ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোমিন মেহেদী

বিদায় সুর মূর্ছনার চিত্রকার

প্রকাশিত: ১৩:২২, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

বিদায় সুর মূর্ছনার চিত্রকার

‘নিজের কাজ নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। যা বলার শিল্প-সমালোচক, শিল্পবোদ্ধা এবং শিল্পপ্রেমীরা বলবে। তবে আমি শুধু বলব আমি কাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পছন্দ করি।’ নিজের ৭২তম একক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন সদ্য প্রয়াত খ্যাতিমান শিল্পী কালিদাস কর্মকার। যে কথা আজও কানে বাজছে। তাঁর ছবিতে বর্তমান সময়, অবিশ্রান্ত, মানবীয় অভিজ্ঞতার সম্পর্কের ভাষা মূর্ত করে তোলে। তার ছবির শেকড় গাঁথা এ জনপদেরই মাটিতে। এ ভূখ-ের যাপনপ্রণালী, নানা ধর্মের সমন্বয়, লোকশিল্পের নানা প্রতীক উপাদন হিসেবে এসেছে শিল্পী কালিদাসের চিত্রকলায়। তার চিত্রকলায় এ জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন আন্দোলনের অনুষঙ্গে এসেছে তাবিজ-কবজ আর কড়ি। কাগজের মন্ডের পটভূমিতে কখনও চকিতে ধরা পড়েছে মৃত্যুমুখ মুক্তিযোদ্ধার যন্ত্রণাকাতর হাতের ইঙ্গিত। শিল্পী কালিদাসের চিত্রকলায় এসেছে আবহমান বাঙালীর নিশ্বাস, কিন্তু চিত্রকলার স্বভাব কোথাও ঢলে পড়েনি। শিল্পীর উচ্ছ্বাস, অভিব্যক্তি, শুদ্ধতা, বেদনা, স্মৃতি আর একাকীত্ব এ সবই যেন শিল্পীর ‘পাললিকপ্রাণ-মাটি-প্রতীক।’ যতদূর জেনেছি- স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় ১৯৭৫ এর এপ্রিলে। এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজন করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চিত্রকলা চর্চায় ভূমিকা রেখেছেন অনেকেই। এদের মধ্যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের মাধ্যমেই এ দেশে চিত্রকলা চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এসএম সুলতানের চিত্রকলা দেশীয় চিত্রকলার অন্যতম উদাহরণ। মানুষের প্রাণশক্তি ও সমাজের এক নির্মোহ ছবি ফুটে ওঠে তার চিত্রে। সুলতানের চিত্রের মানুষেরা ধনশালী-দীনতাহীন। বাংলার চিরায়ত এক সাহসী সমৃদ্ধ রূপের বর্ণনা তার চিত্রে দেখা যায়। যা সত্য কিন্তু বাস্তব নয়। সুলতানের চিত্রের সমৃদ্ধ চিত্রায়নগুলোতে এদেশের মানুষের চিরায়ত আকাক্সক্ষারই প্রকাশ ঘটেছে। আরেক শিল্পী কামরুল হাসানের চিত্রকলা যেন আমাদের সন্ধান দেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর নাগরিক সমাজের এক বিশ্লেষণী রূপের। চিত্রের আঙ্গিকে ও শৈলীতে সমাজমুখী একটা ধারা বাংলাদেশে দেখা যায়। বিমূর্ত চিত্রায়নের ধাঁচও অনেক শিল্পীর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বিদ্যমান। ষাটের দশকের মেধাবী শিল্পীরা হচ্ছেন, মনিরুল ইসলাম, হাশেম খান, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, অলক রায়, শহীদ কবীর, বীরেন সোম, কালিদাস কর্মকার, আবুল বারক আলভী, হামিদুজ্জামান খান, আবদুস সাত্তার প্রমুখ। শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিন, শাহাবুদ্দিন, স্বপন চৌধুরী, চন্দ্র শেখর দে, ফরিদা জামান, নাঈমা হক, তরুণ ঘোষ, নাসিম আহমেদ নাদভী প্রমুখ সত্তরের দশক ও পরবর্তী সময়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এদের অধিকাংশই বিমূর্ত ও সমবিমূর্ত শৈলীর ধারায় অরাজনৈতিক চিত্রকর্ম সৃজনে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন। ব্যতিক্রমও ছিলেন, চন্দ্র শেখর দে, শাহাবুদ্দিন ও হামিদুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় তাদের শীল্পচর্চা করেন। সত্তর ও আশির দশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিলাভে সমর্থ হন সময়চেতনশিল্পী কালিদাস কর্মকার। প্রতীকনির্ভর পরাবাস্তব সৃজন কালিদাসের। উত্তর-আধুনিক শিল্পশৈলী স্থাপনা দৃষ্টান্তের অন্যতম সূচনাকারী এই কালিদাস কর্মকার। হামিদুজ্জামান খান স্থাপনাশিল্পের অপর এক দিশারী। মৃৎশিল্পকে সৃজনশীল ভাস্কর্য স্থাপনায় উন্নত করেছেন আরেক শিল্পী আলোক রায়। ছাপচিত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন রফিকুন নবী এবং আবদুস সাত্তার। চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারের চিত্রকর্ম আমাকেই শুধু নয় আমাদের রঙিন ক্যানভাস সম্পর্কে ধারণা রাখেন, এমন সকল মননশীল মানুষের ভালবাসাা-ভাললাগা ছিল। ব্যক্তি চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারের জীবনও ছিল আমার অনেক আকাক্সক্ষার বিষয়ের মধ্যে একটি। তাঁর উদাস বাউলময় চোখ আমাকে করে রাখত ব্যবলিনের দোলনা। আমি মনে মনে প্রতিদিন প্রার্থনা করি ‘¯্রষ্টা তুমি যদি দয়া করে এমন জীবন যদি দান কর- যে জীবন কারও ক্ষতি করবে না, উপকারে ভরে যাবে মানব উঠোন; তবে আমি তোমার ভালবাসা-দয়ামগ্ন নিরন্তর যোদ্ধা হব...’ যে যোদ্ধার জীবন কেবল লোভ মোহহীনই নয়; ত্যাগের মহিমায় আলোকিত-ভালোকিত। এমন যোদ্ধা জীবন ছিল একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারের। তিনি নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন দেশ-মাটি-মানুষ-শিল্প ও সাধনা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চিত্রশিল্পী তার চিত্রকর্মে আবহমান বাংলার স্বরূপ প্রকাশের পাশাপাশি নিরীক্ষাধর্মী শিল্পকর্মের জন্য শিল্পী মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছেন। তার কর্ম নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে। দেশে আধুনিক চিত্রকর্মে কালিদাস কর্মকার অন্যতম এক নাম। ১৯৪৬ সালে বৃহত্তর ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কালিদাসের বাবা হীরালাল কর্মকার ও মা রাধারানী কর্মকার। শৈশব থেকেই তিনি চিত্রকলার সঙ্গে যুক্ত। এক সময় ভর্তি হন তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউটে। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে কলকাতার গবর্নমেন্ট কলেজ অব ফাইন আর্টস এ্যান্ড ক্র্যাফট থেকে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান নিয়ে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। দেশ-বিদেশে আয়োজিত শিল্পী কালিদাসের একক চিত্র প্রদর্শনীর সংখ্যা ৭১টি। ভারত, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চতর ফেলোশিপ নিয়ে সমকালীন চারুকলার নানা মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি একুশে পদক, শিল্পকলা পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কালিদাস কর্মকার বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী যিনি নিরীক্ষাধর্মিতার জন্য বিখ্যাত। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত ফরিদপুরে তাঁর জন্ম হয়। শৈশবেই তিনি আঁকতে শুরু করেন। স্কুল জীবন শেষে ঢাকা ইনস্টিটিউট অব আর্টস থেকে তিনি ১৯৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে চিত্রকলায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীকালে কলকাতার গবর্নমেন্ট কলেজ অব ফাইন আর্টস এ্যান্ড ক্র্যাফট থেকে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান নিয়ে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি ইউরোপীয় আধুনিকতার ঘরানার শিল্পী। বরেণ্য চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হলে তিনি বলেছিলেন- আমি শিল্পকে সাধনা ভাবি, যেমন দেশকে ভাবি মা। আমার শিল্পীত পথচলায় কেবলই মনে হয়েছে যে, কালিদাস কর্মকারের শিল্পকর্ম যেন যন্ত্রণাকাতর এক যাত্রা। যার উদ্দেশ্য সুন্দরকে স্পর্শ করা। সেই যাত্রা যন্ত্রণাদীর্ণ মানুষের দিকে, সেই যাত্রা শিল্পের দিকে, সেই যাত্রা সভ্যতা সৃষ্টিময়তার। তাঁর এ্যাক্রিলিক, মিশ্র মাধ্যম, গোয়াশ, কোলাজ, ওয়াশি, মেটাল কোলাজ, ড্রইং, ডিজিটাল লিথো, মিশ্র মাধ্যমের স্থাপনা শিল্প প্রত্যয়ে অগ্রসর হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে আমার মত অসংখ্য তরুণকে। যে কারণে আমি বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছি শিল্পে-সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে এবং রাজনীতিতে। বার বার মনে হয়েছে- এগিয়ে যেতে হবে সবাইক ছাড়িয়ে অ-নে-ক দূর। এই যাত্রাপথে তিনি যতবার আমাকে দেখেছেন, বলেছেন- নোংরা রাজনীতিকে ধুয়ে মুছে সাফ করতে হলে শিল্পী প্রয়োজন। অতএব, বাংলাদেশ শিল্পের রাজনীতিতে শিল্পীর রাজনীতিতে তৈরি হতে পারে যদি দিনরাত এক করে লেগে থাকা যায়। প্রায় একই কথা বলেছেন, বরেণ্য রাজনীতিক, আমার প্রিয় অভিভাবক প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক ও রাজনীতিক-কলামিস্ট জেড এম কামরুল আনাম। মানুষ চলে যায়; থেকে যায় স্মৃতি-কথা আর কর্ম। কালিদাস কর্মকারের নানা ধরনের পাথর, কড়ি, প্রবাল, লাভা খন্ড, পোড়া কাগজ, মুক্তা, বিভিন্ন ধরনের কোরাল, কাচ প্রভৃতির দ্বারা ব্যতিক্রম কাজগুলো ভিন্ন নান্দনিকতার সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে রহস্যময়তায় আবদ্ধ করে শিল্প রসিকদের। স্মৃতিকাতর আমি শিল্পী দিলীপ দাসের ক্ল্যারিওনেটের সুরে যেমন হারিয়ে যাই, তেমনি মুগ্ধতায় ডুবে যাই- তাঁর শিল্পের অতলে। বাংলাদেশের মানুষ সংস্কৃতি রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছে। এখনও শিল্পের জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে। দেশে বার বার সংস্কৃতির ওপরে আঘাত এসেছে, মুক্তবুদ্ধির মানুষের ওপরে আঘাত এসেছে। কিন্তু সংস্কৃতির প্রতি আমাদের তীব্র ভালবাসা ও সাহস শিল্পের অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারেনি। হয়ত এ কারণেই মনে হয়েছে- তাঁর মাঝে এক ধরনের যন্ত্রণাবোধ রয়েছে। তার ছবির ভাষা, উপকরণ, রঙ্রে ব্যবহার সবকিছুই নান্দনিক। কিন্তু নান্দকিতার চাইতে তার মাঝে যন্ত্রণাবোধটাই বেশি কাজ করে। সেটা সৃষ্টিশীলতার যন্ত্রণা। অবশ্য শিল্প প্রসঙ্গে কালিদাস কর্মকারের বক্তব্য হলো- বাংলাদেশ-ভারতের মানুষের মন পলির মতোই নরম। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতার লড়াই, বঞ্চনার শিকার এই মানুষের মন মরে যাচ্ছে। কিন্তু এত অস্থিরতার পরেও শেষ পর্যন্ত সেই মানুষ জেগে উঠছে তার স্বকীয়তায়। তার আদি চরিত্রে। জীবনের এই কথাই তুলে আনতে চেয়েছি আমার এতদিনের প্রদর্শনীগুলোতে। এবারের ‘পাললিক প্রাণ-মাটি-প্রতীক’ শীর্ষক এ প্রদর্শনীতে সেই দীর্ঘ যাত্রারই একটি চলমান প্রয়াস। কথার মত তাঁর চিত্রেও আবহমান বাংলার রূপ বৈচিত্র ধরা পড়েছে। উচ্ছ্বাস, বেদনা, স্মৃতি, একাকীত্ব নিয়ে শিল্পীর এ পাললিক যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। আজ যেমন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারের মত করে বলতে ইচ্ছে করছে- ‘কালিদাস সবসময় চমক দিতে পছন্দ করেন। নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন । ক্যানভাসে এক ধরনের রহস্যময়তা সৃষ্টি করার ক্ষমতা তার ছিল। তিনি তার চিত্রকর্মে মানুষের যাত্রাকে গুরুত্ব দেন না। বরং প্রত্যাবর্তনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সেই হিসেবে কালিদাস আবার ফিরে আসবেন। ২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি তার ৭২ তম জন্মদিন উদযাপন করেছেন দেশি বাদ্যযন্ত্রের সুরের সঙ্গে আর বিশাল ক্যানভাসে ৭২ মিনিটে ছবি এঁকে খোলা মঞ্চে দর্শকদের সামনে। কত স্মৃতি।’ তেমন কালিদাস কর্মকারের শিল্পপ্রণয় অনন্তকাল বিজয়ের আবহমান হয়ে থাকবে বলেও আমি বিশ্বাস করি। কিছুদিন আগের কথা। ৭২-এ পা রাখার পর শিল্পী কালিদাস কর্মকারের সঙ্গে দেখাকরতে গেলে নতুন কয়েকটি কাজ সম্পর্কে বলেন, দেখান নিজের অলৌকিক কয়েকটি কাজও। সেই শুভ দিনটিতে দেশি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সুরের ছন্দে বিশাল ক্যানভাস রাঙিয়েছিলেন তিনি। ৭২ মিনিটের সেই সুরের মূর্ছনায়, রেখার গতিময়তায় স্পন্দিত হয়ে উঠছিলেন শিল্পী। সুরের ছন্দময়তায় ক্যানভাসে তার রেখার গতি যেন পাল্টে যাচ্ছিল। কিন্তু সব রেখাই পূর্ণতা পাচ্ছিল মানুষের মুখের আকৃতি নিয়ে, কখনও ছন্দবদ্ধ বিন্যাসে, কখনও বা পাখি। আর ওই মাহেন্দ্রক্ষণটি উš§ুক্ত মঞ্চে উপস্থিত দর্শকরা অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করলেন অন্যরকম মুগ্ধতায়। শিল্পী কালিদাস কর্মকারের জন্মদিন উপলক্ষে ‘পাললিক ছন্দ’ নামে যুগলবন্দী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় জাদুঘর। আহা! সে কি মুগ্ধতা! শুদ্ধতা! এমন শুদ্ধতার রাস্তায় অগ্রসর হতে হতে তিনি বলেছিলেনÑ শিল্প তখনই সমৃদ্ধ হয় যখন তা অন্য মাধ্যমগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করে। সে কারণেই গানের সুরে তবলার বোলের সংযোগে এই প্রয়াস। জন্মদিন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের পরিবারে ঘটা করে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ নেই। তার পরও কেউ উদযাপন করলে ভাল লাগে। আমার কাছে মন হয়েছে- সত্যিই তিনি সব সময় চমক দিতে পছন্দ করতেন। নানা মাধ্যমে কাজ করেন এই শিল্পী। ছবি আঁকার পাশাপাশি অন্য কাজও করেন। তার ছবিও বৈচিত্র্যময়। অলৌকিক ছবি আঁকেন। ক্যানভাসে এক ধরনের রহস্যময়তা সৃষ্টি করেন। এখনও ক্রমাগত তিনি নতুনভাবে কাজ করতে চান। সব সময় নতুন কাজে উন্নতি ও পরিবর্তন লক্ষ্য করি আমরা। তিনি মানুষের যাত্রাকে গুরুত্ব দেন না। বরং প্রত্যাবর্তনকে গুরুত্ব দেন। শিল্পীর সব প্রদর্শনীর সঙ্গে ‘পাললিক’ শব্দটি জড়িয়ে থাকে। পলিমাটির এই দেশ তার চিন্তায় মিশে থাকে সব সময় তারই প্রকাশ এই শব্দের মধ্য দিয়ে। তিনি এমন এক শিল্পী যিনি চিত্রকলার সব ধরনের টেকনিক রপ্ত করতে চান এবং তা ক্যানভাসে ব্যবহার করতে চান। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের একজন শিল্পী তিনি। কালিদাস কর্মকারেরÑ পাললিক অনুভব, পাললিক আত্মা, পাললিক প্রতীক, পাললিক ছন্দ, পাললিক মাত্রা, পাললিক উৎসব, পাললিক পাল, পাললিক স্মৃতি, পাললিক মৌনতা, পাললিক অবয়ব, পাললিক অমত্মদৃষ্টি প্রভৃতি। বালিয়াড়ি বা কাদামাটির গভীরে কিংবা মাটির উপরিভাগে মাটিকে ঘিরে যত স্বপ্ন আর বাস্তবতা, যত রূঢ়তা-ক্রুরতা, হাসি-কান্না, হিংসা-হানাহানি, প্রেম-অপ্রেম প্রায় সব যেন ক্রমান্বয়ে চলে আসে হাত ধরে তাঁর চিত্রপটে। কৃষক যেমন মাটি তৈরি করে বীজ বা চারা বপন করেন, কালিদাস যেন সেই পদ্ধতিতে কাগজে-ক্যানভাসে রঙে রঞ্জিত মাটি আর বালির প্রলেপে প্রেক্ষাপট তৈরি করে নিজের চিন্তা আর অনুভবকে তুলে ধরেন। ‘পাললিক অনুভব-৬’ তাঁর এ রকম একটি কাজ। শৈশবে আমরা যেমন নদীর কাছে কাদামাটি নিয়ে খেলেছি, আঁচড় কেটে আঁকিবুকি করেছি, সেই অনুভূতি ফিরে আসে শিল্পীর এই নির্মিতিতে। ‘পাললিক আত্মা-২’ শিরোনামের চিত্রে শিল্পী পটকে প্রথমত দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। ওপর ভাগে বাঁকাচাঁদসহ পরিচিত প্রতীক, নিচের অর্ধাংশ কোনাকুনি বিভক্ত করে কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন বৃত্তাকার ফর্ম, আর চারটি ত্রিভুজের মুখোমুখি দুটিতে গোলাকার জিলিপির প্যাঁচ এবং অন্য দুটিতে কড়ি ও নুড়িপাথর প্রয়োগ করেছেন। ‘পাললিক ছন্দ’ শিরোনামে আঁকা ছবিতে শিল্পী বর্ণলেপন করেছেন তাঁর হাত দিয়ে। গ্যালারি-অভ্যন্তরে গঙ্গীত মূর্ছনার তালে তালে রং ঢেলে হাতে মেখে এ রকম ছবি আঁকতে দেখেছি তাঁকে। ক্যানভাস তাঁর কাছে শুধু ধ্যান-জ্ঞান নয়, আরাধনাও। তাই তাঁর ক্যানভাসে উঠে আসে যাপিত জীবনের নানা খ-চিত্র। জলাসিক্ত সতেজ বাংলাকে ধরতেই যেন তারা জলরঙের সতেজ চরিত্রকে বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন সময়। তাঁর আঁকা চিত্রে গ্রাম ও নদীর বুকে মানুষের নিয়ত জীবনযাপন যেভাবে উঠে এসেছে, উঠে এসেছে কর্মব্যস্ত প্রত্যুষের রং-গোধূলির ভালবাসা। তাঁর শিল্পে পথ-ঘাট-প্রান্তর জুড়ে বাংলার কৃষিভিত্তিক জীবনের গল্পও শুনেছি আমি। জীবন্ত হাজারো ক্যানভাসের জনক কালিদাস কর্মকারের বক্তব্য হলো- আমার ছবি আমার জীবনের ডায়েরি। আমি প্রতিদিন যা ভাবি তাই ছবিতে তুলে আনার চেষ্টা করি। প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে আমার একটা জার্নি দেখাতে চেয়েছি। যেখানে আমি সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। যে কারণে আমার ছবির রং ঝরে পড়ে না।
×