ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বস্তির হাওয়া ক্রিকেটাঙ্গনে

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

স্বস্তির হাওয়া ক্রিকেটাঙ্গনে

মিথুন আশরাফ ॥ ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বুধবার বিসিবি সভাপতি ও আন্দোলনরত ক্রিকেটাররা দেখা করে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেন। তখনই সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, এমন আভাস মিলে যায়। সেই সমাধান শেষ পর্যন্ত হয়েও গেল। সোমবার থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত ক্রিকেটাঙ্গনে যে অস্বস্তির হাওয়া বয়ে গেছে, তা দূর হয়ে গেল। ক্রিকেটাররা আন্দোলন থামিয়ে মাঠের খেলায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই ক্রিকেটাঙ্গনে বইছে স্বস্তির হাওয়া। বোর্ড কর্তা, ক্রিকেটার, দেশী কোচ, গ্রাউন্ডসম্যান, আম্পায়ার, সর্বোপরি ক্রিকেটপ্রেমীরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন। তিনদিন ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কারও মুখেই হাসি ছিল না। হাসি উধাও হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) কর্মকর্তাদের কিংবা ক্রিকেটারদের মুখ মলিন হয়ে ছিল। সবার মধ্যেই একটা চিন্তা বিস্তার করেছিল। শেষ পর্যন্ত বুধবার রাতে ক্রিকেটারদের আন্দোলন থামায় ক্রিকেটাঙ্গন আবার প্রাণ ফিরে পায়। সোমবার ক্রিকেটাররা ও মঙ্গলবার বিসিবি সভাপতির বক্তব্যের পর যে হাওয়া গরম হয়ে উঠেছিল। বুধবার দুপুরে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও নাঈমুর রহমান দুর্জয় এবং বিকেলে আন্দোলনরত ক্রিকেটারদের পক্ষ থেকে সাকিব আল হাসানসহ সিনিয়র ক্রিকেটাররা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত মিলে যায়। বাকিটা সময় রাত পর্যন্ত শুধু চিন্তাই বাড়ে। সেই চিন্তা মাথা থেকে রাতে নেমেও যায়। এখন ক্রিকেটাররা যার যার মতো ক্রিকেটে ফিরছেন। আজ যেমন জাতীয় দলের ভারত সফরের প্রস্তুতি ক্যাম্প শুরু হয়ে যাবে। দুইদিন পিছিয়ে আজ শুরু হচ্ছে। শনিবার জাতীয় ক্রিকেট লীগের (এনসিএল) তৃতীয় রাউন্ডও মাঠে গড়াবে। দুইদিন পিছিয়ে এনসিএলও আবার মাঠে গড়াচ্ছে। তাতে করে ক্রিকেটাররাও খেলায় ফিরছেন। স্বস্তিই মিলেছে ক্রিকেটাঙ্গনে। সোমবার ক্রিকেটাররা ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে আন্দোলন শুরু করে দেন। প্রায় ৬০ জন ক্রিকেটারকে সঙ্গে নিয়ে পারিশ্রমিকসহ দাবি তুলে ধর্মঘটের ঘোষণা দেন ক্রিকেটাররা। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন জাতীয় দলের টেস্ট ও টি২০ অধিনায়ক সাকিব। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের ক্রিকেট বর্জন করার ঘোষণাও দেয়া হয়। মঙ্গলবার ক্রিকেটারদের এ দাবিগুলোর বিপরীতে কঠোর হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। দেশের ক্রিকেট ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এমন দাবি তোলেন। ক্রিকেটাররা খেললে, খেলবে, না খেললে, না খেলবে; এমন কথাও বলেন। ক্ষোভ দেখান। বিসিবি সভাপতির এমন ক্ষোভেও ক্রিকেটাররা অটল থাকেন। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখেন। বুধবার কী সমস্যার সমাধান হবে? কে মধ্যস্থতা করবেন? এমন প্রশ্ন ক্রিকেটাঙ্গনে উঠতে থাকে। ক্রিকেটপ্রেমীরাও গভীর আগ্রহে আন্দোলনের সব খবরাখবরের দিকে নজর রাখতে থাকেন। এমন সময়ই দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিসিবি সভাপতি দেখা করতে গেছেন, সেই খবর চাউর হয়ে যায়। গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন বিসিবি সভাপতি, এমন খবর মেলার পর থেকেই সমাধান আজই হয়ে যাবে, এমন কথাও শুরু হয়ে যায়। বিসিবি সভাপতি যখন গণভবন থেকে বের হয়ে বলেন, ‘আমরা খেলোয়াড়দের সব দাবি দাওয়া মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।’ তখনই আসলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত মিলে যায়। কিন্তু বিসিবি সভাপতি মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের বিসিবি কার্যালয়ে ক্রিকেটারদের আসার অপেক্ষায় বসে থাকেন। ক্রিকেটাররা আসেন না। তখন আবার অস্বস্তি জড়ো হয়। এরমধ্যে ক্রিকেটাররাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। তা জানা হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে হয়ত ক্রিকেটাররা আসবেন বিসিবিতে। এমন ধারণা জন্মে। কিন্তু ক্রিকেটাররা তা না করে উল্টো গুলশানে একটি হোটেলে জড়ো হন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। সেই সংবাদ সম্মেলনে ক্রিকেটারদের মুখপাত্র হয়ে আইন পরামর্শক ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান কথা বলেন। আগের ১১ দফা দাবির সঙ্গে আরও দুই দাবি যোগ করে দেন। পুরুষ ও নারী ক্রিকেটারদের বিসিবির লাভের ভাগ দিতে হবে। এ দাবি যোগ করে ১৩ দফা দাবি দেন। তখন সন্ধ্যা হয়ে রাত হতে থাকে। তাতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। বুধবার সমস্যার সমাধান না হওয়ার সম্ভাবনা জাগে। তবে বিসিবি সভাপতি যেহেতু বিসিবি কার্যালয় ছেড়ে তখনও যাননি, তাতে আবার ক্রিকেটার ও বিসিবির মধ্যে সভা হওয়ার সম্ভাবনা উড়ে যায়নি। যখন সংবাদ সম্মেলনে সাকিব বলেন, ‘দ্রুত সমস্যার সমাধান চাই।’ তখন বোঝা যায়, সমাধান হবেই। শেষপর্যন্ত সংবাদ সম্মেলন শেষে গুলশান থেকে বিসিবি কার্যালয়ে যান সাকিবরা। সেখানে দুই ঘণ্টা ধরে সভা হওয়ার পর বিসিবি সভাপতি ও সাকিব যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। দুইজনই জানান, ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। সমস্যার সমাধান হয়েছে। দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। তবে সোমবার দেয়া ১১ দফা দাবি নিয়েই আলোচনা হয়েছে। বুধবার যে আরও দুই দাবি দেয়া হয়েছে। সেগুলো নিয়ে পরে আলোচনা হবে। বিসিবি সভাপতি প্রথমে বলেন, ‘প্রথমেই খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তারা আসছে, আলোচনা করেছে। আমি আগেই বলেছিলাম, তাদের দাবি-দাওয়া যেগুলো আছে, সেগুলোর সবই প্রায় সমাধানযোগ্য। আমরা মোটামুটিভাবে ১১টা দাবির গতকাল (মঙ্গলবার) যেগুলো পেয়েছি সেগুলো মেনে নিয়েছি। যে ১১টা দাবি ছিল, তার মধ্যে প্রথম (কোয়াব নিয়ে) যেটা সেটা নিয়ে বিসিবির কিছু করণীয় নেই। আর শেষের যেটা, দুই ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগে খেলার নিয়ম বাতিল করা-এটা নিয়ে আমরা বলেছি যে, সেটা নিয়ে আমাদের নিজস্ব কিছু চিন্তা ভাবনা আছে। তারপরও যদি কারও দুয়ের অধিক ফ্র্যাঞ্চাইজিতে খেলার সুযোগ আসে, আমরা বিবেচনা করব। আমাদের জানামতে এখনও এমন কোন খেলোয়াড় নেই যে, যিনি দুটোর বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে ডাক পায়। তবে ঢালাওভাবে এখনই এ বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘বাকি যে ৯টি দাবি, সেগুলো মেনে নিয়েছি। আমি আগেই বলেছি, এই দাবিগুলো মেনে নেয়া সম্ভব। এগুলো আমরা মেনে নিয়েছি। এর মধ্যে আলোচিত বিষয় ছিল, খেলোয়াড়দের কিছু সুযোগ সুবিধা বাড়ানো। পারিশ্রমিক, এ্যালাউন্স, ইনস্যুরেন্স, ফ্যাসিলিটিজ-ইত্যাদি। তাদের আমরা বলেছি, এ বিষয়ে আমরা কোন কার্পণ্য করব না। সিগনিফিকেন্টলি এগুলো বাস্তবায়ন করব। ৫ মাসও লাগাব না, ৬ মাসও লাগাব না। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করব।’ সাকিব বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, যতটুকু হয়েছে, তাতে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে এবং ভালভাবে হয়েছে। আমাদের যেসব ডিমান্ড ছিল সেগুলোর বিষয়ে ওনারা (বিসিবি) আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন-যত দ্রুততর সময়ে সম্ভব সেগুলো বাস্তবায়ন করবেন। এই আশ্বাসের ভিত্তিতেই আমরা জাতীয় দলের খেলোয়াড় এবং লীগে খেলা খেলোয়াড়রা ক্রিকেটে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওরা (এনসিএল খেলা ক্রিকেটাররা) শনিবার থেকে এনসিএল খেলবে। আমরা (জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা) ২৫ তারিখে ফিরব জাতীয় দলের ক্যাম্পে।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘আমাদের ডিমান্ড ছিল ১৩টা। কালকের (মঙ্গলবার) যে ১১টা-ওগুলো নিয়েই কথা হয়েছে। আজকের (বুধবার) নতুন দুটি আলোচনা হয়নি। কারণ, ওই দুটা মাত্র তারা দেখছেন এবং এগুলো নিয়ে সময় লাগবে বলছেন। ওনারা বলেছেন যত দ্রুত সম্ভব বাকি দাবিগুলো বাস্তবায়ন করবেন। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শনিবার থেকে এনসিএল খেলব এবং ২৫ অক্টোবর থেকে ভারত সফরের প্রস্তুতি শুরু করব।’ সাকিবের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আন্দোলনও থেমে গেল। ক্রিকেটাররাও মাঠে ফিরতে শুরু করে দিয়েছেন। শনিবার জাতীয় লীগের তৃতীয় রাউন্ড শুরু হবে কক্সবাজার, বগুড়া ও রাজশাহীতে। নিজ নিজ দলের সঙ্গে যোগ দিতে ক্রিকেটাররা খেলার স্থানে বৃহস্পতিবার চলেও গেছেন। যারা ভারত সফরের টি২০ দলে সুযোগ পেয়েছেন, তারা ঢাকায় আছেন। আজ তারা প্রস্তুতি ক্যাম্পে অংশও নেবেন। তিনদিন অস্বস্তির পর অবশেষে সব ঠিক হয়েছে। ক্রিকেটাঙ্গনেও স্বস্তির হওয়া বইতে শুরু করেছে।
×