ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিভাগীয় তদন্ত শুরু

ডিসির চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল সেই মুক্তিযোদ্ধার পরিবার

প্রকাশিত: ১০:০৩, ২৭ অক্টোবর ২০১৯

 ডিসির চাকরির  প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান  করল সেই  মুক্তিযোদ্ধার পরিবার

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি অবহেলার ঘটনায় প্রশাসনের দেয়া রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ফেরত দেয়ার একদিন পর দিনাজপুরের জেলা প্রশাসকের দেয়া চাকরির প্রস্তাব ফেরত দিয়েছে মরহুম মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। এদিকে মুক্তিযোদ্ধার প্রতি অবহেলার ঘটনায় তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে বিভাগীয় প্রশাসন। তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এসিল্যান্ড, এডিসি, ডিসি ছেলেকে চাকরিচ্যুত ও বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে। তাই মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা হিসেবে তাদের সালাম/ স্যালুট শেষ যাত্রার কফিনে চাননি মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। মৃত্যুর ২ দিন আগে মুক্তিযোদ্ধার লিখে যাওয়া এমন চিঠির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয় দিনাজপুর সদর উপজেলার ৬ নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ি গ্রামের মরহুম মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনকে। এ ঘটনায় যখন দিনাজপুর তোলপাড় ঠিক তখনই ওই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে চাকরি দেয়ার জেলা প্রশাসকের আশ্বাসও প্রত্যাখ্যান করেছে মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রী নুরনেহার বেগম, ছেলে নুর ইসলামকে চাকরি দেয়ার কথা জানায়। কিন্তু সেই চাকরি নেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। মরহুম মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নুর হোসেন বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেরদিন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে বাবাকে কথা বলতে দেয়া হয়নি। সেই ঘটনার পর বাবা অসুস্থ হয়ে যান এবং পরবর্তীতে মারা যান। জেলা প্রশাসক আমার ভাই নুর ইসলামকে চাকরি দেয়ার আশ্বাস দিলেও আমরা সেই চাকরি নেব না। মরহুম মুক্তিযোদ্ধার আরেক ছেলে নুরুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ সম্মানটুকু না নিয়ে আমার বাবা বিদায় নিয়েছে। এই চাকরি আমরা কেন নেব? জেলা প্রশাসক এসেছেন তাকে সম্মান দেয়া হয়েছে। কিন্তু উনার দেয়া চাকরি তো আমরা নিতে পারি না। কারণ, দুই মাস পর যে আবার চাকরি থেকে বের করে দেবে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে? আমরা সরকারের প্রতিনিধি হুইপ ইকবালুর রহিমের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। এদিকে মুক্তিযোদ্ধার প্রতি অবহেলা ও রাষ্ট্রীয় সম্মান ছাড়া দাফনের ঘটনায় তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শনিবার দুপুরে বিভাগীয় কমিশনার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেন ঘটনা তদন্তে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে যান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লোকমান হাকিম, দিনাজপুর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক গোলাম নবী দুলাল। এ সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা জাকির হোসেন জানান, বিষয়টি নিয়ে সরকার সচেতন। মরহুম মুক্তিযোদ্ধার লিখিত ওছিয়তের ভিত্তিতে আমি ঘটনা তদন্তে এসেছি। ভিকটিম ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়েছি। নুর ইসলামকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, তদন্তে যারা দোষী প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের সহমুক্তিযোদ্ধা মনসুর আলী বলেন, আমার মামার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এমন ঘটনা খুব খারাপ। মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া সরকারের দায়িত্ব ও আমাদের জন্য বড় পাওয়া। কিন্তু আমরা এমন পাওনা থেকে কেন বঞ্চিত হলাম। এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার দাবি করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অবহেলা করা মোটেও ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার লোকমান হাকিম বলেন, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নেননি। এই দুঃখ রাখি কোথায়? উল্লেখ্য, শেষ ইচ্ছা চিঠির মোতাবেক বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা (গার্ড অব অনার) ছাড়াই দাফন করা হয় দিনাজপুর জেলা সদর উপজেলার ৬ নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ি গ্রামের মরহুম মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনকে। মৃত্যুর পর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের শেষ বিদায়ের সময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে গেলেও পরিবার ও এলাকাবাসী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সেখানে বাজাতে দেয়া হয়নি বিগউলে সুর ও জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করতে দেয়া হয়নি মরদেহ। মৃত্যুর ২ দিন পূর্বে তিনি ওছিয়ত হিসেবে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের বরাবরে একটি চিঠি লিখে যান। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির সুপারিশে ছেলে নুর ইসলামের নো ওয়ার্ক নো পে ভিত্তিতে সদর উপজেলা ভূমি কমিশনারের (এসিল্যান্ড) গাড়ি চালক হিসেবে চাকরি হয় গত ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। চাকরিক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ছেলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা হুইপ ইকবালুর রহিমকে জানালে তিনি বিষয়টি এডিসিকে দেখতে বলেন। হুইপকে বিষয়টি অবগত করায় প্রশাসন থেকে প্রথমে নুর ইসলামকে তার বসবাসরত খাস পরিত্যক্ত বাড়ি ছাড়ার নোটিস দেয়া হয়। গত মাসে এসিল্যান্ড আরিফুল ইসলাম তাকে বিভিন্ন অজুহাতে চাকরিচ্যুত করেন। এরপরও চাকরি ফেরত না পাওয়ায় জেলা প্রশাসককে জানাতে গেলে জেলা প্রশাসক তার ওপর ক্ষিপ্ত হন। তিনি আরও লিখেছেন, জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে নিয়ে করা স্বাধীন দেশে আমার ছেলের রুজি-রোজগারটুকুও অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া হলো। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত, বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম/ স্যালুট আমার শেষ যাত্রার কফিনে আমি চাই না। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২২ অক্টোবর চিঠিটিতে তিনি স্বাক্ষর করে ডাকযোগে ঢাকায় জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির বরাবরে প্রেরণ করেন। পরের দিন ২৩ অক্টোবর বেলা ১১ টায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর বেলা ১১ টায় তার জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।
×