ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম

গল্প ॥ অস্কার শিন্ডলারের গাছটি

প্রকাশিত: ১৩:২০, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

গল্প ॥ অস্কার শিন্ডলারের গাছটি

ইহুদীদের ওপর তেমন কোন বিশেষ আগ্রহ ওদের কারওই ছিল না এবং এই গল্পটা নিছক একটা ভ্রমণের গল্পই হবার কথা ছিল। যাদের উপলক্ষে এই গল্প, তাদের পোল্যান্ড যাত্রা এবং ‘ইহুদী প্রসঙ্গে’ জড়িয়ে পড়া নিতান্তই কাকতালীয়। ইহুদীদের গল্প থেকে এক সময় এর সঙ্গে জড়ানো আরও অনেক গল্প ভর করতে থাকে ওদের ওপর। তারপর এক সময়ে এটা ওদেরই গল্প হয়ে যায়, কারণ সকল অবিচার, বিভেদ, বঞ্চনা, যন্ত্রণা, কান্না ইত্যাদির উৎসের মধ্যে এমন একটা মিল থাকে যে ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সময়ের অজানা অনেক মানুষের কষ্টের সঙ্গে মিলে যায় আমাদের নিজেদের জীবনের কষ্ট ও বঞ্চনার কাহিনী। গজিয়ে ওঠে আগ্রহের অনেক শাখা প্রশাখা। এর শেকড় কখনও কখনও আমাদের নিয়ে যায় বহু দূরে, অনুভবের নতুন কোন সীমানায়। জুন মাসের বিকেলে ওয়ারসো শহরটা সবুজে ঝলমল করছে, শীতের মৌসুমে ন্যাড়া হয়ে যাওয়া গাছগুলো গত দুমাসের বসন্তে সবুজে ভরে গেছে, এদেশের সামার বা গ্রীষ্মকাল শুরু হয়ে গেছে। আজকের বিকেলটা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর হালকা বাতাসেও কনকনে শীত। এদেশের লোকের জন্য না হলেও ওদের জন্য কিছুটা কষ্টের। তবুও ওরা চারজন বেরিয়েছে শহর দেখতে, কারণ হাতে মাত্র দু-তিন দিন সময় এর মধ্যেই দেখে ফেলতে হবে বহুদূরের এই শহরের যতটা সম্ভব, আর কখনও আসার সুযোগ হয় কিনা কে জানে। বিখ্যাত ক্লাসিক মিউজিশিয়ান ফেড্রিক শোপিনের শহর এটা। আছে বিখ্যাত বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস এবং মারিয়া স্কোলোডোস্কার (মাদাম কুরি) স্মৃতিচিহ্ন। প্রথমে সে সব জায়গায় না গিয়ে ওরা চলে এসেছে ওয়ারসো শহরের পুরনো অংশে। ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা করেছে সমীর। সমীর বেশ কয়েকবার এসেছে ইউরোপে। যদিও পোল্যান্ডে আশা হয়নি কখনও। এবার সমীরের বেশি ভাল লাগছে সঙ্গে সমমনা বন্ধু পরাগ আছে সঙ্গে। প্রতিবারের মতো এবারেও উইকি-ট্রাভেল ঘেঁটে অল্প সময়ে এবং অল্প খরচে কিভাবে বেশি বেশি জায়গা ভালোভাবে দেখা যায় সে পরিকল্পনা করে এসেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আজকের ভেনু ‘ওল্ড টাউন’। এখানকার বাড়তি আকর্ষণ বিনা পয়সায় কয়েকটি ‘গাইডেড টুর’। পেশাদার গাইড থাকলে যে কোন দর্শনীয় জায়গাই অসাধারণ হয়ে ধরা দেয়, সমীরের অভিজ্ঞতা তাই বলে। ‘পুরনো শহর’ বলা হলেও এর প্রায় পুরোটাই নতুন করে বানানো হয়েছে। কারণ যুদ্ধের (২য় বিশ্ব যুদ্ধ) সময় এই শহরটা এক রকম ‘ধুলায় মিশে গেছিল’। পুরান শহরের ‘অ্যান্টিক’ প্রসাদ, দুর্গ এবং অন্যান্য আরও অনেক স্থাপনা নতুন করে বানানো হয়েছে। বাসটা যখন এখানে পৌঁছল তখন প্রায় বিকেল ৫টা তবে এখনও আরও সাড়ে চার পাঁচ ঘণ্টা আছে সন্ধ্যা হতে। তবু সমীরের ভয় হচ্ছিল গাইডেড ট্যুরগুলো পাওয়া যায় কিনা। বাসের দরজা থেকেই আকাশের দিকে দৃষ্টি সমীরের, আশার আলো ছড়িয়ে রোদ দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তার ওপারেই ওল্ড টাউন। ফুট ওভার ব্রিজে ওঠার পরই ওপাড়ে ‘রাজ প্রাসাদ’ দেখা গেল। পাশেই একটা জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে। কোন উৎসব বা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে মনে হল। সমীরের চোখ খোলা চত্বরটার দিকে। ওদের আরেক সহযাত্রী সোহেল তিন চার বছরের জুনিয়র হলেও এর আগে পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছে। ওর সমীরদা এবং তার বন্ধু পরাগ ভাই দু’জনাই লেখালেখি করেন, আঁতেল মানুষ, সোহেল সেরকম না হলেও ঘোরাঘুরির সময় সব কিছুতেই ওর আগ্রহ। কোথাও যাওয়ার আগে ভাল করে ‘নেট’টা দেখে আসার অভ্যাসটা অনেক দিনের। এখানে তিন ধরণের ‘ফ্রি গাইডেড টুর’ আছে তিনটিই ইতিহাসের এক একটি পর্যায়ের। একটা হলো রাজাদের আমলের, দ্বিতীয়টি ইহুদীদের সম্পর্কিত এবং তৃতীয়টি কমিউনিস্ট আমল সম্পর্কিত। গাইড থাকলে যে কোন বিষয় এবং যে কোন জায়গাই ভাল লাগে, তাই কোন একটা ট্যুর পেলেই চলবে, ‘রয়েল প্যালেস’টা পেছনে রেখে সেল্ফি তুলতে তুলতে ভাবছিল সোহেল। এমন সময় সমীরদার ডাক শোনা গেল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে উনি হাত তুলে যেদিকে দেখাচ্ছেন সেখানে ছোট খাট একটা জটলা দেখা যাচ্ছে। জটলার মাাঝামাঝি লম্বা লাঠি হাতে সোনালী চুলের একটি মেয়ে, লাঠির আাগায় একটি পতাকা। দূূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না পতাকায় কি আছে। সমীরদা আর পরাগ ভাইকে এগিয়ে যেতে দেখে সোহেলও সেদিকে পা বাড়ায়। দলের আরেক সদস্য অরিন্দম একটু পিছিয়ে আছে, এখনও ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে মোবাইলে ছবি তুলছে। ছেলেটার পুরো নাম অরিন্দম চাকমা, বয়সে সোহেলের চেয়ে চার পাঁচ বছরের ছোটই হবে, সমীরদার প্রাক্তন সহকর্মী, এক সময় একই এনজিওতে কাজ করত। এর আগে কোন যাত্রায় কখনও চাকমা সহযাত্রী পায়নি সোহেল। পশ্চিমা কোন দেশে আসা অরিন্দমের জন্য এবারই প্রথম। এর আগে ইন্ডিয়া এবং নেপাল ছাড়া কোথাও যাওয়া হয়নি। এদেশের সব কিছুই ওর ভাল লাগছে, কৌতূহল জাগাচ্ছে। গাছগুলোও সব অন্যরকম, কোনটাই চেনে না, শুধু হোটেলের সামনে ঝাঁকড়া চুলের মতো দেখতে একটা গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন সমীরদা, হর্স চেস্টনাট। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে, প্রাসাদ এবং দূরে একটা দুর্গের দেয়ালের ভাঙ্গা অংশ দেখতে দেখতে ছোট হাত ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করল ও। দাবার ক্যাসেলের উপরের অংশের মতোই দুর্গের দেয়াল। পরাগ আর সমীর জটলার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সোনালী চুলো মেয়েটা মুচকি হাসি দিয়ে কিছুটা পূর্ব ইউরোপীয় উচ্চারণে পরিষ্কার ইংরেজীতে বলল-‘হ্যালো, স্বাগতম আমি ইরিনা, আমি এই ‘ফ্রি ইহুদী ট্যুরের’ গাইড।’ সমীর হাত তুলে বলল,-‘হাই’। ইরিনা হেসে বলল— ‘আমার মনে হয় তোমরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে।’ —‘নিশ্চয়’ সমীর ইংরেজীতে বলে। —‘অন্য ফ্রি ট্যুরগুলো কোন জায়গা থেকে শুরু হয়?’ পরাগ সমীরের পেটে গুতো দিয়ে বলে। —‘এইখান থিকাই শুরু হয়, তবে এখন নাই’ বলতে বলতে ইরিনার দিকে তাকায় সমীর। -‘আমার মনে হয় পোল্যান্ডে ইহুদীগো হিস্ট্রিই বেশি ইন্টারেস্টিং হইবো। উই শুড জয়েন দিস ... মাইয়াটাও সুন্দর।’ বলে পরাগ বন্ধুর দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকায়। সমীর মুচকি হেসে বলে - ‘ও এই জন্য তোমার এত আগ্রহ?’ পরাগ বলে ওঠে- - না না দোস্ত, তুমি তো জান না আমি এই দেশে আশার আগে পিয়ানিস্ট আর শিন্ডলারস লিস্ট ছবি দেইখা আসছি? পোল্যান্ড মানেই ইহুদী, পোল্যান্ড মানেই হলোকাস্ট।’ বলতে বলতে পেছনে তাকিয়ে দেখে অরিন্দম তখনও ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে। ‘দেখছো চাকমা পোলাটা এখনও কই দাঁড়াইয়া রইছে?’ বলেই একটু ওইদিকে এগিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি আসার জন্য ওকে হাত নেড়ে ইশারা করতে থাকে। দুই বেশ কিছুক্ষণ হল ইরিনার পিছু পিছু ঘুরছে ওরা, হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর কনকনে বাতাস রয়েছে, তবুও সবুজ শহরটা ভাল লাগছে। ওরা চারজন ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আরও ১২/১৩ জন নারী পুরুষ রয়েছে দলটিতে। অরিন্দমের মনে হল ওদের গ্রুপের বাকি তিনজন বেশ মন দিয়েই শুনছে গাইডের কথা কিন্তু ওর মনোযোগ অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ও সমীরদার কাছ থেকে আরও কয়েকটা গাছের নাম জেনে নিয়েছে। ইরিনা যখন একটা রাস্তার নাম ফলক দেখিয়ে খুব গুরুত্ব দিয়ে এর পেছনের ইতিহাস বলার চেষ্টা করছে অরিন্দম তখন উইলো গাছের ঝোলানো পাতার দিকে থাকিয়ে আছে হা করে। সমীরদা ওর কাঁধে হাত রেখে নিচু স্বরে বলে- ‘এখন গাইডের কথা শোন, ওগুলো পরেও দেখতে পারবা।’ অরিন্দমের মনে হচ্ছে ইরিনার সব বর্ণনা ‘গরু ঘাস খেয়ে চলে গেছে’ টাইপের। এখন গরুও নেই ঘাসও নেই। বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীদের বাসস্থানসহ ওয়ারসো শহরের প্রায় নব্বইভাগ স্থাপনা ধুলায় মিশে গিয়েছিল। তাই অতীতের বিশেষ কোন চিহ্ন নেই নাম এবং পরে বানানো স্মৃতিফলক ছাড়া। ইরিনার বর্ণনা ভঙ্গি সুন্দর, শ্রোতাদের আকর্ষণ করার জন্য ছোট ছোট প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, সেই প্রশ্নের একটা প্রসঙ্গ থাকে, থাকে এর সঙ্গে জড়ানো অনুষঙ্গ যার ডাল পালায় কাহিনীর বিস্তার হতে থাকে। ভাল গাইড মাত্রেই ভাল কথক। পরাগের সাহিত্যিক কান গাইডের বলার ধরন এবং শব্দচয়নে মুগ্ধ হচ্ছিল। ‘যুদ্ধের আগে ইউরোপের কোন শহরে সবচে বেশি ইহুদী বসতি ছিল বলতে পারেন?’ ঘুরে ঘুরে সবার চোখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটি ছুড়ে দেয় স্বর্ণকেশি সুন্দরী। ‘আপনার অনুমান ঠিক ওয়ারসোতেই, সংখ্যাটা বলতে পারেন?’ উত্তরের জন্য কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করেই বলতে থাকে- ‘ছয় লাখ, এখন এ শহরে কতজন ইহুদী বাস করে বলতে পারবেন?’ একটু থেমে, ‘চার থেকে পাঁচ হাজার মাত্র, কি ভাবছেন বাকিদেরকে জার্মানরা মেরে ফেলেছে?’ তা নয়। ইরিনার ভাষ্য মতে যুদ্ধের পরও ২/৩ লাখ ইহুদী এখানে ছিল তাদের বেশিরভাগ এখান থেকে চলে গেছে, বেশিরভাগ ইসরায়েল এবং উত্তর আমেরিকায়। পরাগের কাছে বিষয়টা বেশ খটকা লাগছিল, যুদ্ধে তো জার্মানরা হেরেই গেল তাহলে ইহুদীদের চলে যেতে হল কেন। প্রশ্ন করার জন্য হাত তুলে এগিয়ে গেল পরাগ। হাসি মুখে ‘ইয়েস’ বলে ওর দিকে উৎসুক চোখে তাকাল মেয়েটি; - জার্মানরা হেরে যাবার পরও বেশিরভাগ ইহুদী এদেশ থেকে চলে গেল কেন? ইরিনার মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হল পরাগের প্রশ্নটি সে আশা করেনি । একটু ভেবে বলল- - খুব সম্ভব, কমিউনিস্ট শাসনের সময় তারা বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে এবং চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। উত্তরটা পরাগ ও সমীর কারোই মনে ধরল না। ওরা দুজনেই ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতি করেছে। লেনিন এবং রুশ-বিপ্লবের অন্যান্য নেতারা ইহুদীসহ সকল সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার রক্ষার কথাই বলেছেন এমনটাই ওরা জানে। পুরো দলটি এগিয়ে চলছে, রাস্তার ওপারে পার্কের এক পাশে দেয়াল ঘেরা একটা জায়গা দেখা যাচ্ছে, সমীর ফিস ফিস করে পরাগকে বলতে থাকে- -কমিউনিস্ট শাসনের কারণে ইহুদীরা যায় নাই, অন্যকারণ আছে, জোরালো কারণ। সমাজতন্ত্রের পতনের পর ওইটাই নন্দ ঘোষ হইছে। - জোরালো কারণটা কি? - আমি পুরোপুরি নিশ্চিত না, কিন্তু অনুমান করি । - কি সেটা? - তুই শিন্ডলার্স লিস্ট দেখছস না? - গত মাসেও দেখলাম, মানে রিপিটেশন। - আমি এখানে আসার কয়েক দিন আগে দেখলাম। শেষের দিকে একটা দৃশ্যে রাশান সৈন্য আসে সে কথা মনে আছে? - ঘোড়ায় চড়ে? - হ্যাঁ, তোর দেখি ভাল মনে আছে.. ইরিনার ডাকে ওদের কথা চাপা পড়ে যায়। দেয়াল ঘেরা জায়গাটায় সবাই চলে এসেছে, যারা একটু পিছিয়ে পড়েছে ইরিনা চিৎকার করে তাদের ডাকছে। অরিন্দম রয়েছে এই দলে। সবাই কাছাকাছি চলে আসার পর ইরিনা আবার শুরু করল- -যুদ্ধের সময় এ জায়গাটি ছিল একটা রেল স্টেশন যদিও এখানে বা আশপাশে কোথাও এখন আর রেল লাইন দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধের পর এ শহরটা একেবারে নতুন করে গড়তে হয়েছে। পিয়ানিস্ট ছবিটা কে কে দেখেছেন? সমীর লক্ষ্য করছিল, বেশিরভাগ নারী পুরুষ হাত তুলল, ওদের মধ্যে অরিন্দম ছাড়া তিনজনের হাতই উপরে। ইরিনা বলতে থাকে- - পিয়ানিস্ট ছবিতে, ইহুদীদের শহর থেকে ক্যাম্পে নেবার জন্য একটি রেল স্টেশনে নেয়া হয়েছিল মনে আছে? অনেকেরই হ্যাঁসূচক প্রতিক্রিয়া দেখালে ইরিনা চালিয়ে যায়- ওই যে, যেখানে ওরা একটা ক্যান্ডি ভাগ করে খেয়েছিল, ছোট ভাইটা একটা বই পড়ছিল... (অনেকেই মাথা নাড়ছে...) (চলবে)
×