ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রনীতি

প্রকাশিত: ০৯:২১, ২৯ অক্টোবর ২০১৯

ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রনীতি

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্তির পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও যুগোস্লাভিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট যোশেফ ব্রোজ টিটোর উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে বান্দুং সম্মেলনে সমুন্নত নীতিমালা প্রণয়নের পর ১৯৬১ সালে যুগোস্লাভিয়া বেলগ্রেডে প্রথমে ন্যাম প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, ন্যাম প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সারা বিশে^ই একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছিল। ইউরোপ ও আফ্রিকার মরু অঞ্চল ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষ, সেই সঙ্গে পারস্পরিক স্নায়ুযুদ্ধে অশান্তির কালোমেঘ জমা হয়েছিল পৃথিবীর রাজনীতির আকাশে। সে সময় জাতিসংঘের অসহায়ত্ত ছিল চোখে পড়ার মতো। যদিও জাতিসংঘই ছিল বিশে^র সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক ফোরাম। বিশ্বে মানবতা প্রতিষ্ঠা ও মানবসভ্যতার আধুনিকায়নে বিকল্প একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমত ৫৫টি দেশ এর সদস্যভুক্ত হয়। পরবর্তীতে এর পরিধি বাড়তে থাকে। বর্তমানে পর্যবেক্ষকসহ ১২০টি দেশ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। জাতিসংঘের পর ন্যামই হচ্ছে পৃথিবীর ২য় বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ফোরাম। বিশে^র বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি তিন বছর অন্তর এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবার হয়ে গেল ১৮তম সম্মেলন। ২০১৭ সালে ভেনিজুয়েলায় ১৭তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যে দেশে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেই দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান পরবর্তী তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ২ দিনব্যাপী এবার সম্মেলন উদ্বোধন করেন আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম এলিয়েভ। স্বাগত ভাষণ দেন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। এর পরই সর্বসম্মতিক্রমে আগামী তিন বছরের জন্য আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ন্যামের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সম্মেলনের মূল পর্বে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাকু কংগ্রেস সেন্টারে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। বর্তমান বিশ্বের সামগ্রিক পরিস্থিতির বাস্তবতায় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমন্বিত ও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিশ্চিত করে বান্দুং নীতিমালা সমুন্নত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য রাখেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন যে, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও বাংলাদেশ বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন ও রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট একটি রাজনৈতিক সঙ্কট। এ সঙ্কট যে কেবল বাংলাদেশের সঙ্কট না, তার ব্যাখ্যাও প্রদান করেন। তার বক্তৃৃতায় সৃষ্টকৃত এ সঙ্কটের জন্য মিয়ানমারই দায়ী। তাই এর সমাধানও মিয়ানমারের হাতেই রয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটকে বৈশ্বিক সঙ্কট হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মিয়ানমারের প্রতি ন্যায়সঙ্গত চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান। রোহিঙ্গা সঙ্কট যদি সম্মানজনকভাবে সমাধান না হয়, তবে বাংলাদেশের বাইরেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যার প্রভাব সাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, বৈশ্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দায় খুবই নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাবে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানাতে হবে। ন্যাম সম্মেলনে সাইডলাইনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মাহাথির মোহাম্মদ, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানির সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি ও নেপালের রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকগুলোতে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুটি প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা করেন। মানবিক কারণে মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় দিয়ে তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করেছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা করলে তারা প্রাণ বাঁচাতে কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী উদার ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শরণার্থী হিসেবে প্রায় ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারত বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল এবং খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করেছিল। সে যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উদার হস্ত প্রসার করেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের মাধ্যমে। কিন্তু আশ্রয়দানের ফলে বাংলাদেশ যে চরম সঙ্কটে নিপাতিত হয়, তা অনেকটাই অভাবনীয়। আজকের বাস্তবতায় রোহিঙ্গাদের যদি মিয়ানমারে শান্তিপূর্ণভাবে পাঠানো না যায়, তবে সুদূরপ্রসারী একটি নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাবে সারা বিশ^ই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটা নিশ্চিত বলা যায়। এ বোধ থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য কামনা করে আসছেন বিভিন্ন ফোরামের বৈঠকে। তিনি সদ্যসমাপ্ত জাতিসংঘ অধিবেশনেও এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন, যা সারা বিশ্বের নেতৃবৃন্দও গ্রহণ করেছেন। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দান করার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব মহলে প্রশংসিত হয়েছেন এবং মাদার অব হিউম্যানিটি উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের মহান নেতা স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অসামান্য এক সৃজন- প্রতিভাসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যিনি তার আপন সত্তায় বাংলাদেশের সংস্কৃতি, দর্শন ও বাঙালী জাতীয়তাবোধের বৈশিষ্ট্যকে সামগ্রিকভাবে মূর্ত করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন বিশ্ব দরবারে। তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে মানব-প্রগতি সম্বন্ধে সার্বিক বিষয়টিকেও স্থান দেয়া হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর কন্যা জনগণ কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতা প্রাপ্ত হবার পর থেকেই বাংলাদেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন। কী ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি জনকল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সেটি স্থান পেয়েছে। কোন কোন রাজনৈতিক দল এটাকে নতজানু নীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুস্থ ও সফল সমাজ গড়তে হলে সঙ্ঘবদ্ধ ও সমবায়ী মনোবৃত্তির প্রয়োজন রয়েছে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে লড়াই করার মনোভাব নিয়ে কোন সমৃৃদ্ধি আসবে না- শেখ হাসিনা বিভিন্ন ফোরামে সে বার্তাই দিয়ে যাচ্ছেন। সম্পূর্ণ একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনটি মূল্যবোধ জাগাতে কাজ করতে হবে। এ তিনটি মূল্যবোধ হচ্ছে প্রচুর কাজ, দক্ষ কাজ ও সম্মিলিত কাজ। নারী-পুরুষকে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তিমূলক যৌথ আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রাচারে মনোযোগী হবার উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোন দেশের জাতীয় নীতির একটি অংশ হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি। রাষ্ট্রের জাতীয় নীতির যে অংশটুকু বহির্বিশে^র সঙ্গে সুদৃঢ় ও ন্যায় ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মানবীয় স্বার্থগুলো সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়, সেটাই পররাষ্ট্রনীতি। আধুনিক বিশ্ব সভ্যতায় কোন রাষ্ট্রই এককভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। দেশে দেশে গণতন্ত্রের আবহাওয়া। কোন সামরিকতন্ত্র, রাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র, আমলাতন্ত্রকেন্দ্রিক রাষ্ট্র সার্বিক অর্থে এগিয়ে যেতে পারে না। মিয়ানমার এক সময় পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধিশালী দেশ ছিল। ভারতবর্ষের মানুষ রেঙ্গুনে কর্মসংস্থান করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করত। সেই মিয়ানমার প্রায় ৭০ বছরের বেশি সময় টানা সামরিকতন্ত্রে দেশ পরিচালিত হয়ে আসছিল। আউং সান সুচির নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও কার্যত রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক তন্ত্রেরই আধিপত্য। গণতন্ত্রের মোড়কে সামরিক আইনই বলবত রয়েছে মিয়ানমারে। দীর্ঘকাল বিশ্ব বিচ্ছিন্ন একটি রাষ্ট্র ছিল মিয়ানমার। তবে বর্তমানে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন না থাকলেও তাদের সুনির্দিষ্ট কোন পররাষ্ট্রনীতি আছে বলে মনে হয় না। যদি থাকত, তবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সসম্মানে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিক মর্যাদা দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সমাজ গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা চাইত। পৃথিবীতে আজ আধুনিক বিশ্বের সভ্যতার জয়জয়কার। এ সভ্যতারও একদিন পতন হয়ে যাবে যদি বিশ্ব বিবেক মানবিক মূল্যবোধহীন হয়ে পড়ে। বিশ্ব বিবেকে মানবিক মূল্যবোধ জেগে উঠুক- শেখ হাসিনা ন্যাম সম্মেলনের ভাষণেও সে মেসেজটি দিয়েছেন। বাংলাদেশ আজ বিভিন্ন পর্বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আবার এই এগিয়ে চলার মধ্যে নানা শঙ্কাও কাজ করছে। তাই সমন্বিত সৃজনমুখী আন্দোলনের ওপর জোর দিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। মানবসভ্যতা ও সম্মিলিত মানবীয় প্রচেষ্টা ছাড়া আন্তর্জাতিক কোন ফোরাম তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। আজ এ কথা জোর দিয়ে বলতে হচ্ছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ফোরামে এ যাবত যতগুলো ভাষণ দিয়েছেন, তার তাৎপর্য বিশ্লেষণে এ সত্যটিই প্রতীয়মান হয়েছে। বিশ্বে যা অশুভ, যা অকল্যাণকর- তার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীর প্রাণিজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে মানবজাতি। মানবজাতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কখনও উৎকৃষ্ট লোক হয় এবং খুবই শান্তিপ্রিয় হয়। তারাই আবার কখনও কখনও আগ্রাসী দুর্বৃত্ত ও মারমুখী। আগ্রাসী মনোভাব দূর করে মানুষকে আরও শান্তিপ্রিয় হয়ে উঠতে হলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে সে মূলমন্ত্রকে প্রতিপাদ্য বিষয় করেই ন্যাম সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটি মানবিক বার্তা বহন করেই আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণ করে আসছেন। ন্যাম সম্মেলনেও এর ব্যতিক্রম করেননি। বিপদ মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে হয়, এটাই হওয়া উচিত মানবজাতির মহান শিক্ষা। লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক [email protected]
×