ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১৬ আসামির ফাঁসি ॥ নুসরাত হত্যা

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

১৬ আসামির ফাঁসি ॥ নুসরাত হত্যা

ওছমান হারুন মাহমুদ, ফেনী থেকে ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলাসহ ১৬ জনের ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। বৃহস্পতিবার সকালে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ মামুনুর রসিদ এই রায় দেন। ফাঁসির দ-প্রাপ্তরা হচ্ছে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদদৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান, জোবায়ের, জাবেদ হোসেন প্রকাশ শাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আবদুল কাদের, আফসার উদ্দিন, কামরুন নাহার মণি, উম্মে সুলতানা পপি, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, শামীম, রুহুল আমিন ও মহিউদ্দিন শাকিল। ফাঁসির পাশাপাশি আসামিদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। আসামিদের কাছ থেকে জরিমানার টাকা আদায় করে নুসরাতের পরিবারকে দেয়ার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দ্রুততম সময়ে মাত্র ছয় মাসের মাথায় বহুল আলোচিত এই মামলার রায় প্রদান করা হলো। সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় গত ৬ এপ্রিল নুসরাতকে সাইক্লোন সেন্টারের ছাদে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়। দগ্ধ নুসরাতকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে পরাজিত হন নুসরাত। এই ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং গ্রেফতার হয় হত্যাকা-ে জড়িত আসামিরা। গত ছয় মাসের দ্রুততম সময়ে বিচার প্রক্রিয়া শেষে বৃহস্পতিবার রায় প্রদান করেছে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। বেলা ১১টা ৭ মিনিটে বিচারক এজলাসে আসেন এবং আইনজীবীদের উদ্দেশে রায় সম্পর্কে আদালতের অবস্থান নিয়ে কথা বলেন । ১১টা ৮ মিনিটে রায়ের সার সংক্ষেপ পড়া শুরু করেন। তিন পৃষ্ঠার রায়ের সার সংক্ষেপ পড়ে ১১টা ১৮ মিনিটে রায় ঘোষণা করেন এবং এজলাস ত্যাগ করেন। নুসরাতের পরিবার এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে এই রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবেন। রায়ে বিচারক বলেন, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ফেনী জেলার অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দুই হাজারেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়া করে। এলাকার শিক্ষা সম্প্রসারণে সোনাগাজীর এই মাদ্রাসার আলোকোজ্জ্বল ভূমিকায় কালিমা লেপনের এ ঘটনা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির তেজোদীপ্ত আত্মত্যাগ তাকে ইতোমধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। তার এই আত্মত্যাগ চিরকালের অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি আসামিদের ঔদ্ধত্য মানবতাকে লজ্জিত করেছে। একারণে দৃষ্টান্তমূলক কঠোরতম শাস্তিই আসামিদের প্রাপ্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য বিষয়ে রাষ্ট্র পক্ষের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণপূর্বক আসামিদের পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফিকে চলতি সালের ৬ এপ্রিল ৯টা ৪৫ থেকে ৯টা ৫০ মিনিটের মধ্যে মাদ্রাসার সাইক্লোন সেন্টারের ছাদে ডেকে নিয়ে তারই ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত /০৩) এর ৪ (১) /৩০ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে উপরোক্ত দ- প্রদানের আদেশ দেয় হলো। রায়ে আসামিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে (১) অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদদৌলা : ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেন। (২) নুরউদ্দিন : ভিকটিমকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয়া, সর্বাত্মক সহযোগিতা করা, পরিকল্পনামাফিক ভিকটিমের গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনাকে নির্বিঘœ করার জন্য মাদ্রাসার গেটের বাইরে পাহারায় থাকা। (৩) শাহাদাত হোসেন শামীম : ভিকটিমকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয়া, আগুন লাগানোর জন্য কেরোসিন সংগ্রহ করা, ভিকটিমের হাত-পা বেঁধে ছাদে ফেলে তার মুখ ও মাথা চেপে ধরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগানোর ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিল। (৪) মাকসুদ আলম : ভিকটিমকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১০ হাজার টাকা প্রদান ও হত্যাকা-ের পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া। (৫) সাইফুর রহমান মোঃ জোবায়ের : ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা, আগুন লাগানোর সময় ভিকটিমের ওড়নাকে লম্বালম্বি ছিঁড়ে দুই ভাগ করে ভিকটিমের পা পেঁচিয়ে ম্যাচ দিয়ে কেরোসিন লাগানো কাপড়ে আগুন দেয়া। (৬) জাবেদ হোসেন : ঘটনাকে নির্বিঘœ করার জন্য মাদ্রাসার গেটে পাহারায় থাকা। ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা, ভিকটিমের গায়ে আগুন লাগানোর আগে কেরোসিন ঢালা। (৭) হাফেজ আবদুল কাদের : ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা। ভিকটিমের গায়ে আগুন লাগানোর ঘটনাকে নির্বিঘœ করার জন্য মাদ্রাসার গেটে ও বাইরে পাহারায় থাকা (৮) আবসার উদ্দিন : ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা। আগুন লাগানোর ঘটনাকে নির্বিঘœ করার জন্য মাদ্রাসার গেটের ভেতরে পাহারায় থাকা। (৯) কামরুন নাহার মনি : ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা, ভিকটিমের গায়ে আগুন লাগানোর ঘটনার আগে বোরকা ও হাত মোজা সংগ্রহ করা, ভিকটিমকে সাইক্লোন সেন্টারের ছাদের ফ্লোরে শুইয়ে দিয়ে বুক চেপে ধরে আগুন লাগানো নির্বিঘœ করা। (১০) উম্মে সুলতানা পপি : ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করা, ভিকটিমকে সাইক্লোন সেন্টারে ছাদে ডেকে নেয়া, ভিকটিমের ওড়না খুলে নিয়ে তার অংশ দিয়ে ভিকটিমের হাত বেঁধে ফ্লোরে শুইয়ে পা চেপে ধরে রেখে আগুন লাগানো নির্বিঘœ করা। (১১) আবদুর রহিম শরীফ : ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা। আগুন লাগানোর ঘটনাকে নির্বিঘœ করার জন্য মাদ্রাসার গেটের বাইরে পাহারায় থাকা। (১২) ইফতেখার উদ্দিন রানা : ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা। আগুন লাগানোর ঘটনাকে নির্বিঘœ করার জন্য মাদ্রাসার গেটের বাইরে পাহারায় থাকা। (১৩) ইমরান হোসেন মামুন : ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা। আগুন লাগানোর ঘটনাকে নির্বিঘœ করার জন্য মাদ্রাসার গেটের বাইরে পাহারায় থাকা । (১৪) মোঃ শামীম : ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা। আগুন লাগানোর ঘটনাকে নির্বিঘœ করার জন্য মাদ্রাসার ভেতরে সাইক্লোন সেন্টারের নিচে পাহারায় থাকা। (১৫) রুহুল আমিন : নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা জ্ঞাত থেকে উক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশ নেয়া ও সর্বাত্মক সহযোগিতা করা, ঘটনার পর আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করা। (১৬) মহিউদ্দিন শাকিল : ভিকটিমকে আগুন দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা। আগুন লাগানোর ঘটনাকে নির্বিঘœ করার জন্য মাদ্রাসার ভেতরে সাইক্লোন সেন্টারের নিচে পাহারায় থাকা। রায়ে উল্লেখ করা হয় ফাঁসির দ- ছাড়াও প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানার। সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে দ-িত আসামিদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার কথা। মামলার কার্যক্রম শুরুর ৬২ কার্য দিবসে নুসরাত হত্যা মামলার সকল আনুষ্ঠানিক পর্ব শেষে রায় ঘোষণা করে আদালত। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টার ঘটনার প্রায় ৭ মাসের মধ্যে দোষীদের বিচার কাজ শেষ হলো। এ সময় আসামিরা আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিল। গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্র, বাদী ও আসামিদের যুক্তিতর্কের ওপর আইনগত প্রশ্নের উত্তর শেষে আদালত ২৪ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। নিñিদ্র নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সকালে ফেনী কারাগার থেকে ১৬ আসামিকে আদালতে আনা হয়। আসামিদের স্বজন ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আদালত কক্ষের বারান্দায় ও আদালত আঙ্গিনায় রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সকলের চেহারায় ছিল উৎকণ্ঠার ছাপ। কার ভাগ্যে কী ঘটছে এমন ভাবনা নিয়ে আদালত আঙ্গিনায় পায়চারী করতে দেখা গেছে স্বজনদের। আসামিদের পরিচিতি সোনাগাজীতে আলোচিত নুসরাত হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ ২১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও পিবিআই। হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে আদালতে ১২ আসামি জবানবন্দী দিয়েছেন। হত্যাকা-ের পর নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলাসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন। আলোচিত নুসরাত হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আসামিদের কে কি করেন। অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের চরকৃষ্ণজয় গ্রামের করিম উল্যাহ সওদাগর বাড়ির মৃত কলিম উল্যাহর ছেলে সিরাজউদদৌলা। পিতা আমির উদ্দিন মুন্সির হাটের চা দোকানি। গ্রামবাসী ও পিতার অক্লান্ত পরিশ্রমে সিরাজ কামিল পাস করেন। এরপর ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের দৌলতপুর সালামতিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। সেখানে ৬ বছর চাকরি করার পর এক ছাত্রকে যৌন হয়রানি ও দুর্নীতির দায়ে সেখান থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রঙমালা মাদ্রাসায় চাকরি নিলে একই অপরাধে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০০০ সালের ১ জুন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসায় উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। চাকরিতে যোগদানের সময় অভিজ্ঞতার জাল সনদ দিয়ে তিনি ওই পদে চাকরি নেন। রাজনৈতিক জীবনে একসময়ে জামায়াতের রোকন থাকলেও উপজেলা জামায়াতের আমির মোস্তফা এবং সেক্রেটারির দাবি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ২০১৬ সালে জামায়াত থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করে মাদ্রাসায় নানা অনিয়ম দুর্নীতি করলেও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেননি। স্থানীয় বিত্তশালী ১১০ জন মিলে উম্মুল ক্বোরান নামের ফাউন্ডেশন করে একটি মাদ্রাসার জন্য জমি কেনাবেচা শুরু করলেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। আবদুল কাইয়ুম নিশান নামে একজন শেয়ার হোল্ডার ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। যা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় একটি নাশকতার মামলাসহ ৩টি মামলা রয়েছে। ফেনী শহরে একটি দোতলা বাড়ি রয়েছে। পারিবারিক জীবনে ৫ ভাই ৩ বোনের মধ্যে সিরাজ ছিল সবার বড়। বাকি ভাইয়েরা সবাই দিনমজুর দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। ২ কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক। দুই কন্যা বিবাহিত। ছেলে ডাক্তারি বিষয়ে অধ্যয়নরত। নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ২৭ মার্চ গ্রেফতার হন সিরাজউদৌলা। পরে নুসরাতের শরীরে অগ্নিসংযোগ করে হত্যার পর তাকে এ মামলায়ও গ্রেফতার দেখানো হয়। মোঃ নূর উদ্দিন সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের দক্ষিণ সর্দার বাড়ির দিনমজুর আহসান উল্যাহর ছেলে মোঃ নূর উদ্দিন। তার মা ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের কাজ করে। ৫ ভাইয়ের মধ্যে নূর উদ্দিন সবার বড়। বাকি ভাইয়েরাও ওই মাদ্রাসার ছাত্র। তার মায়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে সে ও তার ভাইদের অর্ধেক বেতনে পড়ালেখার সুযোগ করে দিতেন অধ্যক্ষ সিরাজ। অধ্যক্ষের অনুগত হিসেবে পরিচিত। তবে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল সে। সে ওই মাদ্রাসার ফাজিল এবং ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সে অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের আহ্বায়ক ছিল। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সে নুসরাত হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি। শাহাদাত হোসেন শামীম উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের চরচান্দিয়া গ্রামের নওয়াব আলী টেন্ডল বাড়ির আবদুর রাজ্জাকের ছেলে শাহাদাত হোসেন শামীম। ৩ ভাই এক বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। ছোটবেলা থেকে বেপরোয়া জীবযাপন করত সে। মাদ্রাসার ছাত্রলীগের সভাপতি ও চরচান্দিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এক প্রবাসীর স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার কারণে প্রায় তিন বছর পূূর্বে অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকা অবস্থায় গণধোলাইয়ের শিকার হয় শামীম। স্থানীয় জনতা আটক করে পুলিশে দিলে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে থানা থেকে ছাড়া পায়। পড়ালেখার পাশাপশি স্থানীয় ভূঞার হাটে মোবাইল ফোনের ব্যবসা করত সে। তার পিতা আবুধাবী থাকলেও বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন। দুই ভাই মালয়েশিয়া প্রবাসী। বোন বিবাহিত। ওই মাদ্রাসার ফাজিল ও ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সে। অধ্যক্ষ সিরাজের অনুগত হিসেবে মাদ্রাসার অভ্যন্তরে একটি কক্ষে ছাত্র সংসদের নামে নিয়মিত অফিস নিয়ে বসতেন শামীম। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে চাঁদা আদায় করে অধ্যক্ষ এবং সহযোগীরা ভাগবাটোয়ারা করতেন। তাকে ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই। সে নুসরাত হত্যা মামলার ৩ নম্বর আসামি। মাকসুদ আলম মাকসুদ আলম সোনাগাজী বাজার সংলগ্ন পান্ডব বাড়ির মরহুম আহসান উল্যাহর ছেলে। ৪ ভাই ২ বোনের মধ্যে মাকসুদ সবার বড়। সে পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক এবং ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। পেশায় এক সময় সবজি বিক্রেতা ছিলেন। সবার কাছে ‘আলু মুকসা’ হিসেবে পরিচিত। তার পিতাও সোনাগাজী বাজারের একজন সবজি বিক্রেতা ছিলেন। ২০১৭ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে ক্যাডার দিয়ে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে প্রভাব খাটিয়ে সোনাগাজী পৌর এলাকায় একের পর এক জায়গা দখল করতে থাকেন। ‘ভূমি খেকো’ হিসেবেও তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান। সোনাগাজী মেইন রোডের পশ্চিম পার্শে¦ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধীন জায়গাটি ইজারা নেন নুরুল করিম শিল্পী। তিনি ১৫ বছর যাবত শিল্পী স্টিল কর্পোরেশনের নামে নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা করে আসছেন। তার অর্ধকোটি টাকা মূল্যের আড়াই শতক জায়গাটির ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে কাউন্সিলর মাকসুদের। ২০১৭ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর শিল্পী স্টিল কর্পোরেশনের জায়গাটি দখল করে ও ১৫ লাখ টাকা মূল্যের মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় জায়গার মালিক নুরুল করিম শিল্পী মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের অব্যাহত হুমকি-ধমকিতে সোনাগাজী ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার পাশে টিটি আবদুর রবের কোটি টাকা মূল্যের ৪ শতক জায়গা দখল করে নেয়। চরগণেশ পান্ডব বাড়িতে জায়গা দখল করে ঘর নির্মাণ করেন মাকসুদ। সোনাগাজী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন প্রবাসী আবু সুফিয়ানের স্ত্রী শাহানা আক্তারের ৬ শতক জায়গাও দখল করে নেয় মাকসুদ। প্রতিবাদ করায় প্রবাসী আবু সুফিয়ানকে সোনাগাজী মডেল থানার সামনে গুলি করে হত্যার হুমকি দেয়। এরপর প্রাণভয়ে তিনিও চুপসে যান। এছাড়া প্রবাসী আবু তাহেরসহ অনেক ব্যক্তির বহু সম্পত্তি দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দলের প্রভাব খাটিয়ে উন্নয়ন কাজ বাগিয়ে নিয়ে নি¤œমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে নির্মাণ কাজ সম্পাদন করে নিজের আখের গুছিয়েছেন। তিনি নুসরাতের ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় ৪নং এজাহারভুক্ত আসামি। অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলার মুক্তি আন্দোলনে পক্ষে বিপক্ষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আরেক কাউন্সিলর শেখ মামুনের সঙ্গে হাতাহাতিতে লিপ্ত হন। প্রকাশ্যে অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে অবস্থান নেন। মোহাম্মদ জোবায়ের সোনাগাজী পৌর এলাকার ৬নং ওয়ার্ডের তুলাতলি গ্রামের মৌলভী খায়েজ আহম্মদের বাড়ির আবুল বশরের ছেলে। পিতা সোনাগাজী হাসপাতালের সামনে আল হেরা ফার্মেসির মালিক। ৪ ভাইয়ের মধ্যে জোবায়ের সবার বড়। পিতা জামায়াত সমর্থক হলেও সে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াত জোবায়ের। ছাত্রলীগের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কয়েকটি মোবাইল ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে সে। ওই মাদ্রাসার ফাজিল ও ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নুসরাত হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৫ নম্বর আসামি। মতিগঞ্জ ইউনিয়নের নানার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। জাবেদ হোসেন জাবেদ হোসেন চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের রহমত উল্যাহর ছেলে। ৪ ভাই ২ বোনের মধ্যে সে চতুর্থ। জাবেদ ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী। তার বিরুদ্ধে একটি মাদক মামলা আদালতে বিচারাধীন। তার পিতা চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। সে মাদ্রাসা ছাত্রলীগ কমিটির সদস্য এবং চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি। অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য এবং অধ্যক্ষের অনুগত ছাত্র। নুসরাতের ভাইয়ের মামলায় এজাহারভুক্ত ৬ নম্বর আসামি। হাফেজ আবদুল কাদের হাফেজ আবদুল কাদের সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের পূর্ব সফরপুর গ্রামের মনছুর খান পাঠান বাড়ির আবুল কাসেমের ছেলে। তার বাবা সাহেবের হাটের চা দোকানি। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে হাফেজ আবদুল কাদের পঞ্চম। তিনি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক এবং ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলার অনুগত হিসেবে মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকতেন আবদুল কাদের। তার পিতা আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। সে সরাসরি শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। নুসরাত হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৭নং আসামি হাফেজ আবদুল কাদের। রাজধানীর মিরপুরের ৬০ ফিট এলাকা সংলগ্ন ছাপড়া মসজিদের পাশে আবদুল কাদেরের বড় ভাই রহিমের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রভাষক আফছার উদ্দিন সোনাগাজী মাদ্রাসার ইংরেজি প্রভাষক আফছার উদ্দিন। সেই মাদ্রাসার পাশাপাশি অতিথি শিক্ষক হিসেবে ইংরেজি পড়াতেন সোনাগাজী এনায়েত উল্যাহ মহিলা কলেজে। এছাড়াও রয়েছে নিজের একটি কোচিং সেন্টার। নুসরাতও তার কাছে প্রাইভেট পড়তেন বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী। আফছার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের সওদাগর মাঝি বাড়ির আবদুল হকের ছেলে। দুই ভাই, ৫ বোনের মধ্যে আফছার সবার ছোট। বিএনপির রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত না থাকলেও বিএনপির সমর্থক বলে দাবি করেছেন এলাকাবাসী। ৬ এপ্রিল তাকে গ্রেফতার করে সোনাগাজী থানার পুলিশ। পরবর্তীতে গত ৮ এপ্রিল নুসরাতের ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় তাকে ৮ নম্বর এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়। আবদুর রহিম ওরফে শরীফ আবদুর রহিম শরীফ উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ-পূর্ব চরচান্দিয়া গ্রামের আবদুল মালেক চৌকিদার বাড়ির হাজী আবদুর শুক্কুরের ছেলে। ৪ ভাই ২ বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। ব্যক্তিগত জীবনে সে বিবাহিত। পড়ালেখার পাশাপাশি সোনাগাজী বাজারের একটি দোকানে মোবাইল মেকানিক হিসেবে কাজ করত। সে সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। পিতাও আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ একজন কর্মী। আগে সৌদি আরবে ছিল বর্তমানে বাড়িতে থাকেন। পুরো পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। আবদুর রহিম ওই মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষ ও ফেনী পলিটেকনিক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে ভাগ্নের বাসা থেকে আবদুর রহিমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রহিম অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ছিলেন। মোহাম্মদ শামীম মোঃ শামীম সোনাগাজী পৌর এলাকার ৫নং ওয়ার্ডের পশ্চিম তুলাতলি গ্রামের আলী জমাদার বাড়ির কৃষক শফি উল্যাহর ছেলে। ৪ ভাই ২ বোনের মধ্যে সে পঞ্চম। সে ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী। অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের কমিটির সদস্য। ২৮ ও ৩০ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তি আন্দোলনের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তাকে বাড়ির সামনে তার বোনের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। সে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিল এবং তার পিতাও অওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। এমরান হোসেন মামুন এমরান হোসেন মামুন সোনাগাজী পৌর এলাকার ৯নং ওয়ার্ডের চরগণেশ গ্রামের প্রবাসী এনামুল হকের ছেলে। দুই বোন ১ ভাইয়ের মাঝে সে মেঝ। ঘটনার দিন তার দায়িত্ব পড়ে গেট পাহারার। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুসরাতের রক্তের প্রয়োজন হলে ঢাকা মেডিক্যালে গিয়ে নুসরাতকে রক্ত দেয় মামুন। হাফেজ আবদুল কাদের ও শামীমের দেয়া জবানবন্দিতে উঠে আসে তার নাম। পরে তাকে কুমিল্লার পদুয়া থেকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সে অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তি পরিষদ আন্দোলন কমিটির সদস্য। অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তি আন্দোলনের মিছিলে নেতৃত্বও দিয়েছিল সে। মামুন ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ইফতেখার উদ্দিন রানা ইফতেখার উদ্দিন রানা সোনাগাজী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ইমান আলী হাজী বাড়ির জামাল উদ্দিনের ছেলে। তার পিতা টিএ্যান্ডটির অফিস সহকারী। বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে কর্মরত রয়েছেন। সে ওই মাদ্রাসার আলীম পরীক্ষার্থী। ২ ভাই ২ বোনের মধ্যে সে সবার বড়। তাকে রাঙ্গামাটির পিতার বাসা থেকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠায়। সে অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ছিল এবং অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তি আন্দোলনের মিছিলে অগ্রভাগে ছিল। সে মাদ্রাসা ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিল। মহিউদ্দিন শাকিল মহিউদ্দিন শাকিল সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের প্রবাসী রুহুল আমিনের ছেলে। সে এলাকায় ছাত্রদলের কর্মী হিসেবে পরিচিত। ২ ভাই ২ বোনের মধ্যে শাকিল তৃতীয়। সে অধ্যক্ষ মুক্তি আন্দলেনের মিছিলে অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তি পরিষদ আন্দোলন কমিটির সদস্য সে। তাকে ফেনী শহরের পূর্ব উকিলপাড়া থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই। শাহাদাত হোসেন শামীমের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে তার নাম। সে ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী। রুহুল আমিন সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন। তিনি সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের চরচান্দিয়া গ্রামের কেরানী বাড়ির কোরবান আলীর ছেলে রুহুল আমিন। তিন ভাইয়ের মাঝে রুহুল আমিন সবার বড়। পিতা মাতা, ভাই, স্ত্রী ও সন্তানেরা সবাই আমেরিকা প্রবাসী। ২০১৮ সালের শুরুতে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় রুহুল আমিনকে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে দলের সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একসময় সোনাগাজী ছাবের পাইলট হাই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মনোনীত হন তিনি। সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাাসা পরিচালনা কমিটির (সদ্য বাতিলকৃত) সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। অধ্যক্ষ সিরাজের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা হিসেবে সমালোচিত সে। রুহুল আমিনকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই। উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পা উম্মে সুলতানা পপি ছদ্ম নাম (শম্পা) অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলার শ্যালিকার মেয়ে। উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের লক্ষীপুর গ্রামের দরিদ্র রিক্সাচালক শহীদ উল্যাহর কন্যা। সে ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী। গত ১০ এপ্রিল রাতে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কামরুন নাহার মণি কামরুন নাহার মণি সোনাগাজী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ইমান আলী হাজী বাড়ির বিজিবি সদস্য মরহুম আজিজুল হকের পালিত কন্যা। ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী। ৯ এপ্রিল তাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মহদিয়া গ্রামের মেজবাউল আলম খান মিলনের ছেলে রাজুর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুললে প্রায় এক বছর পূর্বে পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নুসরাত হত্যার নেপথ্যে ফেনী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলীম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে গত ২৬ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা তার অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ র্মাচ সোনাগাজী থানায় অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলাকে আসামি করে মামলা করেন। এ মামলায় গত ২৭ মার্চ পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলাকে গ্রেফতার করে। সিরাজউদদৌলার নির্দেশে মাকসুদ কমিশনার, সাহাদাত হোসেন শামীম তাদের অনুসারীদের নিয়ে সিরাজউদদৌলার মুক্তির দাবিতে সোনাগাজী বাজারে মানববন্ধন করে এবং থানা ঘেরাও করার চেষ্টা করে। একই সাথে সিরাজউদদৌলার অনুসারীরা নুসরাতকে মামলাটি উঠিয়ে নেয়ার জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। নুসরাত মামলাটি উঠিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করায় গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষার হল থেকে ডেকে নিয়ে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করে সিরাজউদদৌলার অনুসারী নুসরাতের কয়েকজন সহপাঠী ছাত্র-ছাত্রী। গত ৬ এপ্রিল সকালে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত আলিমের আরবি পরীক্ষা প্রথম পত্র দিতে মাদ্রাসায় গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে ডেকে কৌশলে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। পরে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ দিন পর গত ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়। পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে সোনাগাজীতে তার জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। নুসরাত মারা যাওয়ার আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটের ডাক্তারের সামনে ডাইং ডিক্লারেশনে তার ওপর হামলার ঘটনা বলে যায়। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী, থানা পুলিশ, স্থানীয় কয়েকজন সুবিধাভোগী সাংবাদিক মরিয়া হয়ে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সে সময়ের জেলা পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে সাফাই গেয়ে নুসরাত আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে পুলিশ সদর দফতরে প্রতিবেদন দেয়। এ প্রতিবেদনের কারণে পরে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে ফেনী থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকা পুলিশ সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহারের আগে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়। গত ২৭ মে নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্থা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিও প্রচারের এ ঘটনায় আইসিটি এ্যাক্টে মামলায় ওসি মোয়াজ্জেম বর্তমানে ঢাকা কারাগারে রয়েছে। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলাকে প্রধান আসামিসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। নুসরাতের ওপর হামলার ঘটনায় ফেনী সোনাগাজীসহ সারাদেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। মশাল মিছিল, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করে দোষীদের গ্রেফতার ও বিচার দাবি করে। পিবিআই ও পুলিশ এ মামলায় ২১ জনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে হত্যায় সরাসরি জড়িত ৫ জনসহ ১২ জন আসামি আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী দেয়। এ মামলায় আটক থাকা চার্জশীটের বাইরের ৫ জনকে বিচারিক আদালত মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়। তারা হলেন- কেফায়েত উল্লা, আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, সাইদুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন । রায়ের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট আক্রামুজ্জামান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত এ মামলার রায়ে তা প্রমাণ হয়েছে। বাদী পক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু জানান, ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন আইনের চোখে সব সমান, এ যুগান্তকারী রায় অপরাধীদের জন্য একটি মেসেজ। আসামি পক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন নান্নু জানান- আসামি পক্ষ রায়ের কপি পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপীল করবে। নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান জানান- রায়ে তারা সন্তুষ্ট। রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তাদের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। নুসরাতের মা শিরিন আক্তার ও বাবা মোঃ মুছা মানিক একই কথা জানান- রায় দ্রুত কার্যকর করার জন্য আবেদন করেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান যে, তার হস্তক্ষেপ না হলে দ্রুততম সময়ে এ মামলার রায় হতো না এবং প্রভাবশালীদের দাপটে মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত হতো না।
×