ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমিষের পাশাপাশি নিরামিষও খায় মাকড়সা

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ২৯ অক্টোবর ২০১৯

আমিষের পাশাপাশি নিরামিষও খায় মাকড়সা

শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ কবি সুকুমার রায় ‘মূর্খ মাছি’ কবিতায় লিখেছেন-‘...সান-বাঁধা মোর আঙিনাতে জাল বুনেছি কালকে রাতে, ঝুল ঝেড়ে সব সাফ করেছি বাসা। আয়না মাছি আমার ঘরে, আরাম পাবি বসলে’ পরে ফরাস পাতা দেখবি কেমন খাসা! হাওয়ায় দোলে জালের দোলা চারদিকে তার জানালা খোলা আপনি ঘুমে চোখ যে আসে জুড়ে; আয়না যেথায় হাত পা ধুয়ে পাখনা মুড়ে থাক না শুয়ে ভন ভন ভন মরবি কেন উড়ে?’ রবার্ট ব্রুসের গল্প প্রায় সবারই জানা। স্কটল্যান্ডের বীর যোদ্ধা বরার্ট ব্রুসের তাঁর প্রতিপক্ষ শত্রুর কাছে বরাবর পরাজিত হচ্ছিলেন। শেষটায় একদম নিরাশ হয়ে রাজ্যের আশা ছেড়ে দিয়ে এক পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে পড়েন। এ সময় তিনি দেখেন যে, একটা পরিশ্রমী মাকড়সা একখানি সুতো ধরে বারবার গুহার মুখটাতে বেয়ে উঠবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রায় সাতবার চেষ্টার পর সে ঠিকমতো উঠতে পারল। তা দেখে রাজা ববার্ট ব্রুসের মনেও ভরসা হলো। তিনি চিন্তা করলেন, আর একবার চেষ্টা করে দেখি না। এবং সে চেষ্টার ফলে তিনি জয়লাভ করে আবার তার প্রিয় রাজ্য ফিরে পেয়েছেন। আর একালে স্ট্যানলি ও স্টিভ ডিটকো’র কমিক সিরিজ সুপার হিরো অবলম্বনে নির্মিত ইংলিশ মুভি স্পাইডারম্যানের প্রধান চরিত্র টোবি ম্যাগুয়েরের দুর্দান্ত কারিকুলাম দেখে মুগ্ধ হননি এমন ছেলেবুড়োর খোঁজ পাওয়া কঠিন। বাস্তবে মাকড়সার দুরন্তপনা এতটা না থাকলেও ম্যাগুয়েরের চেয়ে ওরাও কম পারে না। মাকড়সা অমেরুদন্ডী শিকারি কীট বিশেষ। এটি একটি আট পা ওয়ালা অরযারা কনিডা শ্রেণীর সন্ধিপদ প্রাণী। এদের শরীর মাথা ও ধড় দুটি অংশে বিভক্ত, আটটি সন্ধিযুক্ত পা আছে, ডানা নেই। এদের মাথা ও বুক একসঙ্গে সেফালোখোরাক্স বা মস্তক-বক্ষ গঠন করে। মাকড়সার সবচেয়ে বড় ও বিশেষ গুণ হলো, এরা জাল তৈরি করে এবং জালের মাধ্যমে অন্যান্য কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি শিকার করে নিজেদের জীবনধারণ করে। অনেক রকম মাকড়সা হয়, কেউ জাল বোনে, কেউ লাফিয়ে শিকার ধরে। সব মাকড়সারই একজোড়া বিষগ্রন্থি আছে। তবে সবাই প্রাণঘাতী না হলেও, এদের অনেকের কামড় খুব বিষাক্ত। গফরগাঁও সরকারী কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সিফাত-ই বাসার সুমি জানান, মাকড়সা প্রথম স্থলচর প্রাণীদের অন্যতম। অপেক্ষাকৃত প্রাচীন মাকড়সারা জাল বোনে না, এরা নিঃসঙ্গ শিকারি। লাফিয়ে ধরে। একটি মাকড়সার জাল হলো তার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। মাকড়সার কথা ভাবলে তার জাল আর সেই জালে ধরা পড়া বেচারা পোকার কথা সবার আগে মাথায় আসে। মাকড়সা আমিষভোজী এবং পোকামাকড় খেয়ে সে উদরপূর্তি করে সেটা জানা কথা। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, মাকড়সা কিন্তু আমিষ খাবারের পাশাপাশি কিছুটা নিরামিষও খেয়ে থাকে। অর্থাৎ আমরা মানুষেরা খাবারের পাশে যে একটু করে সালাদ বা সবজি খেয়ে থাকি, সেই একই ধরনের কাজ করে মাকড়সাও। গবেষক বেঞ্জামিন এবং ডার্ক এর এই সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল বিজ্ঞান জার্নালগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। অর্ব উইভার স্পাইডারের মাঝে এই অভ্যাসটা দেখা যায়। তাদের পাতা জালে ধরা পড়ে অনেক রকমের পোকা যা কিনা আমিষের ভাল উৎস। আর এর পাশাপাশি আরও ধরা পড়ে বিভিন্ন ফুলের পরাগ, ধুলোবালি আর ছত্রাকের রেণু। এগুলোকে ময়লা ভেবে ফেলে দেয় না এই মাকড়সা। বরং এই সবকিছু মিলিয়েই সে চমৎকার একটা ‘ব্যালান্সড’ ডায়েট বজায় রাখে। গফরগাঁও খায়রুল্লাহ সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষিকা মাহমুদা খাতুন বলেন, আমার জীবনে অনেক মাকড়সা দেখিছি, কিন্তু এমন মাকড়সা আর দেখিনি, শুধু অর্ব উইভার স্পাইডার নয়, ইউরোপিয়ান গার্ডেন স্পাইডার এবং এমন আরও অনেক মাকড়সা আছে যারা নিজেদের খাবারের মাঝে এমন কৌশলযুক্ত ভেজ ও ননভেজ অবস্থাটা বজায় রাখে। এদের সবাই নিজেদের রেশমি জালটার ব্যবহার করে এর জন্য। শিকার ধরার পরে এই জালটাকে ফেলে না দিয়ে বরং খেয়ে ফেলে। এই প্রোটিন তাদের তন্ত তৈরির গ্রন্থিতে চলে গিয়ে নতুন জাল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আর এই কাজ করার সময়েই জালের সঙ্গে আটকে থাকা নিরামিষ সব উপাদানগুলোও তার পেটে চলে যায়। উপজেলা উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, মাকড়সা উপকারি পোকা। আমাদের বিভিন্ন উদ্ভিদসহ বিভিন্ন ফসলের বিষাক্ত এবং ক্ষতিকর পোকা ও পোকার ডিম এদের খাদ্য। নেকড়ে, আর্বসহ বিভিন্ন জাতের মাকড়সা রক্ষায় আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। ইদানীং বিজ্ঞানীরা মাকড়সা জালের তন্তু থেকে বর্ম বানানোর পরিকল্পনার কথাও জানাচ্ছেন। যুদ্ধের ময়দানে বর্মের কোন বিকল্প নেই। প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে গা-বাঁচাতে প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন উপাদানে বর্ম তৈরি করা হতো। পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ চলছে এখনো, কিন্তু ভারি ধাতব বর্মের দিন হয়তো শেষ হয়ে এসেছে, কারণ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে আসছে মাকড়সার জালের তৈরি বর্ম। প্রাকৃতিক বিভিন্ন তন্তুর মাঝে অন্যতমশক্ত তন্তু হলো মাকড়সার জাল। হালকা এবং নমনীয় এই তন্তু ইস্পাতের চাইতে শক্ত বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। উড়ে যাওয়ার একটি পোকার গতি থামিয়ে দিতে পারে মাকড়সার জাল। এটা প্রাকৃতিকভাবে লম্বা হতে থাকে আর শুষে নেয় আটকে পড়া পোকার শক্তি। বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করলে অনেক বড় এমন একটি জাল হয়তো একদিন থামিয়ে দিতে পারবে ধ্বংসাত্মক মিসাইল। শুধু বর্মই নয়, অস্ত্রোপচারের সুতার মতো বস্তু বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা হতে পারে এ দিয়ে। মিশিগানের ক্রেইগ বায়োক্র্যাফট ল্যাবরেটরিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে জন্ম দেয়া হয়েছে এমন সব রেশম পোকা যারা কিনা তৈরি করবে মাকড়সার তন্তু। আর এই তন্তু দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এমন সব দস্তানা যাদের দৃঢ়তাও কিনা অতুলনীয়; এমনটাই ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই আইডিয়া নিয়ে যে আগে কাজ করা হয়নি তা নয়। কিন্তু মাকড়সার তন্তু থেকে বর্ম তৈরির কাজটি নেহায়েত ছেলেখেলা নয় আর অনেক প্রতিষ্ঠান এতে ব্যর্থ হয়ে ইতোমধ্যেই রণে ভঙ্গ দিয়েছে। কিন্তু ক্রেইগ বায়োক্র্যাফট রেশম পোকা ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ে আসতে পারে সাফল্য। কারণ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে জন্ম নেয়া এসব রেশম পোকা তাদের সন্তান-সন্ততির মাঝেও এমন তন্তু উৎপাদনের ক্ষমতা রেখে যাবে বলে সম্ভব হবে বাণিজ্যিকভাবে এই তন্তুর উৎপাদন।
×