ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে চরকা

বৈদ্যুতিক যন্ত্র গিলে খাচ্ছে ইতিহাস ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ২ নভেম্বর ২০১৯

বৈদ্যুতিক যন্ত্র গিলে খাচ্ছে ইতিহাস ঐতিহ্য

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ প্রাচ্যের ড্যান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জামদানি নগরী রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ধুঁকে ধুঁকে আজও টিকে রয়েছে কিছু তাঁতি পরিবার। এদের বেশিরভাগ সদস্য এখন ‘পাওয়ার লুম’ কারিগর হলেও হতদরিদ্র পরিবারের শ্রমিকরা এখনও সেই আগেকার দিনের মতোই দিনরাত চরকা টেনে আর চরকার নলিতে সুতা ভরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মাছুমাবাদ দীঘিরপার এলাকার ষাটোর্ধ নারী শ্রমিক শ্রী অরুণ বালা জানান, তার কোন ছেলে নেই। স্বামী মারা গেছেন ১১ বছর আগে। স্বামী থাকাকালীন কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন চরকায় নলি টেনে সুতা ভরে যে পারিশ্রমিক পান তাতেই চলে তার সংসার। ২ মেয়ে বিয়ে দেয়ায় এখন অনেকটা একাকী জীবন তার। প্রতিদিন তিনি ৩০টি নলি ভরেন। তাতে মিল মালিক অন্যদের ৩ টাকা করে দিলেও শ্রী অরুণ বালাকে ৫ টাকা করে দৈনিক গড়ে ১৫০ টাকা পারিশ্রমিক দেন। এতেই সুখে আছেন তিনি। এভাবে উপজেলার সুরিয়াবো, ভিংরাবো, হাটাবো, কাঞ্চন ও তারাবো পৌরসভা এবং রাজধানীর ডেমরা এলাকায় রয়েছেন শতাধিক চরকা শ্রমিক। এদের বেশির ভাগ অতি দরিদ্র শ্রেণির। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ প্রায় হারিয়ে যাওয়া এ পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁতপল্লীর আশপাশের হাজারো পরিবারের গৃহবধূরা। সংসারের নানা কাজের পাশাপাশি বাড়িতে বসেই তারা চরকা চালিয়ে আয় করতেন বাড়তি টাকা। এতে গৃহবধূরাও পুরুষের পাশাপাশি সঞ্চয় করে সংসারের সহযোগী ভূমিকা রাখতেন। এখন বৈদ্যুতিক পদ্ধতি চালু হওয়ায় সুতা ভরতে চরকার ব্যবহার কমে এসেছে। তাই এখন চরকা কেবল যে অঞ্চলে বিদ্যুত নেই সেখানকার দরিদ্র শ্রমিকদের একমাত্র বাহন। টেক্সটাইল মিল মালিকরাও ‘দেরি হওয়ার’ অজুহাতে চরকা শ্রমিকদের কাজে লাগাচ্ছেন না। এতে চরম কর্মহীন পরিবেশ তৈরি হয়েছে এই পেশার শ্রমিকদের। ফলে নিদারুন কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তারা। এদের মধ্যে যারা জামদানি তাঁত বুননে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা জামদানি সংশ্লিষ্ট পেশায় ঝুঁকছেন। তবে চরকার বেলায় আধুনিকায়ন বেছে নিয়েছেন তারাও। ফলে চরকা এখন জাদুঘরে অথবা কোন শৌখিন ধনাঢ্য ব্যক্তির নিজস্ব সংগ্রহশালায় শোভা পাচ্ছে। পূর্বাচল বাঙ্গালবাড়ি বাতিঘরে গিয়ে দেখা গেছে বেশকিছুু চরকা। চরকাকে জাদুঘরে রাখার কারণ জানতে চাইলে ‘বাঙ্গালবাড়ি’র প্রতিষ্ঠাতা লায়ন মীর আব্দুল আলীম বলেন, কালের বিবর্তনে আধুনিকায়নের ছোঁয়া পেয়ে চরকার মতোন অনেক পুরনো জিনিস আজ হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্তমান প্রজন্ম দিন দিন এসব ভুলে যাচ্ছে। তাই পুরনো ঐতিহ্যের লালনে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে একসময় তাঁতশিল্পসমৃদ্ধ ছিল। এখনও আছে। এসব তাঁতকলে নারী-পুরুষ সমানতালে শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আজ তাদের বেশির ভাগ শ্রমিক গার্মেন্টসহ অন্য পেশায় চলে গেছেন। তবে সেসব বুনন পদ্ধতি ও বুনন হাতিয়ারগুলো টিকে আছে বিলুপ্তপ্রায় শিল্পের নিদর্শন হিসেবে। তাই এসব রক্ষায় সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ প্রয়োজন। রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, শিল্পনগরী রূপগঞ্জের কোনায় কোনায় তাঁতের নানা নিদর্শন রয়েছে। এদের মধ্যে তাঁত সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে পুরনো এ পেশা টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা জরুরী। আর এজন্য সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।
×