ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অভিজিৎ ব্যানার্জীরা ব্র্যাকের আল্ট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন মডেল নিয়ে গবেষণা করেই এবার অর্থনীতিতে পুরস্কার পেলেন;###; ৭ বছর ধরে বিশ্বের ৬ দেশে এই মডেল নিয়ে গবেষণা হয়েছে;###; বিশ্বের ৭০ কোটি অতি দরিদ্র মানুষের আশার আলো হতে পারে এই মডেল

নোবেল জয়ে বাংলাদেশ ॥ দারিদ্র্য বিমোচনে ব্র্যাকের কর্মসূচী

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২৭ অক্টোবর ২০১৯

নোবেল জয়ে বাংলাদেশ ॥ দারিদ্র্য বিমোচনে ব্র্যাকের কর্মসূচী

কাওসার রহমান ॥ অর্থনীতিতে এবারের মর্যাদাকর নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে গেল বাংলাদেশের নামও। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের ‘মডেল’ দিয়েই এসেছে এবারের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার। অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী, এসথার ডুফলো ও মাইকেল ক্রেমার দারিদ্র্য বিমোচনের যে মডেল নিয়ে গবেষণা করে এবার নোবেল পুরস্কার পেলেন সেই মডেলটি বাংলাদেশ ভিত্তিক বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের। ব্র্যাকের ‘আল্ট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন মডেল’ নিয়ে গবেষণা করেই এই তিন অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিতে এবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ব্র্যাক এ প্রসঙ্গে বলছে, তাদের এ মডেলটির ওপর গবেষণা তাদের দারিদ্র্য বিমোচন বিষয়ক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অভিজিৎ ও তার সহযোগী গবেষকদের দারিদ্র্য বিষয়ক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশই হলো ব্র্যাকের আল্ট্রাপুওর গ্র্যাজুয়েশন মডেল। তাছাড়া এই মডেলটি বিভিন্ন দেশের স্থানীয় পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে সেখানকার হতদরিদ্র মানুষের অবস্থা পরিবর্তনে কিভাবে কাজে লাগানো সম্ভব সে বিষয়ে তাদের গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে। অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী, এসথার ডুফলো এবং মাইকেল ক্রেমারকে নোবেল দেয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে সেটি হলো দারিদ্র্য বিমোচনে তাদের পরীক্ষানির্ভর গবেষণা পদ্ধতি। অভিজিৎ ব্যানার্জী ও এসথার ডুফলো তাদের একটি বইয়ে অবশ্য বলেছেন, ‘দিনে সোয়া এক ডলার বা তার চেয়ে কম আয় করা চরম দরিদ্রদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনা খুবই কঠিন।’ অবশ্য তাদের গবেষণায় তারা সেই চেষ্টাই করেছেন যাতে করে দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে মানুষকে বের করে আনার উপায় বের করা যায়। আর এজন্য তারা দারিদ্র্য বিমোচন বা নিরসনের এতদিনকার তাত্ত্বিক উপায় থেকে বেরিয়ে এসে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। আর এক্ষেত্রে তারা গবেষণা করেছেন বেশ কয়েকটি দরিদ্র দেশে। ব্র্যাকের এই আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচী ২০০২ সালে বাংলাদেশে চালু হয়। দেশের ৪৭ জেলায় অতি দরিদ্রদের মাঝে এ কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে। কর্মসূচীর বাস্তবায়ন কার্যক্রম মূল্যায়ন করে দেখা গেছে, এই কর্মসূচী থেকে উপকৃতরা ৪ বছর পরও তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নতির ধারা বজায় রাখতে সমর্থ হচ্ছেন। অতি দরিদ্রদের দারিদ্র্য নিরসনে অত্যন্ত কার্যকর হওয়ায় দেশের বাইরে অনেক এনজিও, বেসরকারী সংস্থা ও সরকার এই কর্মসূচী নেয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। ব্র্যাকের এই মূল ডিজাইন বা মডেলটি বর্তমানে বিশ্বের ৪০ দেশের বড় বড় এনজিও বাস্তবায়ন করছে। এসব দেশে ১০০টি প্রকল্পের মাধ্যমে এই ‘আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন’ কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে। এরমধ্যে কতগুলো দেশে ব্র্যাক নিজে বাস্তবায়ন করছে। তবে বেশির ভাগ দেশেই ব্র্যাক এই কর্মসূচী বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে মূল মডেল হচ্ছে ব্র্যাকের। সেই মডেলটিকে সেসব দেশের উপযোগী করে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এজন্যই এই মডেল দেশে দেশে সফলতা অর্জন করছে। এটাই এই আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচীর বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক এ্যাডভোকেসি উপমা মাহবুব বলেন, যে সকল দেশে এই মডেল বাস্তবায়িত হয়েছে সেখানে খুব ভাল ফল পাওয়া গেছে। অতি দরিদ্রদের জন্য এই মডেল খুব কার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় বৈশ্বিকভাবে এটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতি দরিদ্রদের দারিদ্র্য নিরসনে তাদের তাছে এটি একটি টেকসই মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। এজন্য বিশ্বব্যাংকের সিগ্যাপ ও ফোর্ড ফাউন্ডেশন বিশ্বের অন্য দেশেও এটি সফল হয় কি না তা দেখার চেষ্টা করে। এজন্য বিশ্বের ৮টি দেশে এই মডেলের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটিকে মডেল নিয়ে গবেষণার দায়িত্ব দেয়া হয়। এমআইটি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক অভিজিৎ ব্যানার্জী ও এসথার ডুফলোকে এই মডেল পরীক্ষার জন্য নিয়োগ দেয়। তারা মাইকেল ক্রেমারকে সঙ্গে নিয়ে এক সৌদি ব্যবসায়ীর অর্থে পরিচালিত এমআইটির আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি এ্যাকশন ল্যাবে গবেষণাটি করেছেন। অভিজিৎ ব্যানার্জী, এসথার ডুফলো এবং মাইকেল ক্রেমার ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাত বছর ধরে বিশ্বের ছয়টি দরিদ্র দেশের ওপর এই মডেলের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করেন। দেশগুলো হচ্ছে - ইথিওপিয়া, ঘানা, হন্ডুরাস, ভারত, পাকিস্তান ও পেরু। গবেষণায় তারা দেখেছেন, এই মডেল ওইসব দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে খুব ভাল ফল দিচ্ছে। এটি যে একটি টেকসই কর্মসূচী সেটিও প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণেই বাংলাদেশের ৪৭টি জেলার পাশাপাশি বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে এ কর্মসূচী চলছে। অভিজিত ব্যানার্জীরা গবেষণা করেছেন দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে মানুষকে বের করে আনার উপায় নিয়ে। আর এজন্য তারা দারিদ্র্য বিমোচন বা নিরসনের এতদিনকার তাত্ত্বিক উপায় থেকে বেরিয়ে এসে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। অভিজিৎ ব্যানার্জী বলেছেন, শুধু অর্থ দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করলে সেটি টেকসই হবে না। দারিদ্র্যের কারণগুলো ছোট ছোট করে ভেঙ্গে দেখতে হবে। প্রবেশ করতে হবে এর গভীরে। দেখতে হবে আসলে দরিদ্রদের প্রকৃত চাহিদা কি? সেই চাহিদা অনুযায়ী দেশ উপযোগী মডেল দাঁড় করাতে হবে। দারিদ্র্যের বড় ক্যানভাসকে ভেঙ্গে দেখা ॥ এই গবেষকরা দারিদ্র্যের বিশাল ক্যানভাসটি ভেঙ্গে ভেঙ্গে গবেষণাগারে পরীক্ষা করেছেন। তারা কৃত্রিমভাবে পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করেছেন এবং দারিদ্র্যের কারণগুলো ভেঙ্গে এর ভেতরে ঢুকে বিশ্লেষণ৬ করে পলিসি সাজেশন দিয়েছেন-এটাই তাদের বিশেষত্ব। একেক এলাকায় একেক ধরনের দারিদ্র্য। তাদের অর্থ দিয়ে তারা কি করবে? এ ধরনের ছোট ছোট ভাগে ইস্যুগুলো বের করে তারা দেখেছে যে আসলে কোথায় জোর দিতে হবে। অর্থাৎ যেসব কারণে দারিদ্র্য হয় সেই কারণগুলোর ভেতরে ঢুকে বিশ্লেষণ করা এবং সে মোতাবেক কয়েকটি দেশকে নীতি পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে এতদিনকার যেসব ধারণা এসেছে সেগুলোর চেয়ে এ ধারণা নতুন ও সম্পূর্ণ আলাদা। এর ফলে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলোতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে গবেষকরা মনে করছেন। উপমা মাহবুব বলেন, আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন মডেল নিয়ে অভিজিৎ ব্যানার্জীরা বিশেষ গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা করেছেন। এই গবেষণা পদ্ধতি ছয়টি দেশে প্রয়োগ করেছেন। সেই প্রয়োগ থেকে তারা যে লার্নিং পেয়েছেন সেগুলো আবার প্রয়োগ করে দেখেছেন তা ঠিক আছে কি না। তারপর তারা পলিসি সুপারিশ করেছেন। তিনি বলেন, এটি ব্র্যাকের জন্য খুবই ভাল হল। এতে এই কর্মসূচী নিয়ে দারিদ্র্য নিরসনে দেশে দেশে আরও আগ্রহী তৈরি হবে। বর্তমান বিশ্বের প্রধান সমস্যা দারিদ্র্য। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৭০ কোটি মানুষ এখনও চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছে। যারা তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। এই বিশাল দরিদ্র জনসংখ্যার বড় অংশেরই আয় ১.৯০ ডলারের নিচে। এ কারণে জাতিসংঘের সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) প্রথম লক্ষ্যই হচ্ছে দারিদ্র্য নিরসন। যাকে ‘নো পভারটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতিসংঘ চাইছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে কোন চরম দারিদ্র্য থাকবে না। এই দারিদ্র্য নিরসন নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন গবেষণা হচ্ছে। গবেষণা হচ্ছে টেকসই দারিদ্র্য নিরসনের পন্থা নির্ধারণ নিয়ে। এ নিয়ে গত দুই দশকে বিশ্বজুড়ে গবেষকরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করেছেন। অবশ্য এ টেকসই দারিদ্র্য নিরসনের যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ থেকেই। বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক কিংবা ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও এই অতি দারিদ্র্য নিরসনের উপায় উদ্ভাবন করে প্রশংসিতও হয়েছে। এরমধ্যে ২০০২ সালে ব্র্যাকের উদ্ভাবিত ‘আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম’ এখন পর্যন্ত অতি দারিদ্র্য নিরসনে একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে দেশ-বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ব্র্যাকের দারিদ্র্য নিরসনের এই মডেল নিয়ে প্রায়োগিক গবেষণা করেই নোবেল পেয়েছেন অভিজিৎ ব্যানার্জী ও তার সঙ্গীরা। এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের চেয়ারপার্সন ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে আগের গবেষণা বা কাজগুলোর সঙ্গে অভিজিৎ ব্যানার্জী, এসথার ডুফলো ও মাইকেল ক্রেমারের কাজের পার্থক্য হলো এতে দর্শন বা তত্ত্বকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রায়োগিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জোর দেয়া হয়েছে। যদিও এর সীমাবদ্ধতা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে, তারপরও এখানে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীর ডিজাইন ও তা সফল হচ্ছে কি না তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। এক কথায় কোন কোন পদক্ষেপে দারিদ্র্য আরও দ্রুত নিরসন করা যায় সেটিই এবারের নোবেলজয়ীরা বের করার চেষ্টা করেছেন। এ প্রসঙ্গে দ্য রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস বলেছে, তাদের নতুন নিরীক্ষাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়ন অর্থনীতিতে রূপ নিয়েছে, যা এখন গবেষণার নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। ব্যানার্জী-ডুফলো-ক্রেমারের কাজের বিশেষত্ব ॥ ধরুন কোন এলাকার মানুষ দরিদ্র। স্বাভাবিকভাবে সেখানকার মানুষজন তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর বদলে কোথাও কাজে দিয়ে অর্থ পেতে আগ্রহী থাকেন। এই গবেষকরা বলছেন, এই অভিভাবকদের কিছু অর্থ দিলে হয়তো তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন। কিন্তু তারা এই পরামর্শ দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তারা তাদের গবেষণায় নির্দিষ্ট এলাকা থেকে নমুনা ব্যক্তি বাছাই করে তাদের অর্থ দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন যে সেটি আসলেই কাজ করছে কি না। অর্থাৎ এই গবেষকরা দেখার চেষ্টা করেছেন দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যে কোন ধরনের শিক্ষা দরকার এবং কি করলে মানুষ তাদের সন্তানদের শিক্ষা নেয়ার জন্য পাঠাবে। আবার ধরুন একটি দরিদ্র এলাকায় মানুষ কৃষিকাজ করছে। সেই এলাকার লোকদের শহরে আসার বাসের টিকেট দেয়া হলো। এই টিকেট দেয়ার পর এই গবেষকরা দেখার চেষ্টা করেছেন যে ওই টিকেট ব্যবহার করে মানুষগুলো তাদের পণ্য নিয়ে শহরে যেতে উৎসাহী হচ্ছে কি না এবং গেলে তাদের লাভ হচ্ছে কি না। হোসেন জিল্লুর রহমান বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচন করতে হলে দার্শনিক জায়গা নয় বরং অবকাঠামোগত কিছু সংস্কার কর্মসূচীর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করতে হবে, এটিই এবারের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদরা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীর ডিজাইন এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে কোন অংশের কারণে সফল হচ্ছে বা হচ্ছে না সেটার জন্য পদ্ধতিগত অভিনবত্ব এনেছেন তারা। যেমন ধরুন দারিদ্র্য বিমোচন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কোথাও একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খোলা হলো এবং এর পরিচালন সময় নির্ধারণ করা হলো সকাল আটটা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত। কিন্তু ওই এলাকার মানুষ বা সম্ভাব্য যারা সেবাগ্রহীতা হবেন তাদের সেবা নেয়ার সময় হয় বিকেলে। তাহলে দেখা গেলো উদ্যোগ ভাল হলেও সময় নির্ধারণে ভুলের কারণে সেটি কোন কাজে লাগল না। আবার স্কুল থেকে শিশুরা ঝরে পড়ছে কেন এটি দেখতে গিয়ে তারা দেখেছেন যে কর্মসূচীর ডিজাইন বা রূপরেখায় ভুল আছে কি না, সেক্ষেত্রে তারা ডিজাইনের বিভিন্ন উপাদানের ওপর জোর দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা সেবাগ্রহীতা এবং গ্রহীতা নন এমন দু’ক্ষেত্রেই পরীক্ষা করেছেন এবং এর ফল নিয়ে গবেষণা করেছেন। এবারের নোবেলজয়ী তিন অর্থনীতিবিদের কাজের বৈশিষ্ট্য হলো: ১. তারা একটি কর্মসূচীর রূপরেখা তৈরি করছেন এবং ২. সেটি ঠিক মতো কাজ করছে কি না তা বোঝার জন্য গবেষণার পদ্ধতিতে নতুনত্ব এনেছেন। আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচীর ওপর গবেষণায় নোবেল পুরস্কার আসায় ব্র্যাকও গর্বিত। এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক এ্যাডভোকেসি উপমা মাহবুব বলেন, এই মডেলের গুরুত্বপূর্ণ অংশই হলো লার্নিং বা শিখন। যেটা আমরা নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকেও পেয়েছি। সেই লার্নিং নিয়ে প্রতিনিয়ত এই মডেলকে আপডেট করা হচ্ছে। কারণ ২০০২ সালের গরিব ও ২০১৭ সালের গরিব এক রকম নয়। প্রতিনিয়ত তাদের চাহিদা ও বাস্তবতায় পরিবর্তন আসছে। সেই পরিবর্তিত চাহিদার ভিত্তিতে তাদের দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল ডিজাইন করা হচ্ছে। আর এই মডেলটি যে দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে সেই দেশের উপযোগী করে মডেল ডিজাইন করা হচ্ছে। এই কর্মসূচীর ফলাফল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই কর্মসূচীর মাধ্যমে যে সকল অতি দরিদ্র তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি করেছে তা অব্যাহত আছে কি না তা আমরা প্রতিনিয়ত লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকসকে দিয়ে মূল্যায়ন করাচ্ছি। প্রথম ৪ বছর, দ্বিতীয় বার ৭ বছর এবং সর্বশেষ ১১ বছর পর এই তিন দফা মূল্যায়ন করা হয়। এতে দেখা যাচ্ছে, ৯৫ শতাংশ পরিবারই ৪ বছর পরও তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হচ্ছে। চলমান কর্মসূচী প্রসঙ্গে উপমা মাহবুব বলেন, বর্তমানে আমাদের ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল মেয়াদী একটি কর্মসূচী চলছে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ৪ লাখ পরিবারের দারিদ্র্য নিরসন। এ লক্ষ্যে আমাদের বেশ ভাল অগ্রগতি হচ্ছে এবং আশা করছি, বছর শেষে আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চরম দারিদ্র্য নিরসনে আমাদের একটি অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জিত হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা আমরা বড় পরিসরে কাজে লাগাতে চাই। আমরা সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করতে চাই। দারিদ্র্য নিরসনের বিষয়ে আমাদের ভাল লার্নিং হয়েছে। এই লার্নিংগুলো আমরা সরকারকে দিতে চাই। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দেশে প্রতিবন্ধী ও শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। আমরা তাদের নিয়ে কাজ করতে চাই।
×