ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডঃ মিহির কুমার রায়

নোবেল প্রদীপ যখন দারিদ্র্য বিমোচন গবেষণায়

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ২৭ অক্টোবর ২০১৯

নোবেল প্রদীপ যখন দারিদ্র্য বিমোচন গবেষণায়

অতি সম্প্রতি অর্থনীতি শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে স্টকহোমে দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে এবং এবারের নোবেল বিজয়ী তিন অর্থনীতিবিদ হলেন- অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্তার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার। শ্রী অভিজিত হলেন- দ্বিতীয় বাঙালী যিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন। এর আগে অর্থনীতিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম বাঙালী অর্থনীতিবিদ হলেন- অমর্ত্য সেন যিনি দুর্ভিক্ষ, মানব উন্নয়ন তত্ত্ব, জনকল্যাণ অর্থনীতি ও দারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কার্যকর বিষয়ে গবেষণা এবং উদার নৈতিক রাজনীতিতে অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। শ্রী অভিজিত ১৯৬১ সালে মারাঠী মা নির্মলা ব্যানার্জী ও বাঙালী বাবু দীপক ব্যানার্র্জীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে ৫৮ বছর বয়সী অভিজিতের শিক্ষাজীবন কেটেছে কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুল (১৯৭৫), প্রেসিডেন্সি কলেজ (১৯৮১), নয়াদিল্লীর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৩), মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৮৮)। ব্যক্তিগত জীবনে অভিজিতের দুই স্ত্রী যথাক্রমে : ড. অরুন্ধতী তুলি ব্যানার্জী ও এস্তার ডুফলো এবং দুই সন্তান থাকলেও প্রথম সন্তান কবির ব্যানার্জী ২৫ বছর রয়সে মারা গেছেন। তার দুই স্ত্রীই বর্তমানে এমআইটিতে অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত আছেন। ছাত্র জীবনে অভিজিত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়য়ে পড়ার সময়ে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং এক ছাত্র নেতাকে বহিষ্কার করার কারণে ভিসি অফিস ঘেরাওয়ের ফলে দিল্লীর তিহার জেলে ১৩ দিনের হাজতবাসেরও অভিজ্ঞতা রয়েছে। রবীন্দ্রময় অভিজিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পারেন এবং বাংলা বলার সময় ইংরেজী শব্দের কোন প্রয়োগ নেই, যা অনেকটা চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ও কবি শঙ্ক ঘোষের মতো । অভিজিতসহ আরও দুই গবেষকের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল মূলত দারিদ্র্য বিমোচনে প্রায়োগিক গবেষণা পদ্ধতির উদ্ভাবন/আবিষ্কার যাকে বলা হয় সামাজিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য রেখার সমীক্ষা পদ্ধতি (randomi“ed control trial) যা পূর্বের ধারণাগুলো থেকে স্বতন্ত্র। ২০১৩ সাল থেকে অভিজিত ব্যানার্জী ও এস্তার যুগ্মভাবে ‘আবদুল লতিফ জামিল পোভার্টি এ্যাকশন ল্যাব গড়ে তোলেন। এটি দারিদ্য্র বিমোচনের একটি বৈশ্বিক গবেষণা কেন্দ্র যা ম্যাসচুসেটে অবস্থিত। ২০০৪ সালে অভিজিত আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস এ্যান্ড সায়েন্সের ফেলো নির্বাচিত হন এবং তার প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে ইনফোসিস প্রাইজ (২০০৯), ক্যায়েল ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড ইকোনমির বেনহার্ড হার্মস প্রাইজ (২০১৪) ও নোবেল পুরস্কার (২০১৯) অন্যতম । তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো Poor Economics। এখানে উল্লেখ্য, ১৯০১ সাল থেকে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের উইল মোতাবেক তার নামানুসারে পাঁচটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেয়া শুরু হয় যেখানে অর্থনীতি বিষয়টির উল্লেখ ছিল না। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের তিন শ’ বছর পূর্তিতে নোবেল ফাউন্ডেশনের জন্য একটি বিশাল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেন যে অর্থ নোবেলের সম্মান রক্ষার্থে একটি নতুন পুরস্কার অর্থনীতিতে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি-এর অধ্যাপক দম্পতি যথাক্রমে অভিজিত ও এস্তার ডুফলো ২০০৭ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্র্যাকের আল্ট্রা পুয়োর গ্র্যাজুয়েশন মডেল দিয়ে নিবিড়ভাবে গবেষণা করেছিলেন যার ফলাফল হিসাবে ২০১৫ সালে তাদের গবেষণার ওপর একটি প্রবন্ধ বিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়কী দি ইকোনমিস্ট-এ প্রকাশিত হয়। এ গবেষণার ফল প্রকাশের পর পরই বিশ্বজুরে এই মডেল নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। গবেষকগণ যা বলার চেষ্টা করছিলেন তার মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো (১) এটি একটি পরীক্ষানির্ভর গবেষণা পদ্ধতি, (২) তত্ত্ব বা দর্শনের গুরুত্ব না দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে জোড় দেয়া, (৩) কোন কোন পদক্ষেপ নিলে দারিদ্র্যকে সমাজ থেকে নির্মূল করা যায় তার উল্লেখ, (৪) গবেষণাটি নির্দিষ্ট এলাকায় কোন নমুনা ব্যক্তি বাছাই করে দেখানোর যে চেষ্টা হয়েছিল সেটি আসলে কাজ করছে কিনা : কোন ধরনের শিক্ষার দরকার এবং কি করলে মানুষ তাদের সন্তানদের শিক্ষা দেয়ার জন্য পাঠাবে, (৫) এই ত্রয়ী অর্থনীতিবিদ একটি কাজের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন এবং সেটি সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তা দেখার জন্য গবেষণা পদ্ধতিতে একটি নতুনত্ব এনেছিলেন, (৬) এই গবেষণায় দারিদ্র্য বড় ক্যানভাসে ভাগ করে এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল, তারা কৃত্রিমভাবে পরিস্থিতি তৈরি করছিলেন, মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করেছিলেন ও দারিদ্র্যের কারণগুলো ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে বিশ্লেষণ করে পলিসি সাজেশন দিয়েছিলেন যার মধ্যে মৌলিকত্ব ছিল, (৬) ব্রিটিশ সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধে গবেষকগণ উল্লেখ করেছিলেন দারিদ্র্যের কারণ শুধু অর্থাভাব নয়, অনেক মৌলিক বিষয়ে সম্যক জ্ঞান, আর্থ-সামাজিক সুযোগ-সুবিধা এবং নিজেদের সক্ষমতার ওপর আস্থার অভাব ইত্যাদি। এই প্রেক্ষাপটে গবেষকগণ মনে করেন দারিদ্র্য বিমোচনে যত কর্মসূচী দুনিয়ায় আছে তাতে নির্দিষ্ট এলাকার অল্প কিছু মানুষ অল্প কিছু সময়ের জন্যই উপকৃত হয় এবং এসব কর্মসূচীতে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের অনেকেই দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এলেও দীর্ঘমেয়াদে সেই অবস্থা তারা ধরে রাখতে পারে না। যেমন গরিবের জন্য প্রবর্তিত ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে শুধু তারাই উন্নতি করতে পারে যারা ব্যক্তি হিসেবে উদ্যোগী প্রকৃতির। অতি দরিদ্রদের মধ্যে আবার এ ধরনের উদ্যোগী মানুষের সংখ্যা খুবই কম। একইভাবে শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ বা সাফল্যের জন্য প্রয়োজন কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা। এক দেশে যেটা কাজ করেছে, অন্য দেশে তা করেনি, যার মূল কারণ সংস্কৃতি, পারিপার্শ্বিকতার ভিন্নতা এবং সবচেয়ে দরিদ্র যারা তাদের অবস্থায় পরিবর্তন আনাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। এই বাস্তবতায় অধ্যাপক ব্যানার্জী ও ডুফলো দারিদ্র্য দূরীকরণের এমন একটি কৌশল বের করেছেন, যা সব জায়গায়, সব ধরনের মানুষের জন্য কাজ করবে। তাদের গবেষণাটি করা হয় সাত বছর ধরে, বিশ্বের ছয়টি দেশের প্রায় ১০ হাজার দরিদ্র পরিবারের ওপর। এ কৌশলের অংশ হিসেবে ওই পরিবারগুলোকে প্রথমে কিছু সম্পদ (মূলত গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি) হস্তান্তর করা হয়। এরপর তাদের দেয়া হয় কিছু নগদ অর্থ সহায়তা। সবশেষে দুই বছর ধরে তাদের নানা রকম প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ দেয়া হয়, যাতে তারা সেই সম্পদগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে। ঘানা, পাকিস্তান ও পেরুর মতো কয়েকটি দেশে দেখা গেছে, এই ফর্মুলায় একেবারে হতদরিদ্র মানুষের জীবনে একটা দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অতি দারিদ্র্য দূর করার এ কৌশলটির মূল উদ্ভাবক বাংলাদেশের বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। সংস্থাটি এর নাম দিয়েছে ‘গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম’। ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামেও দরিদ্র্যদের হাঁস-মুরগি দেয়া হয়েছিল, কিছু নগদ অর্থ সাহায্য (consumption assistance) দেয়া হয়েছিল, প্রশিক্ষণও (training) দেয়া হয়েছিল যাতে সেই হাঁস-মুরগির আয় থেকে অতি দরিদ্ররা দায় শোধ করতে পারে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা বার বার তাদের বাড়িতে গেছেন, নিয়মিত তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে চেষ্টা করেছেন, আয়ের একটি অংশ কিভাবে সঞ্চয় করা যায় তাও শিখিয়েছেন। এমআইটির গবেষক অভিজিত, ডুফলো এবং তাদের আরেক সহযোগী স্থানীয় এনজিওগুলোর সাহায্যে এ মডেল নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন ইথিওপিয়া, ঘানা, হন্ডুরাস, ভারত, পাকিস্তান ও পেরুতে। সব জায়গাতেই অতি দরিদ্রদের এই কর্মসূচীর আওতায় আনা হয়। ভারতে যে পরিবারগুলো এ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে তাদের ৭৩ শতাংশ ছিল অতি দরিদ্র, যা ইথিওপিয়ায় ছিল ৬৬ শতাংশ অতি দরিদ্র। তাদের সবার দৈনিক আয় ছিল ১ দশমিক ২৫ ডলারের কম। সার্বিক ফলাফলে দেখা যায় যে অংশ গ্রহণকারী পরিবারগুলোর পরীক্ষার অংশ হিসেবে দরিদ্র পরিবারগুলোকে আয় বর্ধনমূলক সম্পদ অনুদান হিসেবে দেয়া হয়। এক বছরের জন্য প্রতিদিন চাল ক্রয়ের জন্য অর্থ দেয়া হয়, প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ও উপার্জনের একটি অংশ সঞ্চয়ে আনার পরামর্শ দেয়া হয়। এই কর্মসূচীর দুই বছর মেয়াদ শেষে দেখা গেল সেই পরিবারগুলোর জন্য খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে ৫ শতাংশ, সম্পদদের পরিমাণ বেড়েছে ১৫ শতাংশ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে দৈনিক ১৭ মিনিট করে বেশি কাজ করছে তারা। তবে এই ফলাফলের ভিন্নতা আছে বিভিন্ন দেশে। একটি ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা সম্পর্কে অভিজিত বলেন, ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ যেমন চীন, কানাডা ও ভারতে পরীক্ষা চালানো হয়েছে প্রায় ২০ বছর ধরে এবং সার্বিক ফলাফলের সারাংশ হলো দারিদ্র্য কোন সমস্যা নয়। বাস্তবে এর অনেক স্তর রয়েছে এবং সম্যসাগুলোকে একে একে খুঁজে বের করে সমাধানের পথ কি হবে তা নির্ধারণ করে দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান সম্ভব। নোবেল কমিটি বিবেচনা করে দারিদ্র্য লাঘবের অবদানের জন্য ত্রয়ী অর্থনীতিবিদকে এবার অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেয়, যা উন্নয়ন অর্থনীতির অংশ। লেখক : ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি
×