ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চার লাখ অবৈধ যান এখনও চলাচল করছে ॥ এগুলোর ফিটনেস কবে হবে জানে না বিআরটিএ

নিবন্ধিত ৪১ লাখ যানবাহনের অর্ধেক মোটরবাইক

প্রকাশিত: ১০:০৯, ২৬ অক্টোবর ২০১৯

 নিবন্ধিত ৪১ লাখ  যানবাহনের অর্ধেক মোটরবাইক

রাজন ভট্টাচার্য ॥ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সারাদেশের মেয়াদোত্তীর্ণ প্রায় পাঁচ লাখ যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট হালনাগাদ করার সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। বিআরটিএ এই মর্মে সম্প্রতি গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা করে। কিন্তু খুব একটা সাড়া মেলেনি। ঢাকাসহ সারাদেশে লাইসেন্স নিয়ে ফিটনেস নবায়ন না করা প্রায় ৫ লাখ গাড়ির মধ্যে বেঁধে দেয়া দুই মাসে ৮৯ হাজার ২৬৯ গাড়ি ফিটনেস নবায়ন করেছে। এই ধারাবাহিকতায় প্রায় চার লাখ যান এখনও অবৈধ চলাচল করছে। প্রশ্ন হলো বাকি চার লাখ যানবাহনের ফিটনেস কবে নবায়ন হবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ যানবাহনের ফিটনেস। অথচ বিআরটিএর (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) সঠিক তদারকির অভাবে ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় চলাচল করছে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট হালনাগাদ করাসহ ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেন তারা। বিআরটিএর এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরিবহন সেক্টরে চলমান নৈরাজ্যের ধারাবাহিকতার বাস্তব উদাহরণ হলো ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই যানবাহন চলাচল। এক্ষেত্রে বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট ও পুলিশের বড় ভূমিকা রয়েছে। সেই সঙ্গে বছরের পর বছর যেসব মালিক তাদের গাড়ির ফিটনেস নবায়ন করছেন না সেগুলো কেন চলাচলের অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না এ প্রশ্নও রাখেন তিনি। বলেন, এক্ষেত্রে বিআরটিএ কোন অবস্থাতেই দায় এড়াতে পারে না। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে বিআরটিএ নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল। এই যানের সংখ্যা ২৭ লাখ ৫৪ হাজার ১৭৮। অর্থাৎ নিবন্ধিত মোট যানবাহনের অর্ধেকের বেশি এখন মোটরবাইক। ফলে দুই চাকার এই বাহনে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ ভাগের বেশি। সম্প্রতি সারাদেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৩৩ ভাগই ঘটছে মোটরসাইকেলের কারণে। যে কেউ ইচ্ছা করলেই এই যানটির চালক সাজতে পারছেন। এছাড়া সারাদেশে নিবন্ধিত অটোরিক্সার সংখ্যা দুই লাখ ৮৭ হাজার ৫১৩। প্রাইভেট কারের সংখ্যা তিন লাখ ৫৮ হাজার ৬১৫ ও ট্রাকের সংখ্যা এক লাখ পাঁচ হাজার ১১৭। পাশাপাশি রয়েছে অন্য আরও কিছু যান্ত্রিক যান। রাজধানীতে এ সময় পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ১৪ লাখ ৯৩ হাজারের বেশি। এসব যানবাহনের মধ্যে প্রায় অর্ধেক হলো মোটরবাইক। এই সংখ্যা এখন ছয় লাখ ৭২ হাজার ২৩৩। বিআরটিএ ইতোমধ্যে বারোটি এ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিক নিবন্ধন দিয়েছে। রাজধানীতে চলাচলকারী এসব মোটরসাইকেলের বেশিরভাগই এ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ভাড়ায় চালিত। এর বাইরে ঢাকায় প্রাইভেটকারের সংখ্যা দুই লাখ ৮৮ হাজার ৪২০টি, মিনিবাস ১০ হাজার ৬৬১, বাস ৩১ হাজার ৯৭১। বিআরটিএ বলছে, সারাদেশে ফিটনেসবিহীন চার লাখ ৭৯ হাজার ৩২০ যানবাহন চলাচল করছে। গত ২৩ জুলাই এই সংখ্যা উল্লেখ করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ যানবাহনের নিবন্ধন থাকলেও সেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। হাইকোর্টের দেয়া আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএ’র আইনজীবী এ্যাডভোকেট রাফিউল ইসলাম এ প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদন অনুসারে, ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিভাগে দুই লাখ ৬১ হাজার ১১৩টি, চট্টগ্রাম বিভাগে এক লাখ ১৯ হাজার ৫৮৮টি, রাজশাহী বিভাগে ২৬ হাজার ২৪০টি, রংপুর বিভাগে ছয় হাজার ৫৮৮টি, খুলনা বিভাগে ১৫ হাজার ৬৬৮টি, সিলেট বিভাগে ৪৪ হাজার ৮০৫টি ও বরিশাল বিভাগে পাঁচ হাজার ৩৩৮। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন সংক্রান্ত রিপোর্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে আদালত অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা জানতে চায়। এর আনুষ্ঠানিক জবাব দেয় বিআরটিএ। বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, আদালতের নির্দেশনার পরই মোটরযানের মালিকদের অবগতির জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, বিআরটিএ কম্পিউটার সিস্টেম (বিআরটিএ-আইএস) হতে পরিলক্ষিত হয় যে, সারাদেশে চার লাখ ৭৯ হাজার ৪৯৮ মোটরযানের ফিটনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ হয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযানের ফিটনেস হালনাগাদ করার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছিল। বিআরটিএ (সড়ক নিরাপত্তা বিভাগের) পরিচালক মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, যানবাহন মালিকরা অনেক সময় ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি খেয়াল করেন না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় গাড়ি একেবারেই নষ্ট, অকেজো। দিনের পর দিন তা গ্যারেজে পড়ে আছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী গাড়ির অবস্থান যাই হোক মেয়াদ শেষে তা বিআরটিএর কাছে রিপোর্ট করতে হয়। অনেকে তা করছেন না। ফলে দিন দিন এমন যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। আমরা মালিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। অনেকেই আমাদের সহযোগিতা না করায় লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হয়নি। আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাকি যানবাহন ফিটনেস সার্টিফিকেট হালনাগাদ হবে। যেসব গাড়ির ফিটনেস নবায়ন হবে না সেগুলোর বিরুদ্ধে বিআরটিএ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। ২৩ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে দাখিল করা বিআরটিএ প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৯ হাজার ২৬৯ গাড়ি গত দুই মাসে ফিটনেস নবায়ন করেছে। এর আগে গত ২৩ জুলাই হাইকোর্ট এক আদেশে ঢাকাসহ সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনের পর ফিটনেস নবায়ন না করা ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩২০ যানের ফিটনেস নাবায়ন করতে গাড়ি মালিকদের দুই মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়। ১ আগস্ট থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিআরটিএর কাছে গিয়ে এসব যানের ফিটনেস পরীক্ষা করতে নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে বিআরটিএ ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে আদেশের জন্য ২৩ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়। সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, যেসব পরিবহনের ফিটনেস মেয়াদ শেষ হয়েছে মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সব সময় ফিটনেস হালনাগাদ করার তাগিদ দেয়া হয়। যারা করেননি তাদের আবারও সমিতির পক্ষ থেকে তাগিদ দেয়া হবে। নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, গাড়ির ফিটনেস না থাকা মানেই ভয়ের কারণ। এতে নানা রকমের ত্রুটি থাকতে পারে গাড়িতে। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এগুলো বিআরটিএর টেকনিক্যাল অংশ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের চোখে বেশি ধরা পড়ে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে যানবাহনের ফিটনেস হালনাগাদ করার তাগিদ দেন তিনি।
×