ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলা নাট্য উৎসবের ৪টি প্রযোজনায় কাজ করেছি ॥ শিশির রহমান

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ২৭ অক্টোবর ২০১৯

 বাংলা নাট্য উৎসবের ৪টি প্রযোজনায় কাজ করেছি ॥ শিশির রহমান

শিশির রহমান। বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক প্রতিভা, মঞ্চনাটকের তরুণ মেধাবী মুখ। শিশির রহমান একাধারে অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার, নির্দেশক, সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক। অসংখ্য নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি সমানতালে নির্দেশনা দিয়েছেন। রচনা করেছেন একাধিক নাটক। তবে সব কিছু ছাপিয়ে গেছে তার দরদী কণ্ঠে মৌলিক গানের সুর। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও অসংখ্য মঞ্চনাটকে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মুন্সীগঞ্জের এই কৃতী নাট্যজন। বর্তমানে ঢাকার ৪টি মিলনয়াতনে একযোগে চলছে মহাকালের বাংলা নাট্য উৎসব। এই উৎসবে অন্তত ৪টি নাটকের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত শিশির রহমান। উৎসবে অংশ নেয়া ৪টি নাটক এবং ক্যারিয়ারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। মহাকাল নাট্য উৎসবে অংশ নেয়া নাটকগুলোতে আপনার সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাই। শিশির রহমান : মহাকালের উৎসবে আমার অভিনীত, নির্দেশিত ও সঙ্গীত পরিকল্পনায় ৪ দিনে ৪টি নাটক প্রদর্শিত হচ্ছে। এর মধ্যে ২৩ অক্টোবর মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় নাট্যম রেপার্টরি ঢাকা প্রযোজিত নাটক ‘দমের মাদার’। এই নাটকে আমি অভিনয়ের পাশাপাশি গানের সুর ও সঙ্গীত সঞ্চালনা করেছি। ২৪ অক্টোবর এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চায়ন হয় শব্দ নাট্য চর্চা কেন্দ্রের ‘চম্পাবতী’। এ নাটকের লাইভ মিউজিক সঞ্চালন ও সঙ্গীত পরিচালনা করি। আজ ২৭ অক্টোবর এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে থিয়েটার সার্কেল, মুন্সীগঞ্জের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ নাটক মঞ্চস্থ হবে। নাটকটির নাট্যরূপ, নির্দেশনা, ব্যবহৃত গানের সুর, সঙ্গীত ও পুঁথি পাঠের কাজ করছি। এছাড়া আগামী ৩০ অক্টোবর মহিলা সমিতি মঞ্চে অনুরাগ থিয়েটার প্রযোজিত ‘গ্রাস’ নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। নাটকটির নির্দেশনা ও আবহ সঙ্গীতের কাজ করেছি। এক উৎসবে আপনার একাধিক নাটক, অনুভূতি কেমন? শিশির রহমান : আমি খুবই ক্ষুদ্র একজন মানুষ। খুব যে প্লান করে করা হয়েছে তা না এটা কাকতালীয় ভাবে ঘটেছে। যে সব দলে এই কাজগুলি করেছি, তাদের একে অপরের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে। আমারও নানা ভাবে তাদের সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ হয়েছে। এই উৎসবে তা কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। আমি এই উৎসবকে ঘিরে অনেকটাই উচ্ছ্বসিত। খুবই ভাল লাগছে। এ পর্যন্ত কতগুলো নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন, অভিনীত নাটকে সংখ্যাই বা কত? শিশির রহমান : ১৯৯২ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭টি নাট্য দলে (মুন্সীগঞ্জ থিয়েটার, থিয়েটার সার্কেল মুন্সীগঞ্জ, নাট্য প্রয়াস, পেট্রোবাংলা ড্রামা ক্লাব, অনুরাগ থিয়েটার, সুশীলন সাতক্ষীরা, এবং প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলের ২৫টি মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা দেয়ার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে, ‘মেরাজ ফকিরের মা’, ‘এখানে নোঙর’, ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ, ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘জমিদার দর্পণ’, ‘মধুমালা মদন কুমার’, ‘ডাকঘর’, ‘১৯৭১’, ‘নৃপতি’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ অন্যতম। এছাড়া আমার লেখা নাটক ‘পদ্মা পাড়ের কথকতা’, ‘গোয়েন্দার বারো বছর’,‘নিলামের বাজার’, ‘পঞ্চ ভূতের রঙ্গ তামাশা’, ‘জল মহলায় নীল সমাধী’, ‘আমাদের লায়লী মজনু’, ও ‘বিবাদী সারগাম’ উল্লেখযোগ্য। আমার অভিনীত নাটকের সংখ্যা প্রায় ৩০টির মতো। এর মধ্যে ‘পদ্মা পাড়ের কথকতা’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’, ‘এখানে নোঙর’, ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’, ‘জমিদার দর্পণ’, ‘শ্যামা প্রেম’, ‘রক্ত করবী’,‘স্বদেশী’, ‘লোকনায়ক’, ‘দমের মাদার’। নিজ দলের বাইরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রযোজিত নাটকে অভিনয় করেছি তার মধ্যে, ‘গাজী কালু চম্পবতী’, ‘ক্ষেতমজুর খৈমুদ্দিন’, ‘টার্গেট প্লাটুন’, যাত্রাপালা ‘ঈশা খাঁ’, ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, ‘গঙ্গা থেকে বুড়ি গঙ্গা’, ‘সিরাজউদ্দৌলা’, ‘আনার কলি’, ‘বর্গি এলো দেশে’ প্রভৃতি। মঞ্চনাটকের সঙ্গীত নিয়ে কাজ করা কতটা চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন? শিশির রহমান : মঞ্চ নাটকের সঙ্গীত আসলে আমি ৩ ভাবে করে এসেছি। আজকের যুগে সৃজনশীলতা এসেছে। নাটকের দলগুলো তার নাটকের জন্যে নিজস্ব আবহ সঙ্গীত চায়। সেই ভাবনা থেকে গত দুই দশক ধরে আমাদের দেশে মৌলিক আবহ সঙ্গীতের কাজ চলছে। এটা আসলেই একটা চ্যলেঞ্জিং বিষয়, এবং এই কাজটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নিজ দলের বাইরে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি মঞ্চ নাটকের আবহ সঙ্গীত করেছি। সরাসরি ১২টির মতো নাটকের সঙ্গীত পরিকল্পনা ও নির্দেশনার কাজ করেছি। এর মধ্যে ‘লোক নায়ক’, ‘গাজী কালু চম্পাবতী’, ‘মানুষ এবং’, ‘দমের মাদার’, ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘চম্পাবতী’, ‘মধুমালা মদন কুমার’, ‘নারী নসিমন’, ‘রূপ সুন্দরী’, ‘মায়া নদী’ অন্যতম। মঞ্চ নাটকের আবহ সঙ্গীত নির্মাণে সবচেয়ে আনন্দের ও বেদনার জায়গা। বাংলা নাটকে বিশেষ করে লোক আঙ্গীকের নাটকে সরাসরি আবহ সঙ্গীতের বিকল্প নেই। কিন্তু সঙ্গীতে বাদ্যযন্ত্রের কলাকুশলী কম। এ জন্য নাটকের দলগুলো লোক নাটক করা থেকে বিরত থাকে। যারা করেন তারা অনেক কষ্ট স্বীকার করেই করেন। মঞ্চশিল্পী নাকি সঙ্গীতশিল্পী কোনটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? শিশির রহমান : আসলে আমি যখন কোন অনুষ্ঠানে গান গাইতে উঠি সেই মঞ্চখানা আমার জন্যে গানের মঞ্চ। আবার যখন কোন নাটকে অভিনয় করতে উঠি তখন সেইটা আমার কাছে নাটকের মঞ্চ। এমনও দেখা গেছে নাটকের মঞ্চে আমি অভিনয় নয় শুধু গান গাইবার জন্যে আমন্ত্রিত হয়েছি। এক কথায় মঞ্চ আমার কাছে মঞ্চ নাটক বা গান বলে আমি তাকে পার্থক্য করি না। কেননা আমার গান এবং নাটক একই সময়ে শুরু হয়েছে এবং শুরু থেকে গান এবং নাটক সমান তালে করে যাচিছ। দু’শিল্পই আমার কাছে সমান গুরুত্ব বহন করে। কেননা এমন ও হয় যে একটি নাটক লেখা, গান রচনা ও গান সুর করা, সঙ্গীত পরিকল্পনা এবং অভিনয় ও নাটকটির নির্দেশনা আমাকেই করতে হচ্ছে। অতএব কাকে রেখে কাকে বেশি গুরুত্ব দেব। নাটক এবং গান দুটোকেই আমি সমান ভালবাসি। শিল্পী হিসেবে আপনার শুরুর গল্পটা কেমন ছিল? শিশির রহমান : ১৯৭৭ সালে ফরিদপুর খেলাঘর আসরে কবিতা আবৃতির মধ্যদিয়ে এই শিল্পাঙ্গনে আসা। তারপর ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে আমার বাবার চাকরির সূত্রে মাদারীপুরে যাই। বাবা সরকারী চাকরির সূত্রে এক জেলা থেকে আর এক জেলায় যেতেন, আমিও সেই তার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। মাদারীপুর পাবলিক ইনস্টিটিউশনে পড়বার সময় স্কুল বার্ষিক অনুষ্ঠানে ‘ঝাঁসির রানী’ নাটকের মধ্য দিয়ে অভিনয় শুরু। এরপর লৌহজং বেজগাঁও পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে প্রথম গান করি। ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার পর বাবা আবার বদলি হলো মুন্সীগঞ্জ সদরে। এখানে সেই সময় থেকে উদীচী, ঋষিজ সঙ্গীত একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হই। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে একটা নাটকের কর্মশালায় অংশ নেই। সেই কর্মশালার অভিজ্ঞতায় মুন্সীগঞ্জ জুনিয়র থিয়েটার গঠন করি। যা আজ মুন্সীগঞ্জ থিয়েটার নামে পরিচিত।সেই সংগঠনের আমি প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলাম। সেই নাটক লেখা এবং নির্দেশনার মধ্য দিয়ে আমার মূল ধারার নাট্যজীবন শুরু। যা আজও চলছে। থিয়েটার বা সঙ্গীত নিয়ে নতুন কোন প্রযোজনার খবর আছে কী? শিশির রহমান : চলতি কাজের পাশাপাশি ‘আরশি নগর’ নামে লালন ভাব ধারার একটি নাটকের প্রস্তুতি চলছে। আগামী ফেব্রুয়ারির দিকে মঞ্চে আসবে বলে আশা করছি। থিয়েটার বা সঙ্গীত নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? শিশির রহমান : নিজ জেলার থিয়েটার কে বিশে^র অঙ্গনে তুলে ধরতে চাই। আরও যে দল গুলো আছে তাদের সঙ্গে পরামর্শ চলছে। আগামী বছরগুলোতে সব দল মিলে দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শন করার উদ্যোগ গ্রহণ করব। ভাল কিছু নাটক নিয়মিতভাবে প্রদর্শন করার উদ্যোগ নেবো। সঙ্গীত নিয়ে কিছু বিকল্প ধর্মী কাজ করতে চাই। আমাদের এখানে অনেক খেটে খাওয়া লোক আছে যারা অবসরে বেশ ভাল গান করেন। তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মূল ধারায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে। -সাজু আহমেদ
×