ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নুসরাত তাসনুফা চৌধুরী

গ্রেটা থুনবার্গ -এক পরিবেশযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২৯ অক্টোবর ২০১৯

গ্রেটা থুনবার্গ  -এক পরিবেশযোদ্ধা

এ সপ্তাহ পুরোটাই কাটল বাঙালী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল প্রাপ্তির আনন্দ নিয়ে। এ যে বাঙালীর গর্ব। তবে এ বছর মনোনীত হয়েও শান্তিতে নোবেল পাননি এমন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়ে কথা না বললেই নয়। যিনি কিনা এবার নোবেল পেলে হতে পারতেন ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী, সে খেতাব মালালার দখলেই রইল। হ্যাঁ, গ্রেটা থুনবার্গের কথাই বলছি। এ বছর মার্চের ১৩ তারিখ, শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাকে মনোনীত করেন সুইডিশ এবং নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্টের ৫ জন সংসদ সদস্য। এই মর্মে যে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিকট ভবিষ্যতে যুদ্ধবিগ্রহ এবং শরণার্থী সঙ্কটের একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং গ্রেটার এই পরিবেশ আন্দোলন বিশ্বের নীতি নির্ধারকদের এ ব্যাপারে সচল হতে বাধ্য করছে। এ্যাসপারগার সিনড্রোম নামের একটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত সুইডিশ টিনেজার গ্রেটা, গত বছর আগস্ট মাসে স্কুল বাদ দিয়ে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে বসে তিনি আন্দোলনের সূচনা করেন। ২০১৮ ছিল সুইডেনের ২৬২ বছরের ইতিহাসে উষ্ণতম গ্রীষ্মের বছর। সে বছর মে মাসে তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের আয়োজিত ক্লাইমেট চেঞ্জ রচনা প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছিলেন। তার লেখা রচনাটি খবরের কাগজে প্রকাশিত হলে; ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে সক্রিয় থাকা একটি গ্রুপ তাকে তার বক্তব্য প্রকাশের একটি প্ল্যাটফর্ম দিতে এগিয়ে আসে এবং এখানেই গ্রেটা স্কুল পড়ুয়াদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা পান। দুঃখের বিষয় প্রথমে তিনি কাউকেই পাশে পাননি, কিন্তু একাই লিফটলেট আর প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে বসেছিলেন জাতীয় সংসদ রিক্সদ্যাগের বাইরে। তিন সপ্তাহ লাগাতার প্রতিদিন তিনি ‘School strike for climate’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসেন, তার দাবি ছিল সুইডিশ সরকার যেন প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে পদক্ষেপ নেয়। তবে বন্ধুরা পাশে না থাকলেও, শত দোষের ভাগী এ যুগের সোশ্যাল মিডিয়া কাজে দিল তার। ইন্সটাগ্রাম আর টুইটারে তার ছবি পোস্ট করাতে দারুন সাড়া পেলেন মিস থুনবার্গ। পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে সক্রিয় সুইডিশ একটি সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির ফাউন্ডার তার ফেইসবুক এ্যাকাউন্ট এবং পেজে গ্রেটার প্ল্যাকার্ডসহ ছবি প্রকাশ করলে গ্রেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সংস্থার নজরে আসে। ২০১৮-এর ডিসেম্বর মাস আসতে আসতে গ্রেটার এই আন্দোলনে যোগ দেন বিশ হাজার স্কুল শিক্ষার্থী, সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশিত তার বিভিন্ন পাব্লিক স্পিচ দেশ ও মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে তার ফলোয়ার সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে। ২০১৯ এর মার্চে গ্রেটা আবার নিয়মিত স্কুল শুরু করে এবং প্রতিদিনের বদলে প্রতি শুক্রবার রিক্সদ্যাগের সামনে বসতে শুরু করেন যেখানে চেনা অচেনা আরও অনেক শিক্ষার্থীরা তার সঙ্গে যোগ দেয়। ভাইরাল হয় হ্যাশট্যাগ ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার, ১০৫টি দেশের ১৫০০ এরও বেশি কিশোর ছাত্রছাত্রী বিক্ষোভ মিছিল করেন। কথায় আছে Charity starts at home, এ আন্দোলন শুরুর আগেই গ্রেটা ঘর থেকে ব্যক্তিগত ভাবে পরিবেশবাদী হয়ে ওঠেন। নিজে ভেজিটেরিয়ান হন, বাবা-মাকে উড়োজাহাজে যাতায়াত করা থেকে বিরত থাকতে সম্মত করেন। গ্রেটার পরিবার গ্রেটার ডিজওর্ডারের কারণে তাকে আনন্দ বা সন্তুষ্টি দেয় এমন কোন কিছুতে বাধা দেননি। তখন হয়ত তারাও বোঝেননি তাদের মেয়ের নাম বিশ্বের কাছে এভাবে পরিচিত হবে, বিভিন্ন পুরস্কার এবং সম্মাননা গ্রেটা পেয়েও নেবেন না শুধু তা নিতে আকাশ পথ পাড়ি দিতে হবে বলে। গ্রেটা নিজেই কি টের পেয়েছিলেন যে নোবেল পুরস্কারের জন্য কখনও তার নাম মনোনীত হবে? গ্রেটা থুনবার্গ নামটি মাত্র এক বছরের মাথায় বিশ্বের হর্তাকর্তা ব্যক্তিদের জন্য একটি কুইনাইন টনিকে পরিনত হয়! সোজা মুখে কড়া কথা বলা এই ষোড়শী যেমন প্রশংসিত হয়েছেন তেমনি নিন্দা ও উপহাসও কুড়িয়েছেন ট্রাম্প, পুতিন এবং ম্যাখোর মতো নেতাদের থেকে। এ্যাসপারগার সিনড্রোমের জের ধরে তার পদক্ষেপকে খাটো করা হয়েছে। কোন হ্যারাজমেন্ট, মকারি বা পেট্রোনাইজেশন গ্রেটাকে দমাতে পারেনি। বর্তমানে তিনি স্কুল থেকে এক বছরের স্যাবাটিকালে আছেন। এই আগস্টে তিনি পরিবেশবান্ধব নৌযানে চড়ে উত্তর আমেরিকা পাড়ি জমান। পনের দিন লাগিয়ে যুক্তরাজ্য পৌঁছান, বিভিন্ন কনফারেন্স ও সামিটে যোগ দেন এবং ২৭ সেপ্টেম্বর কানাডার মন্ট্রিলে ক্লাইমেট র‌্যালির নেতৃত্ব দেন, এটি ছিল মন্ট্রিল শহরের ইতিহাসে বৃহত্তম প্রতিবাদ সম্মেলন। বিশ্বব্যাপী যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন তা ‘গ্রেটা ইফেক্ট’ নামে পরিচিত হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন তাকে, ২০১৮-এর one of the 25 most influential teenagers এবং 2019 এর one of the 100 most influential people-এর তালিকায় স্থান দেয়। পরিবেশ বিষয়ক পুরস্কার ও স্কলারশিপ পেয়েছেন যার অর্থ তিনি জলবায়ু দূষণে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করে এ রকম চারটি সংস্থাতে দান করেন। যত রকমভাবে কার্বন ডাই–অক্সাইড কম নিঃসরণ করা যায়, তার সবই করছে সে। বক্তৃতা দিচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সব সমাবেশে। লিখেছে বই। এ বছর প্রকাশিত নো ওয়ান ইজ টু স্মল টু মেক আ ডিফরেন্স নামের বইটি থেকে যত টাকা আয় হয়েছে, তার সবই সে দান করেছে পরিবেশ রক্ষার কাজে। এই আন্দোলন তাকে এনে দিয়েছে বিকল্প নোবেলখ্যাত ‘রাইট লাইভলিহুড’ পুরস্কার। কিশোরী গ্রেটার কৃর্তির ফর্দ ইতোমধ্যে বেশ খানিকটা লম্বা এবং তা আরও লম্বা হচ্ছে। তাতে নোবেল যোগ না হওয়াটা তেমন গায়ে না মাখলেও চলে। এমনও মত কেউ কেউ প্রকাশ করেছেন যে, তার নোবেল না পাওয়াটাই এই আন্দোলনের জন্য শ্রেয়। গ্রেটা পুরস্কারের আশায় তার যাত্রা শুরু করেননি, এত অর্জনের পরও এখনও তার লক্ষ্যে স্থির আছেন, আর তা হলো- আশানুরূপ কার্যক্রম শুরু হতে না দেখা পর্যন্ত পরিবেশের তথা পৃথিবীর ভবিষ্যতের পক্ষে সরব থাকা এবং সবাইকে সরব রাখা।
×