ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শরীফা খন্দকার

ডিমের চারা গাছ ॥ অতলান্তিকের তীর থেকে

প্রকাশিত: ১১:২২, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

ডিমের চারা গাছ ॥ অতলান্তিকের তীর থেকে

আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে অশ্রুতপূর্ব ‘এগপ্ল্যান্ট’ শব্দটা শুনে মনে মনে তাৎক্ষণিকভাবে তার বাংলাকরণ করেছিলাম ডিমের চারা! প্রবাদে ঘোড়ার ডিম শব্দটা আকসার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ডিমের চারা ব্যাপারটি কস্মিনকালে শুনেছে কেউ? তারপরও সেটা যদি হতো ঘোড়ার ডিমের চারা সেটাও না হয় হতো। তারপর সেটি নাকি একটা খাদ্যবস্তুর নাম। যদিও এগপ্ল্যান্টকে খাদ্যবস্তু বলা ভুলই হলো। কারণ প্রকৃত অর্থে সেটি হবে খাবার তৈরির এক উপকরণ। তরতাজা ডিমের এঁড়িগেঁড়ি (যেটাকে প্ল্যান্টের বাংলা করা যেতে পারে) দিয়ে নানা খাবারের অন্যতম হিসেবে অফিসের কিচেনে যে পদটি সেদিন রান্না করা হয়েছিল তার ‘এগপ্ল্যান্ট পারমেজন’ নামটি আমার কাছে অজানা দেশের না জানি কি’র মতোই ছিল বেশ বাহারি! তবে বলতে গিয়ে শীঘ্রই বলে না নিলে চলবে না ঘটনাটি ছিল প্রায় তিন দশক আগের পুরনো। নইলে আমাকে বিদেশে শুধু নয় বর্তমান সময়ে দেশেও হাসির খোরাকে পরিণত হতে হবে। অনেক বছর ধরেই নাকি বাংলাদেশের নামি রেস্টুরেন্টে তো বটেই, শুনেছি সৌখিন রাঁধুনীরা নাকি নিজেদের কিচেনেই রান্না করেন ‘এগপ্ল্যান্ট পারমেজন’। দিনটা ছিল মার্কিন দেশে আমার কর্মজীবনের প্রথম দিন। লাঞ্চ টাইমে কর্মস্থলের নানা রকমের খাবার বোঝাই বিশাল এক ক্যাফেটেরিয়ায় দাঁড়িয়ে কি যে খাব সেটা যেন কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না। সব খাবারের নামই তো ধরতে গেলে অপরিচিত- কোনটা কি দিয়ে তৈরি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অথচ খিদেয় চোঁ চোঁ করছে পাকস্থলী। সময়টা ছিল যেন বিখ্যাত সেই কবিতার- ওয়াটার ওয়াটার এভরি হোয়ার আই সি ইট ফার আই সি ইট নিয়ার ওয়াটার ওয়াটার এভরি হোয়ার নর এ্যানি ড্রপ টু ড্রিংক। .. আমার বাল্য-কৈশোরে কালের সাত সমুদ্র তেরো নদী দিয়ে ঘেরা পৃথিবীর আকারটা ছিল একরকম সুবিশাল। তার ওপর সে সময় তদানীন্তন পাকিস্তান দেশের যে অংশে ছিল আমার বসবাস সেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশ যাত্রার ছিল অতি দুর্লভ সুযোগের মতো। আর সেটা ধরতে পারলেই আন্তর্জাতিক পাসপোর্টটি পর্যন্ত করতে ডোমেস্টিক ফ্লাইটে চেপে হাজির হতে হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। সে কারণে আমাদের এক ছোট শহরের মানুষজনদের জীবনে ইউরোপ আমেরিকা যাত্রার ভাগ্যশিকা ছেঁড়া ছিল সুকঠিন। তদুপরি সেই সব অতি মুষ্টিমেয় সৌভাগ্যবানরা পরিবারের কোন নিকটজনও ছিলেন না। সেহেতু পরবাসে গিয়ে তারা কি খেয়েছেন এমন কথা কখনও কারও মুখে সামনা-সামনি শুনতে পাইনি। তারপরেও বাল্য-কৈশোরে আমেরিকা নামক দেশে ভ্রমণ না করেও আমি এবং আমার ভাই জেনেছিলাম মার্কিন মুলুকের জীবন ও খাবার দাবারের কিছু কিছু অজানা কথা। আর সেটা হয়েছিল রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির চত্বরে অবস্থিত ‘ইউসিস’ থেকে পাড়ার ছেলেদের হাতে হাতে আনা মার্কিন অনুবাদ গল্প-গ্রন্থ থেকে। আর সেসব বই অচিনপুরের অচেনা খাবার হিসেবে মোটামুটিভাবে জানা হয়েছিল স্যুপ ও স্যান্ডউইচটাকেই। মুজতবা আলীর ভ্রমণ কাহিনীতে অবশ্য বিলেতের খাবার নিয়ে পরবর্তীতে কিছু পড়া হয়েছে- সেখানকার অতি প্রিয় খাবার হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন আলুসিদ্ধ কাহিনী! তবে বাল্য-কৈশোরে স্যান্ডউইচ না খেলেও তদানীন্তন সময়ে মুরগির স্যুপ খাবারটা শহরাঞ্চলের সামান্য বাড়িতে তৈরি হতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত শয্যাশায়ী রোগীর খাবার হিসেবে। অবশ্য বার্লিকে যদি স্যুপের অন্তর্গত করা হয় তবে জ্বরজ্বারি হলে সেটা গলাধকরণের মর্মান্তিক অতীত স্মৃতি যাদের আছে তার শিখা উস্কে না দেয়াই ভাল। কিন্তু অভূতপূর্বভাবে ঢাকা শহরে ষাটের দশকে আসা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের কল্যাণে একদিন টেস্টিং সল্ট মিশিয়ে সুস্বাদু করে তোলা স্যুপ ক্রমশ তার তারল্য নিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল দেশব্যাপী। অতলান্তিক তীরে ভেড়ার দিন রাতে আশ্রয় নেয়া বাঙালী বন্ধুর বাড়িতে খেয়েছিলাম ভাত-ডাল-সবজি-মুরগির ঝোল। এগুলো তখন প্রায় প্রতিটি বাঙালী পরিবারের খাবার। পরদিন আর এক সুহৃদ রোববারের দুপুরে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন পিৎজা হাট নামে এক রেস্টুরেন্টে। ফেলে আসা ঢাকা শহরে পিৎজা নামে খাবারটি তখন মার্কিন স্ন্যাক্স হিসেবে অভিজাত সমাজে গুটি গুটি পা ফেলেছে। যদিও বেশিরভাগ মানুষ এর নামটাই শোনেনি তখনও। আমি দেশে পিৎজা নামের যে খাবারটির স্বাদ গ্রহণ করেছিলাম তার চেহারাটা ছিল মোটা এক পাউরুটির মতো তার ওপর সম্ভবত টমেটো সস এবং চিজ দিয়ে বেক করা এই খাবার আহামরি গোছের মনে হয়নি। নিউইয়র্কে দেখা হলো বিশাল আকারের রুটির ওপর নানা টপিংস দিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরই বানানো হয় পিৎজা। জানি দেশেও এখন তাই হয়। মার্কিন পিৎজাকে খাওয়া হয় একাধিক সøাইস করে আবার কাউকে একা একাই সেটা সাবাড়ও করতে দেখেছি। আটলান্টিকের দেশে পদার্পণের আগে একাধারে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কোন মানুষের এমন সুবিশাল দেহ তেমনি অন্য দিকে কেবল একজন মানুষের প্লেটে এমন বিপুল পরিমাণ ভোজ্যদ্রব্য ছিল একেবারে অকল্পনীয়। সেটা শুধু কি পিৎজার বেলায়? পরবর্তী দিনগুলোতে বার্গারের সাইজ দেখে তো চক্ষুই হয়েছিল চড়ক গাছ! এদেশে এসে ফাস্ট ফুডের দোকানে খেতে গিয়ে দেখলাম স্যুপ, স্যান্ডউইচের দিন চলে গেছে। মানুষ সেখানে খায় শত ধরনের বার্গার। একটা বিখ্যাত ফাস্ট ফুড দোকানের নামইতো বার্গার কিং। হ্যামবার্গেরের ইতিহাসে দেখেছি সেটা নাকি ঐতিহ্যগতভাবে জার্মানির হ্যামবার্গের খাবার- সেখান থেকে মানুষের সঙ্গে এই খাবার পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে। কয়েকদিনের মাথায় যত্রতত্র কাজ খোঁজার কারণে যখন বাইরে যাওয়া শুরু হলো তখন অবশ্য আমরা দিনে খেতাম দুনিয়া জোড়া সস্তা হিসেবে বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট ম্যাকডোনাল্ডস বার্গার। ক্যাফেটোরিয়ার একটি অংশে সালাদ বার। আমার এক নবীন সহকর্মী সুজান একটি সালাদ বোলে তুলে নিচ্ছিল সালাদ। জীবনভর দেখেছি বাড়িতে শসা, পেঁয়াজ, লেটুসপাতা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হয় সালাদ। কিন্তু আজ দেখলাম মাছ মাংস চিংড়ি রান্না করার জন্য যেসব শবজি রয়েছে সেগুলো হলো সেই শসা, পেঁয়াজ ও লেটুসপাতা। কিন্তু আমার কাছে সেদিন ভরদুপুরে প্রচ- এক ক্ষিদের মুখে শুধু সালাদ খাওয়া ছিল নৈব নৈব চ। আর একটা ফ্যাশেনেবল ঘের দেয়া স্থানে বার্গার জাতীয় কিছু বানিয়ে দেয়া হচ্ছিল খাদ্যেচ্ছুকদের অনুরোধে। তার পাশেই একটি ক্যারাবিয়ান কালো মেয়ে দাঁড়িয়েছিল রান্না ঘর থেকে সরাসরি আনা শেফের প্রস্তুত কিছু খাবারের ডিশ সামনে নিয়ে। অন্যান্য কাউন্টারে খাবারগুলো কেবলি সাজানো নিজ পছন্দে বেছে নিতে হয়। নানা স্থানে ঘুরেফিরে ওকেই বললাম -ক্যান আই গেট সামথিং মেড উইথ ভেজটেবিল? -ডু ইউ লাইক এগপ্ল্যান্ট? টুডে উই হ্যাভ এগপ্ল্যান্ট পারমেজন। ... জবাবে এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিভৃতে ওর কাছে কবুল করলাম -আই ডোন্ট নো হোয়াট ইজ এগপ্ল্যান্ট। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ব্যাপারটা বুঝে বলল- আই থিঙ্ক ইউ মাস্ট নো ব্রিঞ্জাল? তারপর হাসতে হাসতে আরও পরিষ্কার করে বলল -বাইগন বাইগন। ... ব্রিটিশ প্রভুদের শাসিত দেশসমুহে বেগুন অবশ্যই পরিচিত ছিল এবং অদ্যাবধিও আছে ব্রিঞ্জাল হিসেবে। এই শব্দটা আমরা ছোটবেলা পড়েছি বেগুনের ইংরেজী হিসেবে ওয়ার্ড বুকে। কা- দেখ সেই বেগুনই আমেরিকায় হয়ে গেছে এগপ্ল্যান্ট? লেখিকা : শরীফা খন্দকার নিউইয়র্ক প্রবাসী
×