ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোরগঞ্জের লালডিঙ্গি খিলিপান

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২ নভেম্বর ২০১৯

 কিশোরগঞ্জের লালডিঙ্গি খিলিপান

পান পিপুল পরিবারভুক্ত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের এক প্রকার গুল্মজাতীয় গাছের পাতা। সবুজ রঙের এই পান কারও কাছে খুবই সখের বস্তু। কারও কাছে নেশার সাথী। দক্ষিণ এশিয়াসহ দেশের অনেক নারী-পুরুষ পান-সুপারিকে নানা উপাচারে স্থায়ীভাবে আবদ্ধ করে রেখেছেন। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতি, ভদ্রতা এবং আচার-আচরণের অংশ হিসেবেই পানের ব্যবহার চলে আসছে। একসময় বিয়ে-শাদি পূজা-পার্বণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান পান ছাড়া চলতই না। কনের বাড়িতে বরপক্ষ পান না নিয়ে এলে বিয়ে পর্যন্ত ভেঙে যেত। প্রাচীন অভিজাত জনগোষ্ঠীর মাঝে বিভিন্ন উপকরণে পান তৈরি এবং তা সুন্দরভাবে পানদানিতে সাজানো লোকজ শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেত। ওই সময়ের নানি-দাদিদের পান খাওয়ার শখ ছিল গল্পের মতো। তারা খুবই শৌখিনতার আদলে পান খেতেন। ছিল পানের বাটা। সরতা। যুগ পরিবর্তনে পানের বাটা, সরতা সোনালি অতীতে ঠাঁই নিলেও বাঙালী সমাজে পানের সমাদর কমেনি। পান খাওয়ার রীতি গ্রাম থেকে শহরের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে এখনও চোখে পড়ে। ঐতিহ্য পরম্পরায় গ্রামের অধিকাংশ নারী এখনও পান খায়। নতুন বউ এলে শখ করে নানি দাদিরা তাদের পান খাওয়ানো শেখায়। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করলে নাকি স্বামীর আদর বেশি পাওয়া যায়! গ্রামের মুরব্বি কিছিমের মোড়ল চাচাদের পান চিবাতে চিবাতে সালিশ করার বিষয়টি এ দেশে দীর্ঘকাল থেকে পরিচিত। সময়ের পরিবর্তনে পান খাওয়ায় এখন ভিন্নতা এসেছে। বাজারের বিভিন্ন উপকরণ মেশানো রেডিমেট পান পাওয়া যায়। যেটাকে বলা হয় ‘খিলিপান’। এ পানে থাকে কুচিকুচি করে কাটা সুপারি, জর্দা, খয়ের, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টিযুক্ত মসলা, সুগন্ধি ইত্যাদি। এগুলোর বাহারি নাম আছে যেমন-নবাবি পান, বাদশাহি পান ও জমিদার পান। যারা পানসেবী নয় তারাও শখের বশে হরেক রকম মসলায় সাজানো এসব পান খায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের পান উৎপাদন হলেও এর মান ও ধরনে ভিন্নতা রয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট অঞ্চলে বেশ কয়েকটি পানের জনপ্রিয় জাত রয়েছে। তবে ‘লালডিঙি’ পান বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষের কাছে খুব পরিচিত। এটি আকারে বড়, মসৃণ, পুরু এবং সুস্বাদু এই পানের চাষ কিশোরগঞ্জেই বেশি হয়। খিলিপানের উপযুক্ত হওয়ায় এই পানের এখন বাজার তৈরি হচ্ছে ঢাকাসহ সারাদেশে। আমেরিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবেও এখন যাচ্ছে কিশোরগঞ্জের এই ‘লালডিঙি’ পান। শহরতলীর জেলখানা মোড়ে ‘আগুন পান’ বিক্রি হয়। কুল্লি পাকানো এই পানে নানান ধরনের মসলা মেশানো থাকে। খাওয়ার আগে মসলায় আগুন ধরিয়ে খেতে হয়। পান খেতে খেতে আগুনটা একসময় নিভে যায়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সুগন্ধ। তবে এসব পান খাওয়ার ব্যাপারে ডাক্তারদের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। এ ব্যাপারে ডেন্টাল সার্জন ডাঃ ফারুক আহমেদ বলেন, রঙ-বেরঙের মসলাযুক্ত পান-সুপারি-জর্দার কারণে মুখ গহ্বরের ক্যান্সারের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া দাঁতের ক্ষয়, মাঢ়ির রোগেরও অন্যতম কারণ এই পান সুপারি। শহরের পুরান থানা বাজারের অসংখ্য দোকানে পাইকারি ও খুচরা দামে এই পান বিক্রি হয়। ব্যবসায়ী আবদুল মালেককে ‘লালডিঙি’ পান সম্পর্কে বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকেই তাদের পানের বরজ (বাগান) রয়েছে। বংশ পরম্পরায় পান বিক্রির সঙ্গেও তিনি জড়িত। করিমগঞ্জের সুবন্দি, সাঁতারপুর ও জাঙ্গাল গ্রামে অসংখ্য পানের বরজ রয়েছে। এসব বরজ থেকে প্রতিদিন পান সংগ্রহ করেন। তবে এই পানের চাষ পাকুন্দিয়া উপজেলায় বেশি হয়। এছাড়া করিমগঞ্জ, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর কটিয়াদী ও ময়মনসিংহের নান্দাইলসহ বিভিন্ন উপজেলায় এ পানের চাষ হয়। কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন বাজারে পাইকারি ও খুচরায় বিড়া হিসেবে (প্রতি বিড়ায় পান ১২০টি) গড়ে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার এ পান বিক্রি হয়। -মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ থেকে
×