ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের শিকড় সন্ধানী বিকুল চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ২ নভেম্বর ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধের শিকড় সন্ধানী বিকুল চক্রবর্তী

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর জন্ম হয়নি। স্বভাবতভাবেই চোখে দেখেননি যুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলো। তারপরও তিনি প্রতিনিয়ত ভয়াল সেই দিনগুলো প্রত্যক্ষ করে চলেছেন, শুধু নিজেই অবলোকন করছেন না আমাদেরও নিয়ে যাচ্ছেন একাত্তরে। দেখাচ্ছেন সেই ভয়ার্থ দিনগুলোর বীভৎসতা। শুধু তাই নয় যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধেও চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। যে বয়সে সাফল্যের পেছনে, অর্থ, প্রভাব প্রতিপত্তির পেছনে মানুষ দৌড়ায় সে বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি সংরক্ষণে ঘুরে ফিরছেন গ্রাম থেকে গ্রামে, মানবতাবিরোধীদের বিচার দাবিতেও রয়েছেন সোচ্চার। এই দাবিতে আছেন রাজপথে, প্রথম সারিতে! তার সেই দেশপ্রেম আজ তাকে একনামে পরিচিত করেছে মুক্তিযুদ্ধ তথ্যচিত্র ও স্মারক সংগ্রাহক হিসেবে। যার ফলে বিকুল চক্রবর্তীর নামের সঙ্গে এখন আবশ্যিকভাবেই যুক্ত হয় এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা অভিধাটি। কিন্তু প্রচারের আলোয় তেমন একটা আসতে চান না তিনি। নিভৃতে থাকতেই পছন্দ করেন মুক্তিযুদ্ধের এই শেকড় সন্ধানী সংগ্রাহক। অনেকেই এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা বলে থাকেন বিকুল চক্রবর্তীকে। নতুন প্রজন্মকে জানান দিতে এ পর্যন্ত আয়োজন করেন ৫০টির বেশি মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র ও স্মারক প্রদর্শনীর। যার প্রচেষ্টায় সংরক্ষিত হয়েছে অনেক বধ্যভূমি। তার মধ্যে শ্রীমঙ্গল ৭১ বধ্যভূমিটি উল্লেখযোগ্য। তার কর্মকান্ডই এমন যে একাত্তরে যুদ্ধ না করেও তিনি আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার করেছেন নিজেকে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে, প্রান্তিক পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি নিজেই শুধু অনন্য এক উচ্চতায় আসীন হননি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে করেছেন সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের নাম না জানা অজানা প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের ও বীরাঙ্গনাদের অসামান্য আত্মত্যাগের ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষণের প্রয়াসে একনিষ্ঠভাবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকৃত দেশপ্রেম ও দেশগড়ার আদর্শে ও ইতিহাসের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালবাসা আর নতুন প্রজন্মের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তথ্য আহরণের নিরিখে সকল ক্লান্তি, বাধা উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে ছুটে চলেছেন পথে প্রান্তরে। শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকার গতানুগতিক চক্রে তিনি জীবনের উপযোগিতাকে খুঁজে পান না। বিলাস বসনের মধ্যে নিজের জীবনকে সীমিত রাখার আদর্শ তিনি কখনোই প্রলোভিত হননি। তাই হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধের মহামূল্যবান সম্পদগুলোকে রক্ষা করতে নিরন্তন কাজ করে চলেছেন মৌলভীবাজারের সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী। যার প্রচেষ্টায় সংরক্ষিত হয়েছে অনেক বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্য চিত্র ও স্মারক। গ্রামে গ্রামে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও গণহত্যায় শহীদ পরিবারের ছবি স্মারক সংগ্রহ করেন সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী। কালের আবর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বধ্যভূমিগুলোকে চিহ্নিত করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস তৈরি করেন তিনি। শ্রীমঙ্গল ৭১ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য প্রথম প্রস্তাবকারী ও সংরক্ষণে অর্থ সংগ্রহে শ্রীমঙ্গলের সুধীজনদের নিয়ে প্রথম এগিয়ে আসেন তিনি। তবে এর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন ৪৬ বিজির অধিনায়ক লে, কর্নেল নুরুল হুদা। তথ্য সংগ্রহ করেই শেষ নয়। এই তথ্য নতুন প্রজন্মকে জানান দিতে আয়োজন করেন মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র ও স্মারক প্রদর্শণী। বিকুল চক্রবর্তীর এ কার্যক্রম মৌলভীবাজার জেলার একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। আর এ সংগৃহীত তথ্য সংরক্ষণেরও প্রয়োজনীতা উপলব্ধি করেন জেলার মুক্তিযোদ্ধারা। মনে হয় এটাই যেন তার দায় জাতির প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। শুধু তাই নয়, এমন কিছু তথ্যচিত্র অনুষঙ্গ এনছেন বা সত্যকে নির্মাণ করেছেন ইতিহাসের আলোয় যা তার জীবনের পক্ষেও ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সত্যিকার দেশপ্রেমিক তো বটেই।’ দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরাও একবাক্যে বিকুল চক্রবর্তীকে তার কাজের জন্য অনন্য বলে থাকেন। সেই কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। অনেক প্রাজ্ঞজনের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন কাজের স্বীকৃতি। ২০১৪ সালে বৃক্ষ সংরক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র ও স্মারক সংরক্ষণের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে তাকে। বিকুল চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৭৯ সালে মৌলভীবাজার অন্তরী গ্রামে। পিতার ব্যবসায়িক কারণে ছোট বেলা থেকে স্থায়ী বসবাস করেছেন শ্রীমঙ্গল শহরের সবুজবাগ আবাসিক এলাকায়। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেও ২০০৬ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি সংরক্ষণ নিয়ে কাজে শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য চিত্র ও স্মারক প্রদর্শনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অসীম সাহসী যোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সঙ্গে তিনি জাতিকে পরিচিত করান। এরপর ২০০৯ সালে তিনি তার সংরক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র ও স্মারক নিয়ে হাজির হন জাতির সামনে। নতুন প্রজন্মকে জানান দিতে আয়োজন করেন মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র ও স্মারক প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেন দেশের বাইরেও। এই পর্যন্ত তিনি ৫১টির বেশি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। বিকুল চক্রবর্তীর মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র ও স্মারক প্রদর্শনীতে যেমন উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে প্রান্থজনের বীরত্বগাথা, তেমনই উঠে এসেছে তাদের আত্মত্যাগের কাহিনী। এসব ঘটনার এতদিন ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। একই সঙ্গে তার প্রদর্শনীর মাধ্যমে সম্মাননা দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকজন দেশী-বিদেশী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের। বিকুল চক্রবর্তী এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে একাত্তরে শহীদ হওয়া পরিবারগুলোকে মূল্যায়িত করার চেষ্টা করছেন। সাবেক গণপরিষদের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান জানান, বিকুল চক্রবর্তী গ্রামে গ্রামে গিয়ে যে জিনিসগুলো সংগ্রহ করেছে তা একটি ব্যতিক্রমী যা দিয়ে নিঃসন্দেহে একটি বড় জাদুঘর করা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র ও স্মারক প্রদর্শনী নিয়ে বিকুল চক্রবর্তীর অভিব্যক্তি, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশীয় রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় যে মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়, তারা ছিলেন তাদের পরিবারের প্রধান এবং উদ্যামী ব্যক্তি। তাদের হত্যা করার পর থেকে ঐ পরিবারগুলো অভিভাবক ও চালিকাশূন্য হয়ে যায়। যাদের ৮০ ভাগ পরিবারই দারিদ্র্যতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অথচ এই পরিবারগুলোর আত্মত্যাগের বিনিময়েই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। আজ এই পরিবারের প্রতি কারও কোন মুল্যায়ন নেই। বিশেষ করে যারা গণহত্যায় শহীদ হয়েছেন তাদের খোঁজ কেউ করেনি। আমি চেষ্টা করছি সেই পরিবারগুলোর বর্তমান সদস্যদের ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার। অন্তত বাংলাদেশের আত্মত্যাগী পরিবারগুলো হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। একই সঙ্গে তিনি শহীদদের ধরে রাখতে প্রত্যেকটা গ্রামে রাস্তাঘাট ও স্কুল কলেজের নাম শহীদদের নামে করার আহ্বান রাখেন। শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনুসন্ধানই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও নির্ভীক এই কলম সৈনিক সোচ্চার রয়েছেন। গণজাগারণ মঞ্চ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার শত্রুদের বিচারের দাবির প্রতিটি প্লাটফর্মের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছেন তিনি। তার দাবি, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে জাতিকে। অন্যথায় ইতিহাস ক্ষমা করবে না আমাদের।’ -চৌধুরী নীহারেন্দু হোম, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) থেকে
×