ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

শেখ হাসিনা তার কাজ করছেন ॥ আমরা কী করছি

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ২৬ অক্টোবর ২০১৯

শেখ হাসিনা তার কাজ করছেন ॥ আমরা কী করছি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কাজ করছেন। ক্ষেত্রবিশেষ আমরা নাগরিকরা যা ভাবতে পারিনি জাতির স্বার্থে তিনি তাও করে দিচ্ছেন। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় সিক্ত হয়ে দেশের কাজ করছেন। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অদম্য। আগামী ২০২০ এর ১৭ মার্চ থেকে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ, তার পরপরই ২০২১ এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তি বা সুবর্ণজয়ন্তী। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ শুকরিয়া যে, এই দুটি মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় এবং দুটি ইভেন্ট উদযাপনের তামাম কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হবে তাঁর নেতৃত্বে। থ্যাঙ্কস গড যে, এ সময় বেগম খালেদা জিয়া বা তার দল ক্ষমতায় নেই। থাকলে দেখা যেত গোলাম আযম ও তার দল জামায়াত-শিবিরকে স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে পদক দেয়া হচ্ছে। এবং জাতিকে তা সহ্য করতে হচ্ছে। আর জাতির উদ্দেশে মিডিয়ায় ভাষণে বলতেন, ১৯৭১ সালে জামায়াত যে ভূমিকা পালন করছে তা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে (স্বর্ণাক্ষর না ছাই। চিরকাল ওই জামায়াত-শিবির-রাজাকার-আলবদরদের মানুষ ঘৃণা করবে, থুতু দেবে) এখন অবশ্য খালেদা জিয়া বা তদীয় পুত্র তারেক জিয়ার করার কিছু নেই, তারা এখনও মুজিববর্ষ বা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে এমন কিছু করেননি বা করার ঘোষণাও দেননি। আমার মন্তব্যটি অতীত অভিজ্ঞতালব্ধ। পক্ষান্তরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা কি করছেন? বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নেই। সাম্প্রতিককালে কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং সাফল্যজনকভাবে বাস্তবায়ন করেছেন; তা দেখে গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত-বিস্মিত। শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন zero tolerance against corruption, drugs, violation of women and terrorism (দুর্নীতি, মাদক, নারীধর্ষণ এবং জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে এতটুকু দরদ দেখানো হবে না। একেবারেই সহ্য করা হবে না)। এসব শেখ হাসিনার কথার কথাও নয়, রাজনীতিও নয় বা রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্সও নয়। তিনি যা বলেন, মীন করেন এবং পালন করেন। পালন বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিজ দল বা বেদল দেখেন না, অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখেন এবং বিচারের ক্ষেত্রে কোন হস্তক্ষেপ করেন না, বরং বিচার প্রক্রিয়ায় সব রকম লজিস্টিক সাপোর্ট দেন। ১. মাত্র ৬ মাসের মাথায় সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হলো বৃহস্পতিবার। রায়ে রাফির ওপর যৌন নির্যাতনকারী এবং (প্রতিবাদ করায়) হত্যাকারী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার ফাঁসির হুকুম হয়েছে, অর্থাৎ ফাঁসিতে মৃত্যুদ- কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এমনকি সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিনের নির্যাতন ও হত্যা প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার অভিযোগে ফাঁসির হুকুম হয়েছে। মোট ১৬ জনের ফাঁসি হয়েছে। একজন নারীও রয়েছে। সঙ্গে এক লাখ টাকা করে জরিমানা। জরিমানার টাকা আদায় করে নুসরাতের পরিবারকে দিতে হবে। অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা আলেম। নুসরাতের ওপর যৌন নির্যাতন চালান। নুসরাত অন্য মেয়েদের মতো লজ্জায় মুখ না ঢেকে প্রতিবাদে ফেটে পড়লে ওই লম্পট মাওলানা তার সাঙ্গোপাঙ্গদের দিয়ে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। নুসরাত নিহত হয়। জীবন দিয়ে নুসরাত ছাত্র সমাজের প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে অমরত্ব লাভ করলেন। অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার এ কাজে যারা তার সঙ্গ দিয়েছে এবং যাদের শাস্তি হয়েছে তারা কোন না কোনভাবে তার সুবিধাভোগী ছিল। এমনকি নারায়ণগঞ্জের কাছে আরেক মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে যৌন নির্যাতনের দায়ে গ্রেফতার করলে সে পুলিশের কাছে বলেছে, শয়তান তাঁর ওপর ভর করে ওকাজ করিয়েছে। ২. ক্যাসিনোকান্ড। টাকার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে কিছু মানুষ যেন পাগল হয়ে গেছে। ক্যাসিনো ও অন্যান্য জুয়া, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, নারী ব্যবসা সবকিছুই ওদের কাছে সোনার খনি। ব্যবসা বা কাজটি বৈধ না অবৈধ, সামাজিক না অসামাজিক, সম্মানের না অসম্মানের কোন কিছুই দেখার নয়, টাকা এলেই হলো। এই জায়গায়ও শেখ হাসিনা uncompromised বা আপোসহীন। এর সঙ্গে জড়িত কিংবা সুবিধাভোগী কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। কেবল দল নয়, পারিবারিকভাবে আপনজনকেও শাস্তির আওতায় নিয়ে এসেছেন: * ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে শোভন-রাব্বানীকে বহিষ্কার করলেন। * যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে অব্যাহত দিয়ে তার সমস্ত ব্যাংক হিসাব সিজ করে দিলেন। * স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মোল্লা কাউসার ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথকে অব্যাহতি দিলেন। * ক্যাসিনো জুয়া, চাঁদাবাজি তথা অর্থ-বিত্তের সম্রাট-সম্রাটকে কেবল ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতিই নয়, বহিষ্কার করলেন। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল, সে এখন জেলে। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন। এসব কাজ শেখ হাসিনা করলেন। বহিষ্কৃতদের মধ্যে তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় রয়েছে। কয়েক আত্মীয়ের গণভবনে ঢোকা নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। এটি নজিরবিহীন ঘটনা। এবং এই নজির সৃষ্টি করলেন শেখ হাসিনা। তিনি তার কাজ করছেন। কিন্তু আমরা কি করছি তা মূল্যায়নের সময় এসেছে। একটি উদাহরণ তুলে ধরে এই লেখা শেষ করব: প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির বসে আছে। তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। এই সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতিদের তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রশাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাকা করে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে। গত ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা নতুন করে ২৭৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। নিশ্চয়ই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জরিপের ভিত্তিতে প্রণীত তালিকা অনুযায়ী তার ঘোষণা দিয়েছেন। এখানেও একটি কিন্তু আছে। আমি ২৬৩ চাঁদপুর ০৪, ফরিদগঞ্জের নির্বাচিত এমপি। কিন্তু ঐ অঞ্চলের তালিকা করার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি; না প্রশাসনের পক্ষ থেকে না মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এমনকি শিক্ষামন্ত্রী আমার জেলা সদরের এমপি। তিনিও আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেনি। কেন করেননি তা আমি বুঝতে পারি। জিজ্ঞেস করলে জামায়াতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে এমপিও করা যাবে না। আমার ফরিদগঞ্জের দেইচর গ্রামের মডেল একাডেমি নামে একটি হাই স্কুল এবার এমপিওভুক্ত তালিকায় রয়েছে। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হাফেজ আবু বক্কর নামে এক ব্যক্তি, ঐ গ্রামেই বাড়ি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা দুই ভাই রাজাকার ছিল। ডিসেম্বরের প্রথমদিকে পালিয়ে প্রথমে পাকিস্তান ও পরে লন্ডন চলে যায়। ’৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে মিলিটারি জিয়া ক্ষমতায় এলে হাফেজ আবু বক্কর দেশে আসে এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। নাম দেয় দেইচর মডেল একাডেমি। চারদিকে ১০ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। মাঝে মধ্যে ২/৩ দিন গেট বন্ধ থাকে, ভেতরটা নীরব-নিস্তব্ধ। অথচ গল্লাক আদর্শ ডিগ্রী কলেজ কিংবা ঘনিয়া মাঈদীয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও উবারামপুর উচ্চ বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত হয়নি। গল্লাক আদর্শ ডিগ্রী কলেজটি এইচএসসি পর্যন্ত এমপিওভুক্ত। এর স্তর উন্নীত করে ডিগ্রী পর্যায়ে এমপিওভুক্ত করার জন্য আমি স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে এবং ঐ কলেজের গবর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে ডিও লেটার দেবার পরও এমপিওভুক্ত হয়নি। কলেজটি ফরিদগঞ্জ থানার পূর্বাঞ্চল এবং চাঁদপুর হাজিমারা সেচ প্রকল্পের বাঁধের বাইরে। চাঁদপুর কলেজ, হাজিগঞ্জ কলেজ, রামগঞ্জ কলেজের দূরত্ব এই কলেজ থেকে ১০ থেকে ১৮ কিমি। ফরিদগঞ্জের পূর্বাঞ্চল ছাড়াও রামগঞ্জ থেকে ছাত্রছাত্রীরা এখানে লেখাপড়া করে। আমি সভাপতি হবার কারণেই কি কলেজটি বাদ পড়ল কি-না, আমি জানি না। নইলে এটি বাদ পড়তে পারে না। ফরিদগঞ্জে যদি একটি কলেজও এমপিওভুক্ত হয় তাহলে গল্লাক আদর্শ ডিগ্রী কলেজ সবার আগে ডিজার্ভ করে। ঘনিয়া পীর সাহেব হুজুর পরিচালিত ঘনিয়া মাঈদীয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও কারিগরি কলেজটিও এমপিওভুক্ত হলো না। এর কারণও হয়ত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার। নইলে এটিও বাদ পড়ার কোন কারণ ছিল না। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো দেশে যখন স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জামায়াত-শিবির বিরোধী একটা মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন বিরাজমান, নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছেন, ঠিক তখনই ফরিদগঞ্জে জামায়াত-শিবির পুনর্বাসন অব্যাহত রয়েছে। ২০০১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত জামায়াত-শিবির পুনর্বাসন ব্যাপক আকার ধারণ করে। তৎকালীন এমপি শামসুল হক ১৬ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন। তবু আশার আলো- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মতোই দৃঢ়চেতা, সৎ মেধাবী, দেশপ্রেমিক এবং সুবিধাবঞ্চিত দুঃখী মানুষের আপনজন। এমপিওভুক্তির মুহূর্তে তিনি বলেছেন, সকল নির্দেশনা পূরণে ব্যর্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাদি বাতিল করা হবে। ঢাকা- ২৫ অক্টোঃ ২০১৯ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও জাতীয় সংসদ সদস্য ই-মেইল : [email protected]
×