ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাজারীবাগের বিষাক্ত মাটি

প্রকাশিত: ০৮:০১, ২৬ অক্টোবর ২০১৯

 হাজারীবাগের বিষাক্ত মাটি

দশকের পর দশক ধরে বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে পড়েছে রাজধানীর একটি অঞ্চলের মাটি। দূষণের মাত্রা এত তীব্র যে, তা মাটির গভীরে আট থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত ছড়িয়েছে। প্রতিদিন ৭৪ টন কঠিন বর্জ্য ও ২১ হাজার ছয় শ’ ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি ড্রেন দিয়ে মাটি, পানি ও নদীতে গিয়ে পড়ত। ফলে এলাকার মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হয়ে পড়ে। রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নিলেও বিষাক্ত মাটির বিষ সরানো হয়নি। ৬৫ দশমিক ৫৯ একর আয়তনবিশিষ্ট হাজারীবাগ এলাকার মাটি অপসারণ বা স্থানান্তর করতে হলে সমপরিমাণ আয়তনের জায়গা প্রয়োজন। হাজারীবাগে কোন ইটিপি বা সিইটিপি ছিল না। ফলে বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই মিশে গেছে মাটি ও পানিতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্যানারির বর্জ্য থেকে হাজারীবাগ এলাকার মাটিতে ক্রোমিয়াম, লেড ও আর্র্সেনিকের মতো ভারি এবং বিষাক্ত ধাতু মিশে গেছে। দূষণের মাত্রা অবস্থান ভেদে মাটির গভীরে ২০ ফুট পর্যন্ত ছড়িয়েছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ওই এলাকায় গভীর নলকূপ ছাড়া বিশুদ্ধ পানির সন্ধান পাওয়া যায় না। ওই মাটিতে কোন গাছ জন্মে না। বর্তমানে ওই এলাকায় যেসব গাছ রয়েছে তা ক্রোমিয়াম ধাতুতে আক্রান্ত। পাশাপাশি পরিবেশের জন্যও এটা হুমকি হয়ে উঠেছে। ক্রোমিয়াম মাটি ও পরিবেশের জন্য ধীরগতির বিষ, যা কখনও ধ্বংস হয় না। বরং ধীরে ধীরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং মাটির সঙ্গে মিশে থাকে। হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোতে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রতিদিন প্রায় তিন শ’ ধরনের পঞ্চাশ টন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে। যার বেশিরভাগই বিষাক্ত। যার মাত্র ২০ শতাংশ চামড়া প্রক্রিয়াজাতের সময় চামড়া দিয়ে শোষিত হয়। বাকি ৮০ শতাংশই ড্রেন, নালা, রাস্তা ও জলাশয়ে বর্জ্য হিসেবে নির্গত হয়। এসব বর্জ্য শোধনের জন্য কোন শোধনাগার ছিল না। ফলে ট্যানারি শ্রমিকের পাশাপাশি আশপাশের মানুষও জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব রাসায়নিক পদার্থের কারণে ফুসফুস, পাকস্থলী, শ্বাসনালীর ক্যান্সার হচ্ছে। এছাড়া মানুষের চিন্তাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের শীর্ষ দশটি রাসায়নিক ঝুঁকিবহুল এলাকার মধ্যে হাজারীবাগ একটি। ট্যানারির বর্জ্যরে প্রভাবে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মানুষ সরাসরি স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে হাজারীবাগে আট হাজারের বেশি শ্রমিক পরিপাক, চর্ম ও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত। ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত নব্বই শতাংশ শ্রমিকই পঞ্চাশ বছর বয়সের আগেই মারা যায়। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করা হলেও হাজারীবাগের মাটি ও পানিতে ক্রোমিয়াম থেকে গেছে। ট্যানারির উচ্ছিষ্ট থেকে উৎপাদিত ফিড খাওয়ানো হচ্ছে ব্রয়লার মুরগিকে, যা ক্যান্সারের জন্য দায়ী। এর মাধমে মুরগির শরীরে ক্রোমিয়াম প্রবেশ করে, যা চলে যায় মানুষের দেহে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে এই মাটি সরিয়ে ফেলতে। তবে এ মাটি কোথায় ফেলা হবে সে নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আবার তারা চাচ্ছে এই এলাকার ভূমির উন্নয়ন। সেজন্য আট ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি অপসারণ করে বিশুদ্ধ মাটি দিয়ে ভরাট করা হবে, যাতে দূষিত মাটি নতুন এলাকা ও ভূগর্ভস্থ পানির ক্ষতি করতে না পারে। তারা মাটি রাসায়নিক পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ করতে চায়। বিষাক্ত মাটিগুলো রাখার জন্য রাজউক কোন স্থান নির্ধারণ করতে পারছে না। নতুন এলাকা আবার বিষাক্ত করা হবে আত্মঘাতী কাজ। স্থানান্তরের আগে ডাম্পিং স্টেশন চূড়ান্ত করতে হবে। বিষাক্ত মাটি মুক্ত করার জন্য শুধু প্রকল্প হাতে নিলেই চলবে না, এর জন্য গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করে মাটি বিশুদ্ধ করার বিকল্প নেই। কাজটি সম্পাদন করা জরুরী।
×