে যোগ দিয়েছে পানাপুর নামে যুক্তরাজ্যের আরেকটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের এই সংগ্রামে সঙ্গী হয়েছেন বাংলাদেশের নীলফামারীর দরিদ্র নারী-পুরুষরাও। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের প্রথম সারির কফিন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান জেসি এ্যাটকিনসনের সঙ্গে চুক্তি হয় ওয়েসিস কফিনসের। ফলে বাংলাদেশের নীলফামারীর ওয়েসিস কফিনস এখন সফল এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। লক্ষ্মীচাপ গ্রামের একদল নারী-পুরুষ কলাগাছ ও কচুরিপানা সংগ্রহ করতে প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামের ঝোপঝাড়ে নেমে পড়েন। হেলে পড়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়া কলাগাছ, কলাগাছের শুকনা খোল সংগ্রহ করেন। গ্রামের পুকুর, খাল, বিল, নদী, নালা, ডোবার ভাসমান কচুরিপানাও তুলে আনেন। বাঁশও সংগ্রহ করেন তারা। পরে উপকরণগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণে কেটে, রোদে শুকিয়ে, প্রসেসিং করে সংরক্ষণ করা হয়। এগুলো থেকে তৈরি হয় ব্যাম্বু স্লিপস, ব্যাম্বু কোয়াটার লং, ব্যাম্বু কোয়াটার শর্ট, স্লাইডার ইত্যাদি। প্রয়োজনমতো এগুলো পাঠিয়ে দেয়া হয় উত্তরা ইপিজেডের ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিমিটেড নামের শিল্প কারখানায়। এসব কাঁচামাল থেকে তৈরি করা হয় কফিন। এই পণ্য রফতানি করে বছরে আয় করছে ২৫ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে উত্তরা ইপিজেডের ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিমিটেড নামের এই কফিন কারখানা স্থাপন করা হয়। মাত্র দেড় শ’ শ্রমিক নিয়ে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। কাঁচামাল সংগ্রহের সুবিধার জন্য ২০১৩ সালে নীলফামারী সদরে লক্ষ্মীচাপ গ্রামের শিষাতলীতে কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য একটি শাখা খোলা হয়। শাখাটির নামকরণ করা হয় ইকো সাপ্লাইজ (ইএসএন)। এই ইএসএন স্থানীয় লোকদের দিয়ে পরিত্যক্ত কলাগাছ ও কচুরিপানা সংগ্রহ এবং এগুলো প্রসেসিং করে। শিষাতলীতে জনতা বহুমুখী সমবায় সমিতির নিজস্ব তিন একর জমি চুক্তিতে নিয়ে কাজ শুরু করে ইএসএন। সেখানে প্রতিদিন ৪৬ জন নারী-পুরুষ কাজ করে থাকেন। তাদের দৈনন্দিন মাথাপিছু মজুরি সাড়ে ৪ শত টাকা। বাণিজ্যিকভাবে বর্তমানে দেশে কলার উৎপাদন বেড়েছে। কলা গাছের বিকল্প কোন ব্যবহার না থাকার কারণে কলার ছড়া কাটার পর কলা গাছও কেটে ফেলা হতো। তবে বর্তমান সময়ে পরিত্যক্ত কলার বাকল থেকে উৎপাদিত হচ্ছে ভালমানের ফাইবার বা সুতা। একটি কলা গাছের বাকল থেকে কম করে হলেও ২০০ গ্রাম সুতা উৎপাদন করা যায়। এই সুতা ওই কফিন তৈরির সময় বাঁধার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রথমে ডোবা-নালা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে কচুরিপানা তুলে আনা হয়। সংগৃহীত কচুরিপানাগুলোকে ভালভাবে পরিষ্কার করে ডাঁটা থেকে পাতা আলাদা করা হয়। এরপর ডাঁটাগুলো ভালমতো রোদে শুকাতে হয়। শুকনো ডাঁটাগুলোর ওপরের আঁশের মতো অংশটুকু সরিয়ে নিলেই ফিতার ন্যায় অংশের দেখা মিলবে। এবার বেত ও বাঁশের তৈরির ফ্রেমে প্রাপ্ত ফিতা পেঁচিয়ে এবং বুননের মাধ্যমে শৈল্পিক রূপ দেয়া হয়। রঙ ব্যবহার করা হয় চকচকে ভাব আনতে। ইকো সাপ্লাইজ শিষাতলী অফিসের ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন বলেন, কফিন তৈরির প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পরিত্যক্ত কলাগাছ, কচুরিপানা, কাঞ্চন ফুল ও বাঁশ সংগ্রহ করা হয়। এসব সংগ্রহ করতে তেমন অর্থ ব্যয় হয় না। শুধু বাঁশ কিনতে হয়। ইপিজেড ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিমিটেডের সাপ্লাই চেইন কমার্শিয়াল ম্যানেজার এলেন ফেইত ফুলেল বলেন, আমরা বেকারদের কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সৌন্দর্য রক্ষা,পাশাপাশি বৈদেশিক আয়ের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছি। এখান থেকে বছরে আমাদের অন্তত ২৫ কোটি টাকা আয় হয়ে থাকে। কারখানার শ্রমিক সুধির চন্দ্র রায় (৪৭) বলেন, আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করে মজুরির টাকার জন্য বাজারে বসে থাকতে হতো। এখন এই কারখানায় কাজ করে টাকা ও কাজের জন্য ভাবতে হয় না। প্রতিদিন বিকেলে মজুরির টাকা নিয়ে সময়মতো বাজার করে বাড়ি চলে যাই। এটা আমাদের জন্য অনেক ভাল। কাছাড়ীপাড়া গ্রামের সুনিল চন্দ্র হাজেরা (৬০) বলেন, আজকাল গ্রামে কাজ পাওয়া যায় না। এই কারখানা হওয়ায় পর থেকে কাজ নিয়ে ভাবতে হয় না। আমার মতো অনেক গরিব লোকের সংসার চলছে এখানে কাজ করে। শ্রমিক অনিতা রানী বলেন, কলার ছোবরার রশি তৈরি, কাঞ্চন পাতার পেস্ট তৈরি, বাঁশের চাটাই তৈরি করাসহ হরেক রকমের কাজ করতে হয়। আমরা এই কারখানায় কাজ করে সংসারের অনেক উন্নতি করেছি। ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করছে। এখন খুব ভাল আছি। লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, আগে এই ইউনিয়নের মানুষের খুব অভাব ছিল। হাতে ছিল না কাজ। বেকারের সংখ্যাও ছিল অনেক। বর্তমানে বিভিন্ন এনজিও ও উত্তরা ইপিজেডের কফিন কারখানায় অনেক মানুষের কাজের সুযোগ হয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন গ্রামের অবহেলিত নারীরাও। এখন তারা সচ্ছল জীবনযাপন করছেন। উত্তরা ইপিজেডের ওয়েসিস কফিনস ফ্যাক্টারিতে কফিন তৈরির কাজ করছে অসংখ্য নারী পুরুষ। নীলফামারী পৌরসভা সরকারপাড়া গ্রামের দিপু কুমার দের স্ত্রী ছবি রানী দে (৪০) বলেন, সাড়ে ৪ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। আগে দর্জির কাজ করতাম। তাতে যে আয় উপার্জন হতো তাতে অভাব যেত না। এখন স্বামী ক্ষুদ্র ব্যবসা করে আর আমি এখানে চাকরি করে যে বেতন পাই তাতে আমাদের পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। এখন কারও কাছে হাত পাততে হয় না। এই কফিন তৈরি করে জীবনের উন্নতি হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর আয়ে সংসারে সচ্ছলতা এনে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের সুঠিপাড়া গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে ফরিদুল ইসলাম (৩৫) বলেন, আমি প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এখানে কাজ করছি। এখানে যারা কাজ করছেন তারা সবাই এই এলাকার মানুষ। এখানে যে কফিন তৈরির কাজটা যেমনই নিরাপদ তেমনই পরিবেশ বান্ধব। মজুরিও অন্য যে কোন কাজের চেয়ে বেশি। তিনি এখন প্রতিমাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা বেতন পান বলে জানান। এছাড়া সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াও সরকারী সব ছুটি ভোগ করেন বলেও জানান। এছাড়া এখানে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে ওভারটাইম এবং প্রতি ৬ মাসে প্রফিট বোনাসও পাওয়া যায় বলে জানান তিনি। উত্তরা ইপিজেডের এসএফবি নম্বর ২/বি ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত ব্রিটিশ কোম্পানি ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিঃ। এই কোম্পানিরই একটি পণ্য ওয়েসিস কফিন। ওই কোম্পানির মানবসম্পদ কর্মকর্তা পলিনা ডি কস্তা জানান, এখানে এলাকার ৭৮ শ্রমিক কাজ করছেন। এর বাইরেও অফিসের কাজে বাংলাদেশের ১৯ কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। তিনি বলেন, লক্ষ্মীচাপ গ্রামে আমাদের একটি সাব-সেন্টার রয়েছে, সেখানেও অনেক শ্রমিক কাজ করছে। আমরা ওই সেন্টারের পরিধি আরও বাড়াতে চাই, তাহলে ঘরে বসেও অনেক শ্রমিক কাজ করার সুযোগ পাবে। তিনি দাবি করেন এখানে শ্রমিক মালিক সম্পর্ক নেই, এখানে মালিকের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা পার্টনারশিপ। সে কারণে প্রতি ৬ মাস অন্তর তারা বেতন-বোনাসের পাশাপাশি লভাংশও পেয়ে থাকেন। ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) ইভান্স হালদার বলেন, জানান, ওয়েসিস কফিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড হাউ ২০০৩ সালে বাংলাদেশ আসেন। তিনি কফিন ফ্যাক্টরির জন্য নীলফামারীকে বেছে নেন। এখানে জনসংখ্যা অনেক বেশি, মানুষের হাতে কাজ নেই, তারা বসে থাকে। তাদের কাজের সংস্থান করাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এছাড়া আমরা যে এগ্রোবেস পণ্য উৎপাদন করছি তার কাঁচামাল এখানে সহজলভ্য। এখানকার মানুষ খুব ভাল, তারা সহজ-সরল এবং সৎ, তাদের কর্মদক্ষতা আরও ভাল, তারা সহজে শিখতে পারে। এখানকার পরিবেশও অনেক ভাল। তিনি বলেন, আমরা আমাদের পণ্য তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে শুধু উইলো আমদানি করছি। ভবিষ্যতে আমরা উইলোর আমদানি বন্ধ করে উইলোর পরিবর্তে এ অঞ্চলের বেত ব্যবহার করব। এছাড়া আমরা ফ্যাক্টরির বাইরেও সাব-সেন্টার বাড়াব। তাতে অনেক মানুষ কাজ করতে পারবে। তিনি বলেন, আমরা কাজের সংস্থান বাড়ানোর জন্য ইউরোপের পাশাপাশি আমেরিকায়ও আমাদের কফিনের বাজার তৈরি করেছি। কাঠের বদলে বাঁশ আর হোগলা দিয়ে কফিন তৈরি করার বিষয়ে তিনি বলেন, গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়, এছাড়া একটি গাছ পরিপক্ব হতে সময় লাগে। গাছ নিধন করলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে আর বাঁশ ও হোগলা কলাগাছ ও কচুরিপানা প্রতিবছরে হয় এবং এ অঞ্চলে এটা অনেক বেশি জন্মায়। কাঠের চেয়ে দামও তুলনামূলক অনেক সাশ্রয়ী। পণ্যের গুণগতমান ও নতুনত্ব থাকে।
×