ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লোকজ সংস্কৃতির বাহক যাত্রাপালা

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ৩১ অক্টোবর ২০১৯

লোকজ সংস্কৃতির বাহক যাত্রাপালা

যাত্রার কথা মনে হলে পুরনো ইতিহাস, মহর্ষী ব্যক্তিত্ব, লোকজ সাহিত্য, বিখ্যাত চরিত্র ইত্যাদির কথা মানসপটে ভেসে উঠে। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব বলেছিলেন যাত্রায় লোকজ শিক্ষা হয়। মহানায়ক উত্তম কুমার বলেছিলেন যাত্রা হলো একটি মোটা দাগ এবং তিনি তার মাত্র তেরো বছর বয়সে জীবন সঙ্গীনি বইতে বলবামের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কলকাতার জনতা অপেরায়। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত উপন্যাস পথের পাঁচালিকের চিত্রনাট্যরূপ দিয়েছিলেন অস্কার বিজয়ী বাঙালী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। এই চলচ্চিত্রে একটি যাত্রাপালা রয়েছে যা সার্বিক কাহিনীকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। এই আদি লোকজ সংস্কৃতি সূচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর আগে যখন মানুষ দেবদেবীর বন্দনা করত এবং একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাত্রা করত । গ্রামাঞ্চলে প্রবাদ আছে মঙ্গলের উষা যাত্রা বোধের পা যথা ইচ্ছা তথা যা। সেখান থেকেই যাত্রা কথাটির উৎপত্তি । তথ্য বলছে, ১৫০৯ সালে যাত্রার সঙ্গে অভিনয় যুুক্ত হয় শ্রী চৈতন্য দেবের সময়ে এবং রুক্ষিণী হরণ প্রথম যাত্রাপালা। শ্রী চৈতন্য দেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ সমতট, গৌড় চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল শ্রী হট্রেসহ সমগ্র ভূ-খ-ে পালাগান ও কাহিনী কাব্যের অভিনয় প্রচলিত ছিল। বঙ্গদেশে শিবের গজল, রামযাত্রা, সীতার বারোমাসী, রাধার বারোমাসী, নৌকা বিলাস, নিমাই সন্যাস, ভাওয়াল সন্যাস ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। অষ্টাদশ শতকে যাত্রা বাংলার ভূ-খ-ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে যখন শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারী, সুবল দাস প্রমুখ ছিলেন যাত্রার জগতে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব। ঊনবিংশ শতকের শেষে যাত্রায় পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক পালা এবং বিংশ শতকের শুরুতে যাত্রায় দেশ প্রেমমূলক কাহিনীর অভিনয় শুরু হয়। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মীর মোশারফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু কাহিনী অবলম্বনে যাত্রা অভিনিত হয়েছিল। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রখ্যাত পালাকার বরিশাল নিবাসী শ্রী ব্রজেন্দ্র কুমার দে বচিত বাগদত্তা, গরিবের মেয়ে, গলি থেকে রাজপথ, রিক্তা নদীর বাঁধ ইত্যাদিসহ আরও অগণিত পালা গ্রাম-বাংলার মানুষের মনে স্থান করে রেখেছে। বাংলাদেশের যাত্রার সম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস ও তার সহধর্মিণী জ্যোৎস্না বিশ্বাস তাদের যাত্রা দল চারুনিক নাট্যগোষ্ঠীর বিশেষত মাইকেল মধুসুধন পালাটি জনমনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। তাছাড়াও তোষার দাস গুপ্ত ও শব্যরী দাস গুপ্তের পরিচালনায় তুষার অপেরাম, ময়মনসিংহের গৌরীপুরের নবরঞ্জন অপেরা স্বত্বাধিকারী চিত্তবাবু ও তদীয় স্ত্রী বীণা রানীর অভিনীত বাগ দত্ত এখনও দর্শকদের কিছুক্ষণের জন্য হলেও রোমান্টিকের দিকে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ষাটের দশক কিংবা তারও আগে তখনকার মানুষের নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব, শিক্ষার মানসিকতা যেভাবে সমাজ সংস্কৃতির জগতকে প্রভাবিত করত তা সত্যিই ছিল বিস্ময়কর। তখন প্রতিটি জেলায় শীতের সময়ে প্রদর্শনী হতো যেখানে যাত্রা ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার পুতুল নাচ ছিল প্রধান আকর্ষণীয় বস্তু। যাত্রা শিল্পের নান্দনিক ও শৌল্পিক মূলবোধই ছিল উদ্যোগক্তাদের প্রধান লক্ষ্য। তখনকার সময় প্রায় স্কুলেই যাত্রাগান অনুষ্ঠিত হতো যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আর্থিকভাবে স্কুলকে সহায়তা করা এবং শিক্ষামূলক পালাগুলোই যেমন মাইকেল মধুসুধন, ভাওয়াল সন্যাসী, ভক্ত রামপ্রসাদ, গলি থেকে রাজপথ, আনারকলি ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় হাওড় বেষ্টিত অঞ্চলগুলোতে লোক সংস্কৃতিতে এত সমৃদ্ধ ছিল যে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গান বাজনার আয়োজন থাকত এবং ভাষাণ যাত্রার আয়োজন বসত বিয়ে কিংবা পূজার আসরে। পূর্ব ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলের প্রকোপ খুবই বেশি ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক সাহিত্যের অধ্যাপক ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের ময়মনসিংহের গীতিকার মহুয়া মলুয়ার যাত্রাপালার নিদর্শন পাওয়া যায়। ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলাদেশে সাত মাস (আাশ্বিন থেকে চৈত্র মাস) যাত্রা ভরা মৌসুম যার শুরুটা হয় দুর্গাপূজায় আর শেষ হয় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। (অসমাপ্ত)
×