ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাভের বদলে লোকসান গুনতে হচ্ছে

বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করে নামমাত্র উৎপাদনে বিপাকে উদ্যোক্তা

প্রকাশিত: ১০:০২, ২৭ অক্টোবর ২০১৯

 বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করে নামমাত্র উৎপাদনে বিপাকে উদ্যোক্তা

রশিদ মামুন ॥ বিদ্যুত কেন্দ্রের নামমাত্র উৎপাদনে বিপুল আয়ের বদলে লোকসান গুনছেন উদ্যোক্তা। লোকসান কমাতে বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে উৎপাদন বৃদ্ধির আবেদন নিবেদন করেও ভাল কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্যোক্তা বলছেন আয় তো হচ্ছেই না উল্টো পকেট থেকে পয়সা খরচ করে কেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন এই পরিস্থিতি চললে কেন্দ্রের ভবিষ্যত হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এত দিন সরকার বিদ্যুত না নিয়ে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেয়ায় আর্থিক ক্ষতির কথা আলোচনা হচ্ছিল। এবার বিদ্যুত কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ করা হলো। বলা হচ্ছে কেন্দ্রের চুক্তি করার সময় দুটি অংশ থাকে একটি হচ্ছে প্রকল্পের ফিক্সড কস্ট বা স্থায়ী ব্যয় এর সঙ্গে পরিচালন এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয় ধরে ইউনিট প্রতি একটি অংশ দেয়া হয় উদ্যোক্তাকে। যাকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বলা হয়। কেন্দ্র বিদ্যুত উৎপাদন করুক বা না করুক এই অর্থ সরকার পরিশোধ করে। অন্য অংশটি হচ্ছে জ¦ালানি ব্যয়। এটি পিডিবি থেকে দেয়া হয়। কেন্দ্র প্রতিমাসে যে পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করে তার ভিত্তিতে জ¦ালানির দাম পরিশোধ করা হয়। পাওয়ার প্যাক মুতিয়ারা কেরানীগঞ্জ পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রন হক শিকদার সম্প্রতি বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে একটি চিঠি লিখেছেন এতে বলা হয়েছে চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুত কেন্দ্রটির ৮০ ভাগ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে (একটি কেন্দ্র যে ক্ষমতায় বিদ্যুত উৎপাদন করে তাকে প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর বলা হয়) চলার কথা। কিন্তু বাস্তবে গত চার মাস বিদ্যুত কেন্দ্রটি মাত্র ১৩ দশমিক ৮১ ভাগ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চলেছে। আর এই চার মাসের আগের ছয় মাসে কেন্দ্রটির গড় প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর ছিল তিন দশমিক ৬০। দেশে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুত কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় সব কেন্দ্রের কাছ থেকে সমানভাবে বিদ্যুত কিনতে পারছে না পিডিবি। এতে কোন কোন কেন্দ্র একেবারেই চালানো হচ্ছে না। বিশেষ করে যে কেন্দ্রগুলো ডিজেলে বিদ্যুত উৎপাদন করছে সেগুলো থেকে উৎপাদন কমানো হয়েছে। সরকার লোকসান কমাতে এই উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি বিদ্যুত সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস বলেছেন বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডিজেল ভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সামিট গাজীপুর পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোজাম্মেল হোসাইন বলেন, প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর নিয়ে আমাদের এখনও জটিলতা তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, গাজীপুরে আমাদের দুটি প্রকল্প একটি ৪০ ভাগ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চলছে আরেকটিও গত মাসে ৪০ ভাগের কাছাকাছি প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চলেছে। তিনি বলেন, প্রত্যেকের সঙ্গে পৃথক পৃথক চুক্তি হয়েছে। এক্ষেত্রে কোথায় কার ব্রেক ইভেন পয়েন্ট তা বলা কঠিন। পিডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রগুলো যে প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে বিদ্যুত উৎপাদনের চুক্তি করে সেই প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে কখনওই উৎপাদন করে না অথবা পিডিবিও ওই প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে বিদ্যুত নেয় না। কিন্তু তাই বলে একেবারে ১০ থেকে ১৫ ভাগ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে বিদ্যুত উৎপাদন করলে কেন্দ্রগুলোর লোকসান হবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, এখন কেন্দ্র নির্মাণের আগে শুধুমাত্র সরকার চাইল আর তারা নির্মাণ করল বিষয়টি এভাবে না দেখে তিনি বিনিয়োগ করবেন যিনি বিনিয়োগ কতটা সুরক্ষিত তার হিসাবও তাকে করতে হবে। তিনি বলেন, এখন চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুত কেন্দ্র থাকার পরও বিনিয়োগকারীরা কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে আসছেন। কেনারীগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্ট লিমিটেডের তরফ থেকে জানানো হয়, গত বছর ১৮ নবেম্বর থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যুত কেন্দ্রটির গড় প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর ছিল ৩ দশমিক ৬৩ ভাগ। অর্থাৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা প্রতিদিন ১০০ মেগাওয়াট হলে চুক্তি অনুযায়ী ৮০ ভাগ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে সে গ্রিডে ৮০ মেগাওয়াট লোডে বিদ্যুত দেবে। কিন্তু দেখা গেছে কেন্দ্রটি ছয় মাস ধরে গড়ে ৩ দশমিক ৬৩ মেগাওয়াট লোডে বিদ্যুত সরবরাহ করেছে। এতে করে কেন্দ্রটি অতিরিক্ত ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করায় এক কোটি ৭৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৮২ টাকা লোকসান করেছে। একই ভাবে গত মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত কেন্দ্রটির গড় প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর ছিল ১৩ দশমিক ৮১। এতে করে আরও ক্ষতি হয়েছে ৮২ লাখ ৩০ হাজার ৫৭২ টাকা। কেন্দ্রটি কম প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চলার কথা উল্লেখ করে গত ১৬ জুন পিডিবি চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠিতে কেন্দ্রটির প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর ৪০ এ উন্নীত করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু আশানুরূপ উৎপাদন বৃদ্ধির কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়। কোন কেন্দ্র শূন্য চাহিদার সময়ও অর্থাৎ একেবারে যখন বিদ্যুত গ্রিড নেয় না তখনও কিছু সিস্টেম চালু রাখতে হয়। সিস্টেমগুলো চালু রাখতে আবার গ্রিড থেকে বিদ্যুত নিতে হয়। সেই টাকা আবার বিদ্যুত বিল থেকে কেটে রাখে পিডিবি। উদ্যোক্তা বলছেন এভাবেও লোকসান গুনছেন তারা। রন হক শিকদার চিঠিতে জানান, কেন্দ্রটির পরিচালন এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ চার মাসে ২ লাখ ১৮ হাজার ডলার দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ এক কোটি ৮৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিমাসে এই খরচ বাবদ ব্যয় হচ্ছে দুই কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত চার মাসে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পাওয়ার পরও কেন্দ্রটি প্রতিমাসে ২২ লাখ টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগের অপর একজন কর্মকর্তা জানান, বিদ্যুত কেন্দ্র বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিয়ে তার খরচ উঠে আসার কথা। এক্ষেত্রে পিডিবির সঙ্গে যে ক্রয় চুক্তি হয়েছে সেখানে দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। ওই কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পাওয়ার জন্য উদ্যোক্তা কিছু কিছু জায়গায় খরচ কমিয়ে দেখানোতে এমন হতে পারে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তা হয়তো মনে করেছিলেন এভাবে খরচ কমিয়ে দেখিয়ে তিনি কাজটি পেয়ে যাবেন। এরপর কেন্দ্র চললে এই লোকসান তিনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু কেন্দ্রটি যখন চলছেই না তখন সামান্য লোকসানও জমতে জমতে এখন সেই অঙ্ক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানতে চাইলে পিডিবির প্রাইভেট জেনারেশন প্রধান প্রকৌশলী মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিয়ে উদ্যোক্তার সব খরচ উঠে আসার কথা। অনেক ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা ইউনিট প্রতি দামের মধ্যে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের (ভেরিএ্যাবেল অপারেশন এ্যান্ড মেইনটেনেন্স কস্ট) হিসেবে এদিক সেদিক করে ফেলেন সেক্ষেত্রে এমন সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে আমাদের আসলে কিছুই করণীয় নেই।
×