ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদিতে প্রাণনাশের শঙ্কা প্রকাশ করেও বাঁচতে পারলেন না নাজমা

প্রকাশিত: ১০:২৬, ২৬ অক্টোবর ২০১৯

 সৌদিতে প্রাণনাশের শঙ্কা  প্রকাশ করেও বাঁচতে  পারলেন না নাজমা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বারবার নিজের প্রাণনাশের আশঙ্কা প্রকাশ করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ করেছিলেন নাজমা বেগম (৪০)। তার অনুনয় বিনয় কেউ শোনেনি তখন। দালালরা আরও উল্টো হুমকি দিয়েছে তার পরিবারকে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরিণাম খারাপ হবে বলেও ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়ে নাজমার পরিবার। তার আর্তনাত কেউ শোনেনি। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে নাজমার লাশ আসে ঢাকায়। তখন বিমানবন্দরে তার স্বজনদের আর্তনাদে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। বিমানবন্দর থেকে নাজমার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ পর্যন্ত তার স্বজনরা কেঁদেছেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার লাশ গ্রহণ করে রাতেই মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার তালেপুর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান স্বজনরা। বিমানবন্দরেই নাজমার স্বজনরা উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, মৃত্যুর আগে প্রায়ই তিনি তাকে নির্যাতনের কথা বলতেন। কান্নাকাটি করতেন। বলতেন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আনা সম্ভব হয়নি। গত ২ সেপ্টেম্বর তিনি সৌদিতে মারা যান। স্বজনদের সঙ্গে ফোনালাপের কয়েকটি অডিওতে শোনা যায়- তিনি দেশে ফিরে সন্তানদের সঙ্গে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। দেশে ফেরার পর শুক্রবার বিকেলে তার মরদেহ দাফন করা হয়। ১১ মাস আগে সৌদি আরব পাড়ি জমিয়েছিলেন নাজমা। সেখানে যাওয়ার পর থেকেই তার ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। প্রথম থেকেই নাজমা নির্যাতিত হচ্ছে এ বিষয়টি জানানো হয়। তারপরও কেউ কিছু করতে পারেনি। দালালদের কাছে নালিশ করেও ফায়দা হয়নি। এ ঘটনায় সিদ্দিককে আসামি করে প্রতারণার অভিযোগ এনে মানিকগঞ্জ জুডিশিয়াল কোর্টে মামলা করেছে নাজমার পরিবার। এ বিষয়ে নাজমার বোন মাখসুদা বেগম বলেন- স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে অভাবের সংসার ছিল নাজমার। সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে পার্শ্ববর্তী রাজেন্দ্রপুর গ্রামের আয়নাল হকের ছেলে মোঃ সিদ্দিকের মাধ্যমে সৌদিতে যান তিনি। হাসপাতালের ক্লিনার হিসেবে চাকরির কথা বলে সিদ্দিক তাকে নানাভাবে প্রলোভিত করে। কিন্তু সৌদিতে তাকে গৃহকর্মী হিসেবে বিক্রি করা হয়। সেখানে যাওয়ার পর থেকে মালিকের ছেলে তাকে যৌন নির্যাতন করত বলে জানা গেছে। কথা না শুনলে সেখানে নাজমাকে বেধড়ক মারধর করা হতো। এ ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে নানা অজুহাতে মারধরসহ ঠিকমতো খেতেও দিত না। এসব কারণে নাজমা প্রায়ই তার বোন ও ছেলেমেয়েদের ফোন করে কান্নাকাটি করতেন। নাজমার ছেলে রাজিব মিয়া জানান, মায়ের নির্যাতনের খবর শুনে তারা বহুবার সিদ্দিকের কাছে গেছেন। মাকে ফিরিয়ে আনতে তার হাত-পা পর্যন্ত ধরা হয়েছে। কিন্তু তিনি বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। উল্টো তাদের ধমক দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। গত ২ সেপ্টেম্বর ভোরে এক সৌদিপ্রবাসী তাদের ফোন করে মায়ের মৃত্যুর খবর দেন। সৌদি আরবের আরা শহরের একটি সরকারী হাসপাতালের হিমঘরে তার মায়ের মরদেহ রাখা হয়েছে বলে তাদের খবর দেয়া হয়। এরপর তারা আবারও সিদ্দিকের কাছে গিয়ে মরদেহ দেশে আনতে অনুরোধ জানান। কিন্তু মরদেহ আনতেও নানা গড়িমসি করে সিদ্দিক। স্বজনরা জানিয়েছেন- মৃত্যুর কয়েক দিন আগে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার কয়েকটি অডিওতে শোনা যায়, নাজমা তার ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছেন আর কান্নাকাটি করছেন। তিনি প্রচ- অসুস্থ বলে জানাচ্ছেন। ব্যথায় উঠতে পারছেন না। কিন্তু তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। একটি অডিওতে শোনা যায়, তাকে বাসা থেকে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন নাজমা বলেছিলেন, আমাকে আর বাঁচাতে পারলি না তোরা। আমাকে আর জীবিত পাইলি না। বাড়ি বিক্রি করে হলেও আমাকে তোরা বাঁচাতে পারতি। পরিবারের অভিযোগ- ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে নাজমাকে বিদেশে পাচার এবং সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়ে নির্মম মৃত্যুর ঘটনা খুবই দুঃখজনক। পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। এদিকে অভিযুক্ত আদম ব্যবসায়ী সিদ্দিক পলাতক বলে জানা যায়। তবে তার স্ত্রী হালিমা বেগম সাংবাদিকদের জানান, তার স্বামী এলাকার ৫০/৬০ নারীকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। কিন্তু কারো সমস্যা হয়নি।
×