ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ক্রিকেট প্রশাসনে একটা ঝাঁকুনি দরকার ছিল’

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২৭ অক্টোবর ২০১৯

‘ক্রিকেট প্রশাসনে একটা ঝাঁকুনি দরকার ছিল’

মিথুন আশরাফ ॥ দাবি-দাওয়া নিয়ে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে ক্রিকেটাররা হঠাৎ করেই আন্দোলনে নামলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনও কঠিন হুঁশিয়ার উচ্চারণ করলেন। এরপর দুইপক্ষই সভায় বসে সমঝোতায় আসল। বিসিবি দাবি-দাওয়া মেনে নিল। ক্রিকেটাররাও ক্রিকেটে ফিরলেন। উত্তাপময় তিনদিন শেষে আবার ক্রিকেট প্রাণ ফিরে পেল। কিন্তু এখন কী হবে? সত্যিই কি দাবি-দাওয়া সঠিকভাবে পূরণ হবে? ক্রিকেটাররা কী স্বস্তিতে থাকতে পারবেন? বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী মনে করছেন, ক্রিকেটারদের স্বস্তিতে থাকা উচিত। সেই ব্যবস্থা ক্রিকেট প্রশাসনকেই, বোর্ডকেই করতে হবে। তবে যা হয়েছে তাতে ক্রিকেট প্রশাসনে একটা ঝাকুনি মিলেছে। যে ঝাঁকুনি আসলে দরকার ছিল। ক্রিকেটারদের আন্দোলন ও শেষ পর্যন্ত সমাধান নিয়ে সাবের হোসেন আরও অনেক কথাই বলেছেন। তা তুলে ধরা হলো। প্রসঙ্গ ॥ আন্দোলন... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেকদিন ধরে একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল, তা বোঝা গেল। সংবাদ সম্মেলনও (সোমবার) হঠাৎ করে ফেলল। ক্রিকেট প্রশাসনে আসলে একটা ঝাঁকুনি দরকার ছিল। যেটা ক্রিকেটাররা দিল। প্রসঙ্গ ॥ ক্রিকেটারদের ভুল... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ আমি মনে করি, আগে বিসিবিকে দাবিগুলো চিঠি দিয়ে জানালে ভাল হতো। প্রসঙ্গ ॥ বোর্ডকর্তাদের ভুল... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ বোর্ড কর্তারা তো আগেই ভুল করেছেন। যা তাদের ঠিক করার কথা। তা নিয়ে আন্দোলন হলো। বেতন, পারিশ্রমিক, ভাতা, সুবিধা আগেই আরও বাড়ানো উচিত ছিল। আন্দোলনের পর এখানে বোর্ড কর্তারাও একটা ভুল করে বসল, তারা পাল্টা একটা সংবাদ সম্মেলন করল। পরবর্তীতে যখন বসল (বুধবার রাতে), তখন কিন্তু খুব দ্রুত এক দেড় ঘণ্টার মধ্যেই সমাধান হয়ে গেছে। বোর্ড যদি দ্বিতীয়দিন সেই কাজ (সংবাদ সম্মেলন) না করত, সংবাদ সম্মেলন না ডেকে তাদের (ক্রিকেটারদের) ডাকত, সবার যেটা প্রত্যাশা ছিল, বোর্ড হচ্ছে অভিভাবক, খেলোয়াড়রা তো অভিভাবকদের অধীনে, খেলোয়াড়রা যে আচরণ করবে একই আচরণ তো অভিভাবকের কাছ থেকে আমরা আশা করি না, এই জায়গাটায় আসলে একটা বড় ভুল হয়ে গেছে। প্রসঙ্গ ॥ বোর্ড-ক্রিকেটারদের মধ্যে দূরত্ব... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ বড় একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে। ক্রিকেট প্রশাসন বা বোর্ড বা খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। আমি কিছুটা অবাক হলাম, ক্রিকেট বোর্ডে অনেক সাবেক অধিনায়ক আছে, প্রাক্তন খেলোয়াড় আছে, এখানে অনেক বড় ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সভাপতি (বিসিবি) যেটা বললেন, আমি স্তম্ভিত, আমি হতাশ। তার মানে কোন ধারণাই ছিল না যে এরকম ঘটনা ঘটবে। তাতেই বোঝা যাচ্ছে বড় ধরনের দূরত্ব ছিল। প্রসঙ্গ ॥ এখন পরিবর্তন... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ ক্রিকেট বোর্ড এতদিন যে পথে ছিল, সেখান থেকে ক্রিকেটাররা অনেক মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। ক্রিকেটাররা শুধু তাদের সুযোগ-সুবিধা না, খেলার কাঠামো, ক্রিকেট উন্নয়নের পথও দেখিয়ে দিয়েছেন। এই কাজগুলো অনেক আগে ক্রিকেট বোর্ডেরই করার কথা ছিল। কিন্তু বোর্ডকর্তারা সেইভাবে চিন্তা করেনি, তাই এরকম অবস্থার তৈরি হয়েছে। ক্রিকেটের মধ্যে দুর্নীতি অনিয়ম আছে। সকল ক্ষেত্রে। ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালকরা ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছে। টিভি স্বত্ব, স্পন্সর, কেনাকাটা, লজিস্টিক্স, সবকিছুর মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক মৌসুম ধরে প্রিমিয়ার লীগের লীগ টেবিলে ঘুরে ফিরে কয়েকটি দলই সুপারলীগে থাকছে। কিভাবে? সবকিছুই আসলে এর আগে ক্রিকেট উন্নয়নের জন্য নয়, নিজেরা যেন ক্ষমতায় থাকতে পারে, এজন্য করেছে। এই রকম চললে একটা সংঘর্ষ তো তৈরি হবেই। হয়েছেও। এখন তারা (ক্রিকেট প্রশাসন) কতটুকু বাস্তবায়ন করবে, করতে পারবে, বাস্তবায়ন করতে গেলে ক্রিকেটে এক ধরনের সুশাসন চলে আসবে। সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতাও থাকতে হবে। কতটুকু তারা পারবে সেটাই দেখার। আশাকরি তারা পারবে। ক্রিকেটের স্বার্থে তাদের পারতে হবে। প্রসঙ্গ ॥ আয়ের ভাগ... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ যখনই খেলোয়াড়দের আয়ের অংশ দেবেন, তখন এ্যাকাউন্টসে একটা স্বচ্ছতা আসতে হবে। এখন শত শত কোটি টাকার একটা বাজেট, একটা সিএফও (চীফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার) নাই, কিভাবে নিয়ন্ত্রন হয়? এজিএমে পাঁচ মিনিটে শত শত কোটি টাকার হিসেব পাস হয়ে যায়। কেউ কোন প্রশ্ন করছে না। খেলোয়াড়দের আয়ের ভাগ দিলে এ্যাকাউন্টসে স্বচ্ছতা আসবে। প্রসঙ্গ ॥ পরিবর্তন আরও জায়গায়... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ ক্রিকেট বোর্ডে এখন প্রাতিষ্ঠানিক ম্যাচ ফিক্সিং হয়। বোর্ডের একজন পরিচালক যদি আম্পায়ারকে নির্দেশনা দিয়ে দেয়, যে এই টিম জিতবে, এই টিম হারবে, এটা তো প্রাতিষ্ঠানিক ফিক্সিং হয়ে গেল এবং কারা ফিক্স করছে? যারা খেলা পরিচালনা করে। যারা ওভারঅল ক্রিকেটের দায়িত্বে। এগুলো আসলে ভয়াবহ। এখন সামনে হয়তো আরও অনেক কিছু বের হতে পারে। কাউন্সিলরদের পর্যন্ত সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের ভেতরেও শুদ্ধি অভিযান চলছে। এমপিদের কয়েকজনকেও বলে দেয়া হয়েছে তারা বিদেশ যেতে পারবে না। সেখানে লোকমান (ভুঁইয়া) সে স্বীকার করল, মানিলন্ডারিংয়ের কথা স্বীকার করল, তাকে এখনও বোর্ডে রেখে দিয়েছে। সে ছিল লজিস্টিক্সের চেয়ারম্যান। শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রজেক্টের সে হচ্ছে পরিচালক। ফোকাস আসলে কাজে নেই। ফোকাস অন্য জায়গায় হয়ে গেছে। এই জিনিসগুলো কোন স্বস্তির জায়গা তৈরি করে না। প্রসঙ্গ ॥ ব্যক্তিগত বিষয় আনা... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ উনি (বিসিবি প্রেসিডেন্ট) পরের দিন হাসিমুখে ছিল, তাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর, যেহেতু জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে সমাধান কর, তার আগেরদিন তো বলেছে খেললে খেলবে না খেললে নাই। পরেরদিন বলল, আস, বসে আছি। তাছাড়া উনি একটা ভুল করেছেন, ক্রিকেটারদের যে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তা সামনে তুলে এনেছেন। উনি অভিভাবক। করতেই পারেন। উনার কাছেই তো ক্রিকেটাররা যাবে। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সামনে তুলে ধরেছেন। এভাবে কেউ বলে? প্রসঙ্গ ॥ ক্রিকেটারদের স্বস্তি... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ এখন সামনে কি হবে, তা দেখার অপেক্ষা। সমঝোতা তো হলো। কিন্তু ভেতরে আসলেই দাবি-দাওয়া মানার বাইরে কি হবে, তা সামনেই বোঝা যাবে। সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরা এখন আছেন। একটা সময় অবসর নেবেন। তখন কী হবে? কিংবা এ ক্রিকেটারদের ফর্ম খারাপ হলে কী হবে? এ বিষয়গুলোও আসতে পারে। উনার জন্য বড় একটা পরাজয় হয়েছে। এই পরাজয় কী এত দ্রুত ভুলে যাবেন? ভুলে গেলেই ভাল। তাতে ক্রিকেট ভালভাবে চলবে। ক্রিকেটের উন্নতি হবে। যেটা আমরা সবাই চাই। ক্রিকেট প্রশাসনে বড় ধরনের একটা ঝাঁকুনি দরকার ছিল। সেটি হলো। যেভাবে চলছিল, খেলোয়াড়রা একটা ঝাঁকুনি দিল। এরকম হওয়া কাম্য ছিল না। যেহেতু হয়েছে। এখন এটার ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে হবে। এখন সবকিছুতে স্বচ্ছতা এবং ক্রিকেট অবকাঠামো থেকে সব জায়গায় উন্নতির ছাপ মিললেই হলো। প্রসঙ্গ ॥ সবার চাহিদা এক... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ খেলোয়াড়রা নিজেদের নয়, পুরো ক্রিকেটের উন্নতির চিন্তা করেছে। যেটা বোর্ডের অনেক আগেই করা উচিত ছিল। প্রসঙ্গ ॥ ষড়যন্ত্র... সাবের হোসেন চৌধুরী ॥ ষড়যন্ত্র হচ্ছে বললেন বিসিবি সভাপতি। যড়যন্ত্রকারীদের বের করে দেখাবেন বললেন। কয়েকদিনের মধ্যে উন্মোচন হয়ে যাবে, বললেন। উনার ওপর একটা দায়িত্ব এসে পড়ল ষড়যন্ত্রকারীদের বের করে দেখানোর। ক্রিকেট ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রকারীদের অবশ্যই বের করা উচিত। আমরা ষড়যন্ত্রকারীদের এবং তাদের নাম জানার জন্য অপেক্ষায় আছি।
×