ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৬৫ বছরের পথচলায় উইমেন্স ভলান্টেরি এ্যাসোসিয়েশন

প্রকাশিত: ০৭:৫০, ১ নভেম্বর ২০১৯

৬৫ বছরের পথচলায় উইমেন্স ভলান্টেরি এ্যাসোসিয়েশন

সমাজ তখনই বদলাবে, যখন আমরা উচ্চকিত হব, সচেতন হয়ে প্রতিবাদী হবো যেকোন অন্যায়, অবিচার ও অপরাদের বিরুদ্ধে। উইমেন্স ভলান্টেরি এ্যাসোসিয়েশন (WVA)- সংঘঠনের সদস্যরা মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ তাই জাতীয় যেকোন দুর্যোগে তারা একত্রিত হয়েছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়ে সেবার হাতকে করেছেন প্রসারিত। সংঘঠনের সদস্যরা শুধুমাত্র তার সেবার হাতকেই প্রসারিত করেননি, মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এর প্রতিটি সদস্য সময়ের প্রয়োজনে, সমাজের বিভিন্ন অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে করেছেন প্রতিবাদ, হয়েছেন উচ্চকিত। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের প্রতি এসিড নিক্ষেপ, নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা থেকে শুরু করে প্রতিনিয়তই চলছে নারীদের প্রতি অসম্মান, অবমাননা, অবহেলা ও অপমান। সমাজের এই বিভিন্ন মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিকার একা কোন সংগঠন বা ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়, সংঘঠনের মহিলা সদস্য দ্বারা পরিচালিত একটি সমাজসেবামূলক সংগঠন, তদুপরি তার আদর্শ, উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই বিভিন্ন ধরনের অন্যায়, অসামাজিক কার্যেও তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধনের মাধ্যমে। উইমেন্স ভলান্টেরি এ্যাসোসিয়েশন (WVA)- সেবার অঙ্গনে নামে মর্যাদায় কর্ম উদ্যোগে সমাজের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নাম। যদি পেছন ফিরে তাকাই ১৯৫৪ সালের ১৯ অক্টোবর তৎকালীন সময়ে একত্রিত হয়েছিলেন ৩০-৩৫ নারী, কিছু স্বদেশী, কিছু বিদেশী। উদ্দেশ্য ছিল মহৎ, সমসাময়িক দুর্যোগ মোকাবেলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচেষ্টা ছিল পুরুষশাসিত সমাজে দেশের অবহেলিত, অবক্ষয়িত, দুস্থ অসহায় নারী ও শিশুদের কল্যাণের জন্য কিছু করা। হৃদয়ের গভীর হতে উৎসারিত কিছু শব্দের, কিছু কর্মের প্রতিফলিত রূপ আজকের উইমেন্স ভলান্টেরি এসোসিয়েসন (WVA) এর চিন্তা, চেতনা, মননে কর্মে ও আদর্শে। যে কোন সংগঠনের জন্য ৬৫ বছর অতিক্রম করা একটি বিরাট মাইলফলকের চিহ্ন বহন করে। (WVA) সেবার অঙ্গনে, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও সেই মাইলফলক ৬৫ বছর Sapphire Jubilee প্রতিষ্ঠা দিবসকে অতিক্রম করেছে তার মেধা, মনন ও প্রজ্ঞা দিয়ে সমাজের দুস্থ, অবহেলিত, অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে। ১৯৭১ থেকে আজ ২০১৯। সুদীর্ঘ পথ কঠিন, বন্ধুর, যা মসৃণ হয়েছে, হয়েছে দৃঢ় এর সদস্যদের আন্তরিকতার কর্মযজ্ঞে। সময়ের হাত ধরে বেড়েছে এর কার্যক্রম, বিস্তৃত হয়েছে, পেয়েছে ব্যাপ্তি। WVA-i প্রতিষ্ঠালগ্নেই তার আদর্শ, ছিল লক্ষ্য পুরুষশাসিত সমাজে অবহেলিত নারীদের কিছুটা স্বাবলম্বী, আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মনির্ভরশীল এবং আত্মমর্যাদাকে সমুন্নত করার একটি দুরূহ প্রচেষ্টা। সঙ্গে ছিল জাতীয় দুর্যোগে নিজেদের সম্পৃক্ত করে মানবতার সেবা করা। তাই ‘পোলিও’ নামক রোগটি যখন মহামারী আকারে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শিশুদের আক্রান্ত করে ভবিষ্যত প্রজন্মের জীবনকে করে তুলেছিল অন্ধকারময়, তখন WVA-i সদস্যরা তাদের সেবার হাতকে বাড়িয়ে দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন Disabled Children Residential Centre (DCRC). পঙ্গু হাসপাতালের সুপারিশকৃত পোলিও আক্রান্ত শিশুরোগীদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা, শিক্ষা দিয়ে, সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলে দিয়েছেন তাদের পারিবারের কাছে। সেই অর্থে বলা যায় দেশে পোলিও রোগ নির্মূল অভিযানে সরকার এবং অনেক সংগঠনের সঙ্গে সঙ্গে WVA-i এই কমিটির রয়েছে বিরাট অবদান, যা কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। কমিটি তার কার্যক্রম আজও অব্যাহত রেখেছে জন্মগতভাবে বা অন্যকোন কারণে আক্রান্ত হাত, পায়ের সমস্যা নিয়ে আসা শিশুদের চিকিৎসা দিতে। দীর্ঘমেয়াদী এই চিকিৎসা যদিও ব্যয়বহুল, তবুও WVA-i প্রতিটি সদস্য আন্তরিক মমতায় এসব দুস্থ শিশুদের চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের শিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ও ব্যয়ভার বহন করে থাকেন। WVA-G ভাবেই তার প্রজেক্টগুলোকে ১১টি কমিটির মাধ্যমে (প্রশাসনিক, উন্নয়নসহ) পরিচালিত করে থাকে- কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য। সংঘঠনের প্রতিটি কমিটির কার্যক্রমকে সঠিকভাবে পরিচালনা করছেন এর সাধারণ সদস্যরা, যেকোন তিনটি কমিটির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। পরিবার পরিকল্পনায় ও শিশু স্বাস্থ্যে সংঘঠনের পরিবার পরিকল্পনায় কমিটির মাধ্যমে একজন এমবিবিএস ডাক্তার দ্বারা পরিচালিত হয় একটি ফ্রি ফ্রাইডে কিøনিক। রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন এবং কমিটি থেকে প্রতিরোগীকে বিনামূল্যে ওষুধসহ এই চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়ে থাকে। কমিটির মাধ্যমে শিশুদের ভিটামিন ‘ডি’ সহ অন্যান্য ওষুধ খাওয়ানোর প্রোগ্রামও গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন বস্তিতে যেয়ে অপরিকল্পিত সংসারকে পরিকল্পনার মধ্যে এনে সমাজকে একটি সুন্দর পরিবার উপহার দেয়ার জন্য ওষুধ বিতরণসহ সুন্দর ও সুস্থ জীবনের পরামর্শ ও প্রদান করা হয়ে থাকে।অসহায় দুস্থনারী ঘরে বসে তৈরি করেন নিজ হাতে বিভিন্ন সামগ্রী। Babyland কমিটি তাদের তৈরি সামগ্রী কমিটির শো-রুমের মাধ্যমে বিক্রয় করে আর্থিকভাবে তাদের সহায়তা করে থাকে। সার্বিক চেষ্টা থাকে, তাদের আত্মনির্ভরশীল হয়ে সমাজে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার। Disabled Children Day Clinic (DCDC) নামে project টি অবস্থিত পুরনো ঢাকার মহানগর হাসপাতালে। এই ক্লিনিকে ডঠঅ নিজস্ব ফিজিওথেরাপিস্ট এর মাধ্যমে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সকল রোগীদের (ফিজিওথেরাপির জন্য যাদের সুপারিশ করা হয়ে থাকে) বিনামূল্যে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা সেবা দিয়ে তাদের সুস্থ করা হয়ে থাকে। অসহায় নারীদের শিক্ষা ও আত্মকর্মসংস্থানে WVA-এর আদর্শ অসহায় দুঃস্থ কন্যাজায়াদের পাশে সহযোগী হবার, যারা নিজেরা আত্মসম্মান নিয়ে নিজেদের মাথা উঁচু করে স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতে চায়। আর তাই এর প্রতিটি প্রকল্প, কার্যক্রম বা কর্মযজ্ঞের আওতায় রয়েছেন সেই কন্যাজায়া, শিক্ষা, সেবা ও সুস্থতায়। আর তাই আর্থিক অভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে না পারা মেধাবী সেই সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য পরিচালনা করে থাকে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, WVA-i Education কমিটির মাধ্যমে। শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিকতায়, সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতায় কুড়ি থেকে ফুটে নিজেদের প্রস্ফুটিত করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরবর্তীতে সেই শিশুরাই নিজেদেরকে শিক্ষার উচ্চমার্গে যেয়ে করেছে নিজেদের বিকশিত। সময়ের প্রেক্ষাপটে WVA-i কার্যক্রমের ধারায়ও এসেছে পরিবর্তন, তারই ধারায় যুক্ত WVA-i সদস্যদের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত Vocational Committee। এই কমিটির মাধ্যমে সেই দুস্থ অথচ মেধাবী কন্যাজায়াদের বৃত্তি প্রদান করা হয়ে থাকে নার্সিং গ্র্যাজুয়েশন কোর্স, ফিজিওথেরাপি গ্র্যাজুয়েশন কোর্সে। প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে কম্পিউটারের বিভিন্ন কোর্সে এবং সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করার চেষ্টা থাকে কন্যাজায়াদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার। Sweing কমিটি মহিলাদের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করিয়ে তা সংঘঠনের পরিচালিত মেলার মাধ্যমে বিক্রয় করে ফান্ড সংগ্রহ করে তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকেন। আর এভাবেই ছোট ছোট অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে WVA তার কার্যক্রমগুলোকে দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালনা করে আসছে। এই দীর্ঘ এই পথ চলায় এই কার্যক্রমগুলোকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন বা পরিচালনার জন্য যে আর্থিক সংস্থানের প্রয়োজন তা ডঠঅ এর কখনোই ছিল না, এখনও নেই। তাই ছোট ছোট মেলা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহ করে থাকে। অতীতে WVA-i প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন বিদেশীরা, জড়িত ছিলেন বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের সহধমির্ণীরা। WVA-i পাশে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সহধর্মিণীদের সংগঠন ঋঙঝঅ. এছাড়া সংঘঠনের প্রতিটি কার্যক্রমে আর্থিক সহায়তায় সদস্যদের সঙ্গে আছেন সমাজের সেই সব সহৃদয় ব্যক্তিত্ব, যাদের আন্তরিকতা, মহানুভবতা এবং উদারতা এই কঠিন পথচলাকে করেছে মসৃণ অথচ দৃঢ়। এভাবেই দীর্ঘ পথচলাকে যারা আজ ৬৫ বছরে নিয়ে এসেছেন, তারা আর কেউ নন, এর অতীত ও বর্তমানের সদস্যরা, যাদের আন্তরিকতা, প্রজ্ঞা, মেধা ও দক্ষতায় এখনও পরিচালিত হচ্ছে সংঘঠনের প্রতিটি কার্যক্রম। ৬৫ বছরের পূর্ণতার দিনটিকে স্মরণ করে ১৯ অক্টোবর, শনিবার, ২০১৯ WVA-i ধানমন্ডির নিজস্ব মিলনায়তনে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন রোটারিয়ান সাফিনা রহমান, সাবেক জেলা গবর্নর, রোটারি ডিস্ট্রিক-৩২৮১ এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন WVA-i সাবেক প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান আরও উপস্থিত ছিলেন FOSA সহ সমাজের বিভিন্ন নারী সংগঠনের কর্মকর্তাবৃন্দ। প্রতিটি সদস্যসহ, সংগঠনের কর্মচারী, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে দিনটি একটি মিলনমেলায় অতিবাহিত হয় আনন্দ, উচ্ছ্বলতায়, অতি সাধারণভাবে, কিন্তু মর্যাদা ও মাধুর্যে তা ছিল ভরপুর। প্রয়াতদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায়, অভিভাবকরূপী বড়দের সম্মাননা প্রদান, প্রতিটি কর্মচারী এবং শিক্ষকদের তাদের কর্মের সততা এবং আন্তরিকতার স্বীকৃতিও প্রদান করা হয় সব সদস্যদের পক্ষ থেকে। ৬৫-এর পূর্ণতার দিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংঘঠনের উচ্চারণ- আগামী দিনে সেবার প্রতিটি অঙ্গনে, সমাজের প্রতিটি মূল্যবোধের অবক্ষয়, অন্যায় ও অপরাধের প্রতিবাদে, জাতীয় দুর্যোগে, দুস্থদের পাশে সেবার হাতকে প্রসারিত করার ব্রতে উইমেন্স ভলান্টেরি এ্যাসোসিয়েশনের প্রতিটি সদস্য হবে উচ্চকিত, প্রতিবাদী, আন্তরিক।
×