ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শনিবার থেকে মাঠে ফিরবেন ক্রিকেটাররা

উভয়পক্ষের সমঝোতায় আন্দোলনের অবসান

প্রকাশিত: ১২:২৭, ২৪ অক্টোবর ২০১৯

উভয়পক্ষের সমঝোতায় আন্দোলনের  অবসান

মিথুন আশরাফ ॥ বুধবার দিনটি ক্রিকেটাঙ্গনে চরম উত্তাপ ছড়িয়েছে। কখনো মনে হয়েছে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আবার পরক্ষনে মনে হয়েছে সমাধান হবে না। শেষপর্যন্ত দিনভর নানা নাটকীয়তার পর রাতে সঙ্কটের নিরসন হলো। ১১ দফা দাবির সঙ্গে আরও দুই দাবি বাড়িয়ে সন্ধ্যায় ১৩ দফা দাবি দেন আন্দোলনরত ক্রিকেটাররা। এরপর রাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) ক্রিকেটাররা হাজির হন। বিসিবি সভাপতিসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। দুই ঘণ্টার দীর্ঘ সভা হয়। আলোচনা শেষে ক্রিকেটারদের সব দাবি মেনে নেয় বিসিবি। ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। ক্রিকেটাররাও আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটান। শনিবার থেকেই ক্রিকেটাররা মাঠে ফিরবেন। বুধবার দুপুরে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও পরিচালক নাঈমুর রহমান দুর্জয় এবং বিকেলে আন্দোলনরত সিনিয়র ক্রিকেটাররা ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে এ নিয়ে সাক্ষাত করেন। নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। এরপরই ধীরে ধীরে সমস্যা সমাধানের জট খুলতে থাকে। গণভবন থেকে বের হয়ে বিসিবি সভাপতি বলেন, ‘আমরা খেলোয়াড়দের সব দাবি দাওয়া মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।’ বিসিবি সভাপতির এমন বলার পর আন্দোলনরত ক্রিকেটাররা গণভবন থেকে বের হওয়ার পর গুলশানে একটি হোটেলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। এরপর আইনি পরামর্শক ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমানের মাধ্যমে নতুন দুই দাবি যুক্ত করে দাবিগুলো জানান। সঙ্গে সাকিব আল হাসান এও জানান, ‘দ্রুত সমস্যার সমাধান চাই।’ এরপরই বিসিবিতে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করতে যান ক্রিকেটাররা। সেখানেই বিসিবি যতটুকু পারা যায় সব দাবি মেনে নেয়ায় সমস্যার সমাধানও হয়। বিসিবি-ক্রিকেটারদের মধ্যে সভা শেষে বিসিবি সভাপতি পাপন বলেন, ‘ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। দাবিগুলো সব মেনে নেয়ার মতো। প্রথম দাবিটা (কোয়াবের কর্মকর্তাদের পদত্যাগ) আমাদের আয়ত্তে নেই। আর শেষ দাবি, দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগের বেশি খেলতে দেয়া, সেটা সময় অনুযায়ী দেখা যাবে। আলোচনা হয়েছে। বাকি দাবিগুলো মেনে নেয়া হবে। যেহেতু জাতীয় ক্রিকেট লীগের তৃতীয় রাউন্ড বৃহস্পতিবার শুরু হওয়ার কথা ছিল। তা এখন হচ্ছে না। শনিবার থেকে হবে। আর যেসব সমস্যা সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে শুরুতে যে ১১ দাবি তোলা হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শেষ দুটি দাবি (লাভের অংশ) নিয়ে আলোচনা হয়নি।’ শেষ দুই দাবি নিয়ে পরে আলোচনা হবে। সাকিব বলেন, ‘সব আলোচনাই ফলপ্রসূ হয়েছে। ভালভাবেই হয়েছে। প্রেসিডেন্টসহ যারা ছিলেন, তারা আশ্বাস দিয়েছেন। যেগুলো দ্রুত হওয়া সম্ভব, সমাধান করে দেবেন। আমরা শনিবার থেকেই ক্রিকেটে ফিরব। ক্যাম্পেও ফিরব। কোয়াব থেকে কর্মকর্তাদের পদত্যাগ নিয়েও কথা হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দ্রুততম সময়ে যেন নির্বাচন হয়, তা দেখা হবে। আমরা বর্তমান ক্রিকেটাররা যখন থাকব একসঙ্গে, তখন এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। আমাদের বেশিরভাগ দাবি দাওয়াই পূরণ হয়েছে। এখন পর্যন্ত যে আলোচনা হয়েছে, তা ফলপ্রসূ হয়েছে।’ এরআগে সোমবার হঠাৎ করেই আন্দোলন শুরু করে দেন ক্রিকেটাররা। সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে ১১ দফা দাবি তুলে ধরে আন্দোলনের ডাক দেন দেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটাররা। জাতীয় ক্রিকেট দলের ভারত সফরের ঠিক আগমুহূর্তে মিরপুরে জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি মাঠে প্রায় ৬০ জন ক্রিকেটারকে সঙ্গে নিয়ে পারিশ্রমিকসহ মোট ১১টি দাবি তুলে ধর্মঘটের ঘোষণা দেন জাতীয় দলের টেস্ট ও টি২০ অধিনায়ক সাকিব। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সবধরনের ক্রিকেট বর্জন করার ঘোষণাও দেন ক্রিকেটাররা। মঙ্গলবার বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন পরিচালকদের সঙ্গে সভা করেন। এরপর সংবাদ সম্মেলনে এসে ক্রিকেটারদের এমন আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করেন। ক্ষোভ দেখান। ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এমন বলেন। ক্রিকেটাররা খেললে, খেলবে; না খেললে না খেলবে, এমন জানান। তাতে ক্রিকেটারদের ভেতর যেন ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। সেই বেড়ে যাওয়া ক্ষোভ থেকেই কিনা ক্রিকেটাররা আরও দুই দফা দাবি বাড়িয়ে দেন। যেখানে দুই দাবির একটি হচ্ছে, পুরুষ ক্রিকেটারদের বিসিবির লাভের ভাগ দিতে হবে। একইভাবে নারী ক্রিকেটারদেরও ভাগ দিতে হবে। পারিশ্রমিক একটা সম্মানের জায়গায় নিতে হবে। ক্রিকেটাররা লিঙ্গ বৈষম্যে বিশ্বাস করে না। তাই পুরুষ ক্রিকেটাররা যে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে তার সব নারী ক্রিকেটারদেরকেও দিতে হবে। এছাড়াও ক্রিকেটারদের যে এক নম্বর দাবি ছিল, প্লেয়ার্স এ্যাসোসিয়েশন কোয়াবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। এর সঙ্গে নতুন একটি ধারাও যোগ করা হয়েছে। পেশাদার ক্রিকেটারদের আলাদা একটি সংগঠন চায় ক্রিকেটাররা। ক্রিকেটাররা শেষপর্যন্ত যে ১৩ দফা দাবি তুলেন, তা ক্রিকেটারদের আইনী পরামর্শক ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান মুখপাত্র হয়ে সাংবাদিকদের জানান। এ দাবিগুলো লিখিত আকারে বিসিবির কাছেও জমা দেয়া হয়েছে। ব্যারিস্টার বক্তব্য দেয়ার পর সাকিব আল হাসানও বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘বোর্ডের কারও সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ, দুঃখ কিংবা বিরাগ নেই। ব্যক্তিগত কোন সমস্যা নেই। শ্রদ্ধা যেমন ছিল, তেমনই আছে। আমরা সবাই মিলেই ক্রিকেট বোর্ড। দ্রুত সমস্যার সমাধান চাই। বোর্ডের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাই। আমরা কিছু দাবি তুলে ধরেছি। যেগুলা যৌক্তিক।’ এরআগে সোমবার যে ক্রিকেটাররা ১১ দফা দাবি তুলেছিলেন সেগুলো ছিল এমন-প্রথম দাবি, ক্রিকেট কল্যাণ সমিতির (কোয়াব) সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, যারাই আছেন, তাদের অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। যেহেতু এটা প্লেয়ার্স এ্যাসোসিয়েশন, ক্রিকেটাররাই নির্বাচনের মাধ্যমে পছন্দ করবে, কারা এখানে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হবেন। দ্বিতীয় দাবি, আগে প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটাররা যেভাবে খেলতেন, যেভাবে ক্রিকেটাররা ক্লাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে চুক্তি করতেন, যেভাবে নিজেদের পারিশ্রমিক নিয়ে এবং কোন ক্লাবে খেলবেন তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, সেভাবেই হবে। ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েজে’র নিয়ম থাকবে না। তৃতীয় দাবি, এবার বিপিএল বঙ্গবন্ধুর নামে বিসিবি নিজেরাই আয়োজন করবে। সেটিকে ক্রিকেটাররা সম্মান করেন। তবে আগের যে নিয়মে বিপিএল হচ্ছিল, সেটি যেন পরের বছর থেকে চলে আসে। সঙ্গে বিদেশি ক্রিকেটারদের সঙ্গে স্থানীয় ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের সামঞ্জস্য যেন থাকে। বিশ্বের অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হয়, যেখানে ক্রিকেটাররা ড্রাফটে নিজেদের গ্রেড নির্ধারণ করতে পারেন যে তারা কোন গ্রেডে থাকবেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও এই অধিকার চান। চতুর্থ দাবি, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ম্যাচ ফি অন্তত ১ লাখ টাকা হওয়া উচিত। এই দাবি তুলেছেন ক্রিকেটাররা। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটারদের বেতন অনেক কম। সেটি অন্তুত ৫০ শতাংশ বাড়ানোর দাবি করা হয়। পঞ্চম দাবি, ক্রিকেটারদের অনুশীলন সুবিধা বাড়াতে হবে। জিম-মাঠ সবকিছু বাড়াতে হবে। ১২ মাসের জন্য কোচ-ফিজিও-ট্রেনার নিয়োগ দিতে হবে এবং তারাই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটারদের একটি সিস্টেমের ভেতর নিয়ে আসবে, তাদের পরিকল্পনামতোই ক্রিকেটাররা কাজ করবে। এবং এটি প্রতিটি বিভাগে করতে হবে। আমরা চাই না সবাইকে সব ট্রেনিং সেশন ঢাকায় করতে হবে। অবশ্যই বিভাগীয় পর্যায়ে নিজেদের ঘরের মাঠে করবে সবাই, তাহলেই আমাদের ক্রিকেটের প্রসার হবে। পরের মৌসুমের আগে তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্রিকেটের উন্নতির জন্য ও সংস্কৃতি বদলানোর জন্য যেগুলো জরুরী তা করতে হবে। একজন ক্রিকেটারকে উঠে আসতে হলে, পাইপলাইন ভাল করতে হলে, এই জায়গাটা ঠিক করতে হবে। দৈনিক ভাতা ও ভ্রমণ ভাতা বাড়াতে হবে। ক্রিকেটাররা যেন বিমান ভাড়া পায়। টিম হোটেলে জিম ও সুইমিংপুল অবশ্যই দরকার। এসি বাস বা যে বাসে ক্রিকেটাররা কমফরটেবল থাকবে, সেরকম একটি বাসে যেন নিয়ে যাওয়া হয়। ষষ্ঠ দাবি, জাতীয় দলের চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারের সংখ্যা এখন অনেক কম, এটি ৩০ জন করার দাবি করা হয়েছে। করতে হবে এবং তিন বছর ধরে বেতন বাড়ানো হয় না, বেতনও বাড়াতে হবে। সপ্তম দাবি, গ্রাউন্ডসম্যানের বেতন বৃদ্ধি, দেশী কোচদের তুলে ধরা, বিদেশী কোচ যত বেতন পায়, সেই মানের বেতন দেয়া, আম্পায়ারিং ভাল মানের, তাদের আর্থিক নিশ্চয়তা, জীবনের সুরক্ষা, ফিজিও-ট্রেনারদের ক্ষেত্রেও দেশীদের প্রাধান্য দিতে হবে। অষ্টম দাবি, দুটি চার দিনের ম্যাচের টুর্নামেন্ট খেলে (জাতীয় লিগ ও বিসিএল) ক্রিকেটাররা। একদিনের ম্যাচের টুর্নামেন্ট কেবল একটি। শুধু ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। আরেকটি টুর্নামেন্ট বাড়ানোর দাবি তোলা হয়েছে। জাতীয় লিগের ওয়ানডে টুর্নামেন্ট খেলতে চায় ক্রিকেটাররা। পাশাপাশি বিপিএলের বাইরে আরেকটি টি২০ টুর্নামেন্ট হওয়া উচিত, যেটি হতে পারে বিপিএলের আগ মুহূর্তে। নবম দাবি, ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার থাকতে হবে। দশম দাবি, বিপিএল ও প্রিমিয়ার লিগের পাওনা টাকা যেন সময়মতো পাওয়া যায়। যে সময়টি দেয়া থাকবে, সে সময়ের মধ্যেই যেন টাকা শোধ করা হয়। এগারোতম দাবি, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের ক্ষেত্রে দুটির বেশি টুর্নামেন্টে খেলতে না দেয়ার একটি নিয়ম আছে। সেই নিয়ম বাদ দিতে হবে। সোমবার করা ১১ দফা দাবির সঙ্গে বোর্ডের রাজস্বের ন্যায্য ভাগ দেয়া ও নারী ক্রিকেটারদের সঙ্গে পুরুষ ক্রিকেটারদের বেতনের ভারসাম্য করার যে দুটি দাবিসহ মোট ১৩ দফা দাবি করা হয় বিসিবি শেষ দুটি দাবি বাদ দিয়ে সব দাবি মেনে নেয়। আর তাই সঙ্কটও নিরসন হয়।
×