ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরিযায়ী পাখিদের বাধ্য করে দক্ষিণে উড়তে, সেই শুরু আর থামেনি ॥ প্লেস্টোসিন যুগের হিমবাহ

প্রকাশিত: ১০:২৭, ২৮ অক্টোবর ২০১৯

 পরিযায়ী পাখিদের বাধ্য করে দক্ষিণে উড়তে, সেই শুরু আর থামেনি ॥ প্লেস্টোসিন যুগের হিমবাহ

সমুদ্র হক ॥ পাখিদের নিয়ে রহস্য ৫ কোটি বছর আগে থেকেই পাখিদের মাইগ্রেশন ও পুনরায় আবির্ভাবের আরও রহস্য। আদিকালে এই রহস্যাবৃতকে বলা হতো জাদু। সুমেরু ও কুমেরুর প্রাচীন উপজাতিরা মনে করত পাখি মানুষের আত্মার ধারক। বিজ্ঞানীরা আজও রহস্যের সেই জাল ভেদ করতে পারেনি, যেটুকু পেরেছে তা শুধুই সাময়িক অভিপ্রয়াণে (মাইগ্রেশন) পরিযায়ী পাখি, দেশে ওরা অতিথি। বরফ আচ্ছাদিত সাইবেরিয়া, যেখানে প্রাণ ধারণের উপকরণ ও আশ্রয়ের চরম সঙ্কট সেখান থেকে সাগর মরুভূমি ও বহু পথ পেরিয়ে পাখিরা উড়ে আসে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়। কেউ কেউ যায় আরও দূরে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড। যেখানে বন ও জলাশয়ের অবস্থান পাশাপশি। উত্তর গোলার্ধ ও প্লেস্টোসিন সময়ের হিমবাহ পাখিদের বাধ্য করেছিল দক্ষিণে উড়তে। এরপর অভিপ্রয়াণের এই ধারা আর থামেনি। আগে শ্যামল বাংলাদেশে বছরের নির্ধারিত সময়ে এসে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থেকে ফিরে যেত। এখন থাকে আরও বেশিদিন। কিছু কিছু থেকেও যায়, ওরা পরে দেশের পাখিদের দলভুক্ত হয় পাখিদের সমাজে অতিথি হয়ে। গত ক’বছর ধরে শীতের অনেকটা আগেই পরিযায়ী পাখিরা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে। একটা সময় এসব অতিথি জলচর পাখি নির্দিষ্ট কিছু জলাশয়ে আসত। বেশি আসত সিলেট সুনামগঞ্জ মৌলভীবাজারের হাওড়গুলোয়। পরিযায়ী জলচর পাখিদের জন্য এখন বাংলাদেশের ২৮ আন্তর্জাতিক স্থান স্বীকৃত ছিল। এর দক্ষিণের সাগরে এরা নামত। যেসব জায়গায় নামত এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চর মনপুরা, উড়িরচর মুহুরী ড্যাম, নিঝুম দ্বীপ, পতেঙ্গা সৈকত, সোনাদিয়া, মহেশখালী দ্বীপ, আইলার বিল বাইক্কা হাওড়, হাকালুকির হাওড়, টাঙ্গুয়ার হাওড়। ইদানীং এর বাইরে আরও অনেক এলাকা যুক্ত হয়েছে। পরিযায়ী পাখিরা এখন আর আগের এক জায়গায় থাকে না। উড়ে উড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায় কিছুটা সময় থেকে আবার ফিরে যায় নিজ ভূমে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ভেতরের লেক খুবই পছন্দ পরিযায়ী পাখিদের। ৭২০ একর আয়তনের জাবি ক্যাম্পাসের গাছগাছালি ও তিনটি বড় জলাশয় (লেক) নিসর্গের বিদ্যায়তন ভূমিতে পরিণত এখানে। সত্তর দশকের শেষে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক কয়েক হাজার পথ পাড়ি দিয়ে এখানে পৌঁছে যেন খুঁজে পায় ওদের স্বর্গভূমি। প্রতিবছরই ঝাঁকে ঝাঁকে এসব অতিথি পাখি আসতে থাকে জাবির লেকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজমের ছাত্রী ও পাখিপ্রেমী শৌখিন আলোকচিত্রী শ্রাবণী শারমিন প্রতিবছরই পাখিদের ছবি তোলেন। টেলিস্কোপে পাখিদের দেখে নতুন কোন পাখি এলো কিনা তা পরখ করেন। জাবির জনসংযোগ বিভাগের উপ-পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ সুমন (আহমেদ সুমন) জানালেন বিশ^বিদ্যালয়ের তিনটি লেককে আর ইজারা দেয়া হয় না। লেকের বড় বড় মাছ অনেক সময় পাখিদের পায়ে ঠোকর দিয়ে আহত করে। এই লেক এখন পাখিদের অভয়ারণ্য। ’৮৮ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ^বিদ্যালয়ে পাখিমেলা ও শিক্ষামূলক পাখি দর্শনের আয়োজন করা হয়। টেলিস্কোপে পাখি দেখে যে যতটা পাখির নাম লিখবে তাদের পুরস্কৃত করা হয়। শিশুদের চিত্রাঙ্কনে যে পাখি দেখে নাম লিখে ছবি আঁকতে পারে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। ১৯৮৮ সালে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মোস্তফা ফিরোজের উদ্যোগে প্রথম জনসংযোগ বিভাগের সহযোগিতায় পাখি মেলার উদ্বোধন করেন পাখি বিশারদ ইনাম আল হক। এক সময় অবশ্য ঢাকা চিড়িয়াখানার দুটি লেকে পাখি আসত। এখন আর তেমন দেখা যায় না। মাইগ্রেটরি বার্ড অভিপ্রয়াণে একই পাখি থাকে কিনা তা প্রথম পরীক্ষা করেন ১৮৯০ সালে ডেনমার্কের পাখিবিজ্ঞানী এইচসি মটেনসেন। তিনি ল্যাঞ্জা হাঁসের পায়ে ব্যান্ড বেঁধে গতিপথ আবিষ্কারের কাজ করেন। পরে সফল হন। বিংশ শতাব্দীতে ভারতের জাতীয় অধ্যাপক ড. সালিম আলী (প্রয়াত) মুম্বাইয়ের বাড়ির আঙিনায় খঞ্জনা পাখির পায়ে রিং পরিয়ে দেন। ওই পাখি নাকি বহু বছর তার বাড়িতে আসত। পরিযায়ী পাখি বিষয়ে গবেষণায় অংশ নিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন এ্যান্ড নেচার (আইইউসিএন), বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, বন বিভাগ ও সুইডেনের লিলিয়ান। তারা গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের ৪৪ পরিযায়ী পাখির শরীরে অবস্থান নির্ণয়ক যন্ত্র (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম ট্র্যাকার) বসিয়ে দেয়। এই পাখিগুলোর কয়েকটি হিমালয় পাড়ি দিয়ে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ বাংলাদেশে পৌঁছে। কিছু পাখি ভারতের অসমের গুয়াহাটির ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অতিক্রম করে। একটি পাখি পাবনার সুজানগরের পদ্মভূমিতে ফিরে এসেছে। কিছু পাখি ভারতের অরুণাচল,মিজোরাম ও সেভেন সিস্টার্সে রাজ্যগুলোয় অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশের কয়েকটি হাওড় ও জাবি ক্যাম্পাসে ওরা আসে। এই পাখিরা এ বছর মে পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিল। আগে থাকত মার্চ পর্যন্ত। জিপিএস ট্র্যাক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে শুধু রাশিয়ার সাইবেরিয়া নয় ইদানীং মঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের মালভূমি, তিব্বতের একটি অঞ্চল, কোরিয়া, ফিলিপিন্স, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের তীব্র শীত প্রধান অঞ্চল থেকেও পাখি আসছে বাংলাদেশে। সাগর মহাসাগর পাহাড় বনভূমি মরুভূমি পেরোনোর সময় পরিযায়ী পাখিদের পথ চিনতে একটুও ভুল হয় না। বিস্ময়কর তাদের দিগদর্শন। গবেষণায় দেখা গেছে, দেহজ গ্রন্থি, আলোকরশ্মি, বাতাসের গতি, রাতে আকাশের তারা, ভূমির গন্ধ ও আকৃতির সঙ্গে জিও ম্যাগনেটিজম বিষয়টি পাখিদের একটি জিনগত প্রক্রিয়া। এরা কয়েক হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয়ার আগে শরতে বেশি করে খাবার খেয়ে পালকে শক্তি সঞ্চয় করে। আকাশে উল্টো তীরের আকৃতিতে ওড়ে। সামনে অথবা পেছনে থাকে গাইড পাখি। যারা এর আগে বাংলাদেশে এসেছিল, তারাই নেতৃত্ব দিয়ে পরিযায়ী পাখিদের পথ চিনিয়ে আনে। এভাবে প্রতি বছরই গাইড পাখি তৈরি হয়। জন্মের পর ছানাকে মা পাখি শিখিয়ে দেয় এক সময় অনেক পথ উড়ে ভিন দেশে যেতে হবে। শীতকালে চরে দেশী কানি বক ধুপানি বকসহ কয়েক প্রজাতির বক পাখি দেখা যায়। এরা অতিথি পাখিদের স্বাগত জানায় । চখাচখি, সরালি, ল্যাঞ্জা, বালি হাঁস সঙ্গী হয়ে জোটে। এসব পাখি এক সময় পরিযায়ী ছিল। এখন দেশী পাখির আত্মীয়। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে নীলশীর ল্যাঞ্জা, পাতারি, পিয়ং গিরিয়া, আবাবিল, কালা হাঁস, গিরিয়া হাঁস,পান্তামুখী, ক্রেনকুট, এক ধরনের পেলিক্যান, হেরিয়ার, ফ্যালকন, ওয়ার্বলার, কেস্ট্রোল, ফ্লাই ক্যাচার, ফ্লেমিংগো, ডুবুরি, গাছ কবুতর, প্লোভায়, নাইরাল ইত্যাদি আমাদের দেশে আসে। আছে দেশী পাখি নামের কিছু বিদেশী পাখি। যেমন পানকৌড়ি, রাজহাঁস, মানিকজোড়, খঞ্জনা। দেশে আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি মিলিয়ে প্রায় ৬শ’। আড়াইশ’ প্রজাতি পরিযায়ী। এই পরিযায়ীদের কয়েক প্রজাতি ফিরে যায় না, থেকে যায় এই দেশেই। জাবি ক্যাম্পাসে অন্তত ৬৪ প্রজাতির পাখি সারাবছর থাকে। বার্ড ক্লাব সূত্র জানায় আগের বছরের তুলনায় গত বছর এক লাখ পরিযায়ী পাখি বেশি এসেছে। এর বড় অংশ থেকেছে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। আইইউসিএনের গবেষকরা বলছেন দেশে অতিথি পাখি অবস্থানের সংখ্যা বাড়ছে। এদের নির্বিঘ্নে চলাচল, অভয়ারণ্যের পরিবেশ রক্ষা, শিকারির কবল থেকে রক্ষা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে। বরেণ্য পাখি বিশারদ জোয়েন পিটার্সের ভাষায় “ওয়ানস বার্ডস ওয়্যার গডস টু মেন/ম্যাজিক্যাল স্ট্রেঞ্জ এ্যান্ড ওয়াইজ। নাউ মেন আর ডেভিলস টু দেম অন আর্থ, অন সি, ইন স্কাইস।”
×