ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় শুদ্ধি অভিযান

প্রকাশিত: ০৯:২১, ২৯ অক্টোবর ২০১৯

 উন্নয়নের ধারাবাহিকতায়  শুদ্ধি অভিযান

বাংলাদেশ যখন ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হচ্ছে, দেশের উন্নয়নের সূচক বাড়ছে ঠিক তখন দুর্নীতিপরায়ণ কিছু সরকারী কর্মকর্তার কাজকর্মে সকল অগ্রগতি ম্লান হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা বিভিন্ন উপায়ে আত্মসাত করে চলেছেন, যা ইদানীং বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এই সকল অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত জনগণ ও সরকারের কাছে তুলে ধরতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে এই দুর্নীতিবাজরা দেশের উন্নয়নে শত্রুর ভূমিকা পালন করে আসছে। এদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের হাতে নেয়া অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে এবং এখনও বাস্তবায়ন চলছে। সকল মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়নকৃত এই প্রকল্পগুলোতে সীমাহীন অনিয়ম, আর্থিক বিশৃঙ্খলা, স্বজনপ্রীতি, প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থমকে যাচ্ছে। ক্যাসিনো সম্রাট জি কে শামীম বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার পেতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামকে পনেরো শ’ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। অবাক লাগে দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে শুরু দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা ও বিদেশী দাতা সংস্থার অনুদান এবং ঋণের মাধ্যমে আনা টাকা দ্বারা গৃহীত প্রকল্পের ওই কাজে সুপারভিশনের দায়িত্বে থাকা একজন সরকারী কর্মচারী কি করে দীর্ঘদিন ধরে একই অফিসে কর্মরত ছিলেন? তার উর্ধতন কর্মকর্তা কি একবারও তার এ দুর্নীতির কথা জানতে পারেননি? এই প্রকৌশলীর দুর্নীতির দায়ভার তার উর্ধতন কর্মকর্তা কেউ এরিয়ে যেতে পারেন না। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ওপরের মহল থেকে মাঠ পর্যায়ের সকলেই এই দুর্নীতির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উপকারভোগী। যে সকল প্রকল্প বিগত দিনে বাস্তবায়ন হয়েছে সে প্রকল্পগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার। তাতেও একই রকম অনিয়ম পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায়। কিছুদিন যাবত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে যা প্রকাশ হচ্ছে তা দেখে দেশবাসী হতবাক। নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় হয় ১২৩ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এক দেশের এক প্রতিষ্ঠানে এবং ওই প্রশিক্ষণের ব্যয় বাবদ টাকা প্রেরণ করা হয় অন্য দেশে থাকা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এপিএসের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে, চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তাদের পানি ব্যবস্থার ওপর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় যে দেশের ৬০% মানুষের খাবার পানির নিশ্চয়তা নেই সেই আফ্রিকা মহাদেশের দেশ উগান্ডায়, বালিশ কা-, একজন পিয়নের বেতন মাসিক চার লাখ টাকা, ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ বণিকের বাসায় ৮০ লাখ টাকা, ডিআইজি মিজানের দুর্নীতি ও কুকীর্তি, ডিআইজি কর্তৃক কুরিয়ারের মাধ্যমে দুর্নীতির অর্থ প্রেরণ, একজন এএসপি কর্তৃক আটক হওয়া মাদকদ্রব্য বিক্রির জন্য ১০ হাজার টাকা বেতনে ব্যক্তিগত টাকায় দুইজন কর্মী নিয়োগ এবং তাদের দিয়ে আটককৃত মাদকদ্রব্য বিক্রি করে টাকা ভাগ করার খবর, ভূমি সচিবের অবৈধভাবে নিজে এবং স্ত্রী কর্তৃক অফিসের গাড়ি ব্যবহার, গাড়ির জ্বালানি বাবদ প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ সরকারী অর্থ আত্মসাত, দি বেঙ্গল সায়েন্টিফিক ও সার্জিক্যাল কোম্পানি কর্তৃক ২০টি সরকারী হাসপাতালের শত শত কোটি টাকার চাহিদাপত্র তৈরি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী একান্ত সচিব কর্তৃক টেলিফোনে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কদের চাপ দিয়ে ঠিকাদার কর্তৃক তৈরিকৃত যন্ত্রপাতির চাহিদাপত্রে স্বাক্ষর আদায় করে শত শত কোটি টাকা লোপাট করা। দি বেঙ্গল সায়েন্টিফিক ও সার্জিক্যাল কোম্পানির কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলে আসল দোষী কে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। নরসিংদীর মহিলা সংসদ সদস্য বুবলি কর্তৃক ৮ জন ছাত্রীকে দিয়ে নিজের নামে পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নেয়ার অপচেষ্টা, বিএনপির সংসদ সদস্য হারুন অর রশীদ কর্তৃক শুল্কমুক্ত গাড়ি ক্রয় করে বিক্রি করে দেয়া সংক্রান্ত দুর্নীতির কারণে ৫ বছরের কারাদ-, ক্যাসিনোর রাজা ইসমাইল হোসেন সম্রাট কর্তৃক ৪৫ কোটি টাকা একদিনে জুয়া খেলে হারানো ইত্যাদি সংবাদ হতবাক করেছে দেশবাসীকে। আইন প্রণেতারা যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তা হলে দেশের মানুষ কার ওপর ভরসা রাখবে। আমার মনে প্রশ্ন জাগে কি করে বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে বিমানবন্দরের বিভিন্ন চেকিং দরজা পেরিয়ে যেতেন? নিশ্চয়ই সম্রাটকে কোটি টাকার বস্তা নেয়ার জন্য বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তাগণ চেকিং করার দরজা খোলা রেখেছিলেন। না হলে সম্রাট কোটি টাকার বস্তা কিভাবে নিয়ে গিয়েছিলেন বিষয়গুলো তদন্তের প্রয়োজন। দিন-রাত ঢাকা শহরে পুলিশ পেট্রল থাকে, গোয়েন্দা সংস্থা সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকে, তা ছাড়া সিটি কর্পোরেশনের লোকজন কেউ কি কোনদিন এই ক্যাসিনো কর্মকা-ের একটু শব্দও পেলেন না? সমাজের বা প্রশাসনের কেউ জানেন না বলে দায়মুক্তি পেতে পারেন না। দুদক কর্তৃক শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, যা দেশের জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছে। দুদকের নেয়া এই অভিযানকে সর্বসাধারণ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন, যাতে করে এই দুর্নীতিবাজরা অপকর্মের উপযুক্ত শাস্তি পায় এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা চলমান থাকে। বিভিন্ন সরকারী কর্মসূচীতে যে রকমের সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে তা দেশের উন্নয়নে ভীষণ ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি পূরণ করার জন্য সংস্কার, অপচয় বন্ধ করাসহ আত্মশুদ্ধি কর্মসূচী হাতে নেয়া দরকার। শুধু ঠিকাদারদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কোন কাজের শতভাগ অর্জন করা কোনদিন সম্ভব নয়। তাই সব উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারীকে প্রকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে উপস্থিত থাকতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি চিরতরে বন্ধ করতে হলে প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সর্বক্ষণ মাঠে থাকতে হবে। প্রতিটি প্রকল্পে হাই প্রোফাইল কোন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিলে ওই প্রকল্পে সঠিক সুপারভিশন হবে না। কারণ মাঠে গিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা এবং সরেজমিনে দেখার মতো ধৈর্য মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তাদের অনেকেরই নেই। এখন থেকে প্রকল্প প্রণয়ন, বিশ্লেষণ, উপস্থাপন, অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং বাস্তবায়ন, সুপারভিশন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির পদ্ধতিগত পরিবর্তন খুবই জরুরী না হলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত হবে, যার সঙ্গে স্বাধীনতার সপক্ষের সরকারের ধারাবাহিকতার সম্পর্ক জড়িত। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×