ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিশির ভেজা হেমন্তে

প্রকাশিত: ০৮:১৮, ১ নভেম্বর ২০১৯

শিশির ভেজা হেমন্তে

সবুজ শ্যামল ধানক্ষেতে ভোরের মিষ্টি রোদের চাদর বিছিয়ে যাওয়া দেখেই মন বলে হেমন্ত এসেছে দুয়ারে। ধানের ডগায় শিশিরের মুক্তদানা অন্যরকম এক আভা ছড়ায়। মৃদুৃ বাতাস আন্দোলিত করে মনকে। হেমন্তের রূপটাই যেন এমন। চোখ জুড়ানো মন মাতানো ফুলের বাহার হয়ত নেই, ভাদ্রের ভ্যাপসা গরম কিংবা বর্ষার স্রোতস্বিনী নদীর ঢেউ হয়ত চোখে পড়ে না তারপরেও অন্যরকম এক আমেজ নিয়ে আবির্ভূত হয় হেমন্ত। কৃষাণ-কৃষাণীর আশায় বুকবাঁধা স্বপ্ন রচনা নিয়ে যাত্রা হয় হেমন্তের। প্রকৃতির রূপ-বদলের চিত্র, সকালের সোনা রোদ মন ভরিয়ে দেয়। শরতের সাদা মেঘের ভেলা যেন আরও ঔজ্জ্বলতা ছড়ায়, উদাসী হাওয়ায় লুটোপুটি খেতে থাকে। মূলত উৎসবের ডামাডোল শুরু হয়ে যায় এই হেমন্ত থেকেই। অজস্র বারিধারায় যে তরুপল্লব সবুজে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল তা কার্তিকে এসে অনেকটাই ম্লান হয়ে যেতে থাকে। তবে সেখানেও সতেজতা ছড়ায় ভোরের শিশির। অনেকেই কার্তিক এবং অগ্রহায়ণ মাসকে দুঃখের পরে সুখ বলে আক্ষায়িত করেন। করাল কার্তিকের পর সমৃদ্ধ অগ্রহায়ণ যেন সে বার্তাই বহন করে। অনেকেই কার্তিক মাসকে মরাকার্তিক বলে থাকেন। কারণ এ সময়টায় কৃষকের হাতে তেমন কোন কাজ থাকে না। ফলে অলস সময় কাটে। কিন্তু আশার হাতছানি হচ্ছে অগ্রহায়ণ। নতুন ফসলে ভরে উঠবে গোলা, নতুন উদ্যমে শুরু হবে পথচলা। দূরে গ্রামের গাঢ় সবুজ রেখার ওপর জমে থাকে হেঁসেল থেকে উঠে আসা ধোঁয়ার কুন্ডলি। বাতাসে গা শিরশির করা শীতের স্পর্শ অগ্রহায়ণে অন্যরকম আমেজ ছড়ায়। তবে এ কথাও সত্যি দিন বদলের পালাতে মরাকার্তিক এখন অনেকটাই ম্লান। কৃষি কাজে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া এবং উৎকর্ষতার ফলে কৃষক এখন সারা বছরই ব্যস্ত থাকে। কিছু কিছু ফসল এখন সারা বছরই আবাদ হয়। যা সত্যিকার অর্থেই ইতিবাচক দিক। বারো মাসে তেরো পার্বণে অভ্যস্ত বাঙালী শুধু উৎসব উদ্যাপনে ব্যস্ত তা নয় সারা বিশ্বে উৎসবমুখর জাতি হিসেবে বাঙালীর আলাদা একটি পরিচয় রয়েছে। যে কোন উৎসবে নিজেদের মেলে ধরতে কার্পণ্য করে না। উৎসবের রঙে রঙিন করে তোলে উৎসবের আকাশকে। হাজার বছরের বাঙালী ঐতিহ্যকে আরও বেশি বর্ণিল করে তুলেছে বাঙালীর উৎসবগুলো। এ যেন একই সুতোয় গাঁথা। উৎসবগুলোও আজ ঐতিহ্যে তিলক লাগিয়ে নতুনভাবে জানান দিচ্ছে নতুন প্রজন্মকে। এখন হয়ত বর্ষা এলে আগের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয় না। কিন্তু তারপরেও কোথাও না কোথাও দেখা মিলে এ উৎসবের। কিছুক্ষণের জন্য হলেও শামিল হওয়া যায় ঐতিহ্যের সঙ্গে। আর এ কাতারে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। আর এ কারণেই আজও শুধু মনের আনন্দের খোরাক জোগাতে আয়োজিত হচ্ছে নৌকা বাইচসহ আরও নানা উৎসব। কালের গর্ভে যদিও এ উৎসবগুলো বিলীন হতে চলছে তারপরেও থেমে নেই আয়োজন। আবার জীবিকার ব্যস্ততায় ঋতু বৈচিত্র্যের রূপ অনেকের চোখ এড়িয়ে যায়। পরিবেশের বৈষম্যতা ঋতুর পালাবদল সেভাবে চোখে না পড়লেও একটু চোখ মেলে তাকালে এখনও এ পরিবর্তন আন্দোলিত করবে মনকে। হেমন্তে নদীর পানির ভাটা পড়ার আগেই এখনও অনেক জায়গায় আয়োজন করে নৌকাবাইচের। যা লোক উৎসবের এক অন্যতম ঐতিহ্য। আরে আল্লাহু নাম জপি ছাড়িলাম নাও... ওরে ছাড়িলাম হাসনের নাও রে... ভাইরে হাসন রাজার নাও... নদীর দু’কূল করতালিতে মুখর। মানুষের শোরগোলে মুখরিত চারপাশ। এরই মধ্যদিয়ে নদীর বুকচিড়ে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। একেক নৌকার দশ থেকে বারোজন করে মাঝি। সবাই এক সুরে মাল্লার গান গেয়ে এগিয়ে নিচ্ছে নৌকা। এ দৃশ্য এখন খুব একটা চোখে না পড়লেও এক সময় বাংলার চিরচেনা দৃশ্য ছিল এই নৌকাবাইচ। এ নৌকাবাইচকে উপলক্ষ্য করে পুরো এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে যেত। অনেক সময় ঘটে যেত নানা ঘটন-অঘটন। তারপরেও এ যেন ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আজও মাথা উঁচু করে আছে। ঋতু বৈচিত্র্যের মাঝে এ উৎসবগুলো যেন আনন্দের বাড়তি মাত্রা যোগ করে। লোকজ উৎসব : গ্রামীণ পটভূমিতে চিত্রিত লোকজ এ উৎসবের উৎস কবে থেকে তা অজানা। ধারণা করা হয় মানুষ সভ্য সমাজের অংশ হয়ে ওঠার পর থেকেই এ ধরনের উৎসবের প্রচলন ঘটে। এক কথায় প্রাচীন এক উৎসব। মূলত এ অনুষ্ঠানের সূত্রপাত ঘটে ভোজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। প্রাচীন যুগে শিকারকৃত পশুর মাংস এক সঙ্গে ভোজ করা হতো বিভিন্ন গীতিনৃত্যের মাধ্যমে। এসবের মধ্য দিয়েই মূলত লোকজ উৎসব শুরু। তবে আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর হওয়াতে কালের প্রবাহমানতায় এসব উৎসব কৃষিনির্ভর হতে থাকে। এবং আজ অবধি লোকজ উৎসব বলতে গ্রাম বাংলার চিরায়ত কৃষি ও ঋতুভিত্তিক উৎসবকে বোঝানো হয়। শস্যের মাস : একটা সময় অগ্রহায়ণ মাসকে ধরা হতো বছরের প্রথম মাস। অগ্র অর্থ প্রথম এবং হায়ন অর্থ মাস। এ সন্ধিবিচ্ছেদ থেকেই অগ্রহায়ণের উৎপত্তি। ফসল তোলার উৎসব এবং নববর্ষের উৎসব এ দুই উৎসব ধারণ করে অগ্রহায়ণ বিশাল বাংলার জনজীবনে প্রতিষ্ঠিত ছিল দীর্ঘকাল। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়টা পরিবর্তিত হয় মোঘল সম্রাটের আমলে। তাদের হাত ধরেই বৈশাখ বাংলা মাসের প্রথম মাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। নবান্ন উৎসব : এ দেশের জনপ্রিয় এক উৎসব হচ্ছে নবান্ন উৎসব। নতুন ফসল ওঠার পর অগ্রহায়ণ মাসে এ উৎসব বেশ ধুমধামের মাধ্যমে পালিত হয়। উৎসবের দিন ভোর হতেই ছেলেমেয়েরা ঘরের বাইরে এসে ছড়া কেটে দাঁড় কাককে নিমন্ত্রণ করত। কো কো কো, আমাগো বাড়ি শুভ নবান্ন, শুভ নবান্ন খাবা, কাকবলি লবা, পাতি কাউয়া লাথি খায়, দাঁড় কাউয়া কলা খায়, কো কো কো, মোরগো বাড়ি শুভ নবান্ন। এদিন ঢেঁকিছাঁটা চাল রাধা হয়। ছেলেমেয়েরা নতুন জামাকাপড় পরে। বাড়ির উঠোনে গর্ত করে জ্যান্ত কৈ মাছ ও কিছু দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোতা হয়। একে বলে বীর বাঁশ। বীর বাঁশের চারপাশে চালের গুঁড়া দিয়ে আল্পনা আঁকা হয়। আর বাঁশের কঞ্চিতে নতুন ধানের ছড়া বাঁধা হয়। এরপর কাকের সামনে নাড়ু, কলা, নারকেল দেয়া হয়। কাক কলা নিয়ে যেদিক দিয়ে উড়ে যায় সেদিকে সবাই তাকিয়ে থাকে। মনে করা হয় অশুভ শক্তি দূর হয়ে সুবাতাস বইবে। এ পর্বকে কাকবলি বলা হয়। এ পর্বের পর সবাই খাবার খেয়ে নেয়ে নেয়। এর আগে নয়। সারা দিনই উন্নত খাবার পরিবেশিত হয়। পরের দিনই বাসিনবান্ন দিয়ে দিন শুরু হয়। সব ধর্মেই নবান্নের উৎসব প্রচলিত। শুধু ধরনটা একটু ভিন্ন। নবান্ন আজও আমাদের জীবনে ভাললাগা-ভালবাসার মেলবন্ধন তৈরি করে। আর এ কারণেই নবান্নকে ঘিরে রচিত হয়েছে বহু গান ও কবিতা। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায়... মিলনোৎসবে সেও তো পড়েনি বাকি নবান্নে তার আসন রয়েছে পাতা পশ্চাতে চায় আমারই উদাস আঁখি এক বেনী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা ... কবির ভাষায় নবান্ন যেন এক মিলনোৎসব। যদিও নবান্ন শস্যভিত্তিক উৎসব। তারপরেও এ উৎসব যেন একে অপরের মধ্যে মেলবন্ধন রচনা করে। পাড়ায় পাড়ায়, বাড়িতে বাড়িতে বসে পালাগান, জারি ও কীর্তনের আসর। এছাড়াও এদেশের বেশকিছু আদিবাসী তাদের প্রধান ফসল ঘরে তোলার পর ভিন্ন ভিন্ন নামে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে। মনে পড়ে যায় সেই জনপ্রিয় লোকগীতি... আমার মাইজ্জা ভাই, সাইজ্জা ভাই কই গেলারে, চল যাই চল মাঠে ধান কাটিতে... গানের এ চরণ দুটিতে কর্ম উদ্দীপনা এবং উচ্ছ্বাস দুটোই যেন প্রকাশ পায়। কৃষাণ-কৃষাণীর অনাবিল আনন্দ পুরো গ্রামজুড়ে যেন ছড়িয়ে যায়। আবার রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের ভাবধারায় মরাকার্তিকের ছাপ এবং অগ্রহায়ণের সুন্দর রূপ ফুটে উঠেছে... শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা রেখে অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ তাহার আস্বাদ পেয়ে পেকে ওঠে ধান... সূর্যহারা আকাশে কিছুটা সময় রঙ্গিন আলোর আভা নিমিষেই মিলিয়ে যায়। এক এক করে জ্বলে ওঠে বাতিগুলো যেন গোধূলির মায়ায় মিলিয়ে যেতে চায়। হালকা কুয়াশাচ্ছন্নতা সৃষ্টি করে এক মায়ময় দৃশ্য। দিন-রাতের সন্ধিক্ষণের এ মনোরম দৃশ্য আর কখন দেখা যায় হেমন্ত ছাড়া? কৃষাণীর ঘরের হাকডাক, হাসির রোল হেমন্তেকে ফিরিয়ে দেয় সজিবতা। পৌষ পার্বণ : এটাও একটি শস্য উৎসব। এ উপলক্ষে মুসলিম রাখাল ছেলেরা মানিকপীরের গান গেয়ে আর হিন্দু রাখাল ছেলেরা লক্ষ্মীর নামে ছড়া কেটে সারা পৌষ মাস সন্ধ্যার পর বাড়ি বাড়ি মাগন করত। মাগন শেষে তারা পোষ সংক্রান্তির সকালে বনের ধারে রান্না করত। পিঠা বা শিরনি বানিয়ে পীর কিংবা দেবতাদের উৎসর্গ করে নিজেরা খেত। একে পিঠা পর্বও বলা হয়। এছাড়া প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তৈরি হয় নতুন ধানের পিঠা পায়েস। আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত করা কিংবা পিঠাপুলি পাঠিয়ে দেয়া এ উৎসবের একটি অংশ। বর্তমান সময়ে শহুরে সংস্কৃতিতে এর কদর কম নয়। বকুলতলার নবান্ন : নগরায়ন এবং আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী এসব লোক উৎসব এখন আর আগের মতো দৃশ্যমান হয় না। আর শহরে নেই কোন চাষাবাদ, নেই ধান কাটা এবং মাড়াইয়ের ধুম। তাই নবান্নও নেই। তবে এরই মাঝে নগরবাসীকে নবান্নের কথা মনে করিয়ে দিতে নবান্ন উৎসব পরিষদ যুগ যুগ ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় আয়োজন করে আসছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত- এ আয়োজনে থাকে দেশের গান, বাউলগান, কবিতা আবৃতি, লাঠিখেলা এবং নাচ। এর পাশাপাশি পিঠা, মুড়ি মুড়কির আয়োজন এর শোভা বাড়িয়ে দেয়। নগরবাসীর জন্য এটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো হলেও ব্যাপারটা প্রশংসনীয়। কারণ তা-না হলে নবান্নের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা হতো না নগরবাসীর। অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও নবান্ন উৎসবে মন হারিয়ে যেতে পারে। বেড়া ভাসান : শরতের কোন এক বৃহস্পতিবার জলেরপীর খোয়াজখিজিরকে স্মরণ করে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবের রেশ থাকে হেমন্তেও। বাংলাদেশের লোকায়তপীরদের মধ্যে গাজীপীর, মানিকপীর, মাদারপীর ও পীরের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় পীরের নাম হচ্ছে জলেরপীর খোয়াজখিজির। বেড়া ভাসান উৎসবে জলেরপীর খোয়াজখিজিরকে স্মরণ করে একসঙ্গে পাঁচটি কলাগাছ জোড়া লাগিয়ে একটি ভেলা তৈরি করা হয়। ভেলার ওপর ছোট্ট একটি বাঁশের ঘর তৈরি করে তা বিভিন্ন রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়। এরপর ভেলার ওপর পিঠা পায়েসের ভোগ রাখা হয়। এছাড়াও ভক্তদের মানতের সামগ্রী দিয়েও সাজানো হয় এ ভেলাটি। এরপর ঢাক বাজাতে বাজাতে ভেলাটি নিয়ে যাওয়া হয় নদীর ঘাটে। সেখানে প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দেয়া হয় ভেলাকে। এরপর গ্রামে ফিরে ভক্তদের মাঝে প্রসাদ বিলান পূজারী। এর পর থেকেই পীর খোয়াজখিজিরের বন্দনা গেয়ে সারারাত গানের উৎসব হতে থাকে। কারাম : আশ্বিন-কার্তিক মাসের উৎসব এটি। ওরাঁও উপজাতিদের উৎসব পুজো উৎসব এই কারাম। কারাম এক ধরনের গাছ। এই গাছের পুজোকে কেন্দ্র করেই এ উৎসব। উত্তারঞ্চলে এ উৎসবকে ভাদাই কিংবা বর্ষাপর্ব অনুষ্ঠান বলে থাকে। এ উৎসবে ওরাঁও যুবক-যুবতীরা হয়ে ওঠে নৃত্য ও সঙ্গীতমুখর। ভাদ্র-আশ্বিন মাসের নির্দিষ্ট দিনে স্নান করে নদী কিংবা বিল থেকে একটি পাত্রে বালু নিয়ে আসে। সেই বালুতে বীজ ছিটিয়ে দেয়া হয়। তারপর সকাল সন্ধ্যা সে পাত্রে পানি ঢালতে থাকে। একে করে সেই পাত্রে চারা গজিয়ে ওঠে। সেই বীজপাত্র নিয়ে কারাম গাছের কাছে গিয়ে পূজারী গাছকে পুজোর নিমন্ত্রণ দিয়ে আসে। পরদিন পুজোর অনুষঙ্গ হিসেবে কারাম গাছের দুটো ডাল কেটে নিয়ে আসে। আসার পথে সারা রাস্তা নেচে গেয়ে ভরিয়ে রাখে। তারপর সেই ডাল পুজো ম-পের কাছে পুঁতে রেখে পুজো অর্চনা করা হয়। পুজো শেষে সেই ডাল দুটিকে ঘিরে সারারাত চলে নাচ গান। পরদিন সেই ডাল দুটো নিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে নদীতে গিয়ে বিসর্জন দেয়া হয় ডাল দুটি। আর এর মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটে কারাম উৎসবের। এখনও সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের ওরাঁও, সাওতাল, ঘাটুয়াল, কর্মকার সম্প্রদায় এ উৎসব পালন করে থাকে। মেলা : মানুষে মানুষে মিলন, সংস্কৃতি সংস্কৃতিতে মিথস্ক্রিয়া কিংবা শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভেদ দূর করে অবারিত প্রান্তরে মিলিত হবার নামই মেলা। ধর্মীয়, ঋতুভিত্তিক কিংবা কোন ঘটনার স্মরণে মেলার উদ্ভব ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। তবে যে ধরনের মেলাই হোক না কেন চরিত্রগত দিক থেকে সবগুলো মেলার চরিত্র প্রায় এক। একটি জাতি বা গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য প্রকাশের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে এই মেলা। আজ থেকে প্রায় ৪২৯ বছর আগে ৯৯৩ হিজরি, ১৫৮৪ ইংরেজি সালের ১০ মার্চ মতান্তরে ১১ মার্চ সম্রাট আকবর তাঁর ২৯ বছর রাজ্য শাসনের পর বাংলা সন প্রবর্তনের ফরমান জারি করেন। সে সময় সৌর চন্দ্রের হিসেবে মার প্যাচে বছরের প্রথম মাস হিসেবে আবির্ভূত হয় অগ্রহায়ণ। এ ঘোষণাটি আবহমানকালের উৎসবকে আরও বেশি গতিশীল করে। অগ্রহায়ণ পুরোপুরি শীতের মাস না হলেও শীতের আগমনী বার্তা শোনায়। আর সে কারণেই এ সময়টা উৎসব উপযোগী। আর বর্ষবরণ যোগ হওয়ায় উৎসবের মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণে। যাত্রা, পালাগান ছাড়াও বিভিন্ন রকম মেলার আবির্ভাব ঘটে এ সময়টায়। ধারণা করা হয় উৎসবভিত্তিক মেলার আয়োজনের সূত্রপাত মোঘল আমল থেকেই। যদিও পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে মোঘলদের আমলেই বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হেমন্তে যে মেলার সূত্রপাত ঘটে তা যেন বৈশাখে গিয়ে শেষ হয়। যদিও শহুরে প্রেক্ষাপটে মেলার কোন নির্দিষ্ট দিনক্ষণ এখন আর নেই। তারপরেও ঋতুভিত্তিক গ্রামীণ পটভূমির মেলা আজও জনপ্রিয়। মেলা মানেই মিলন, বন্ধন ও উৎসব। মেলা মানেই সচল জীবন্ত ঐতিহ্য। উৎসবের আধুনিকায়ন : বর্তমান ব্যস্ত এ শহুরে জীবনে একদন্ড দম ফেলার ফুরসত যেন হারিয়ে ফেলছে শহরবাসী। জীবিকার তাগিদে ছুটে চলতে হয় সারাক্ষণ। আর গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে থেমে থাকারও যেন উপায় নেই। তারপরেও উৎসব সামনে চলে এলে নিজেকে মেলে ধরতে একটুও কার্পণ্য করে না। তবে ব্যস্তবজীবনে উৎসবের ধরন কিংবা রূপ কিছুটা পাল্টে গেছে। যেমন আগে বিয়ে শাদিতে অনেকদিন সময় বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান করে বর কনেকে এক করে দেয় হতো। এক গায়ে হলুদেই তো কত রকমের অনুষ্ঠান করা হতো। আজও গায়ে হলুদ কিংবা বিয়েশাদি বেশ জাঁকজমকভাবেই হচ্ছে তবে ধরনটা একটু কর্পোরেট। আগে এ ধরনের অনুষ্ঠান পরিবারের সদস্যরাই আয়োজন করে থাকত। কিন্তু এখন বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির দায়িত্ব নিয়ে বর বা কনেপক্ষকে করছে ভারমুক্ত। এতে অনুষ্ঠানের আনন্দ কিংবা গতি দুটোই বৃদ্ধি পায়। কর্পোরেট যুগে উৎসবের আমেজ ধরে রাখতে এ ধরনের ইভেন্ট কোম্পানিগুলোর তুলনা নেই। অনেকটা রথ দেখা কলা বেচার মতোই। উৎসবের আমেজও পাওয়া যায় আবার কাজের কোন ক্ষতি হয় না। ঠিক এভাবেই আয়োজন হয়ে থাকে বিভিন্ন মেলার। আমাদের দেশের বিভিন্ন ফোন কোম্পানি স্পন্সর করে মেলাগুলোকে আরও বেশি উৎসবমুখর করে তোলে। সেটা বৈশাখী, চৈত্র সংক্রান্তি, পৌষ কিংবা নবান্নের মেলা হোক। যেমন বকুলতলার নবান্ন উৎসবেও বিভিন্ন কোম্পানির স্পন্সর থাকে। যা অনুষ্ঠানকে আরও বেগবান করে। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষকে ছুটতে হয়। অনেক সময় প্রকৃতি অমোঘ পরিবর্তন চোখ মেলে দেখার সুযোগও মেলে না ইটকাঠের এই শহরে। এ ধরনের উৎসব মনে করিয়ে দেয় আমাদের ঐতিহ্যের। আর এ কারণেই শত ব্যস্ততার মাঝেও এ ঐতিহ্যকে ধারণ করা উচিত। এ উৎসব ঐতিহ্যের, এ উৎসব ইতিহাসের, এ উৎসব শেকড়ের।
×