ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাসানচরে স্থানান্তর হতে আগ্রহ বাড়ছে রোহিঙ্গাদের

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ২৩ অক্টোবর ২০১৯

ভাসানচরে স্থানান্তর হতে আগ্রহ বাড়ছে রোহিঙ্গাদের

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ একদিকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিত হওয়ার কোন লক্ষণ নেই, অপরদিকে আশ্রয় শিবিরসহ বিভিন্নস্থানে বসতি গড়া রোহিঙ্গাদের কষ্টেরও শেষ নেই। অপরদিকে, উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয়রাও আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে বড় ধরনের সঙ্কটময় পরিবেশ অতিবাহিত করছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশে^র এমন কোন দেশ নেই যেখানে আলোচিত হয়নি। এছাড়া ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের রাতে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সরকার মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। বর্তমানে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লক্ষাধিক। এসব রোহিঙ্গাদের প্রতিটি পরিবারে জনসংখ্যাও বেড়ে চলেছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ পর্যন্ত দুই দফায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি আলোচিত হয়েছে। কিন্তু ইতিবাচক কোন ফল আসেনি। এদিকে, সরকার রোহিঙ্গাদের সাময়িক বসতির জন্য হাতিয়ার ভাসানচরে প্রায় ২৩শ’ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে আধুনিক বাসস্থান গড়ে তোলা হয়েছে। এ বাসস্থান নিয়েও চলেছে নানা প্রোপাগা-া। ফলে রোহিঙ্গাদের মাঝেও এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা জন্মেছে। ফলে রোহিঙ্গারা ভাসানচরেও স্থানান্তরিত হতে দীর্ঘদিন ধরে অপারগতা জানিয়ে আসছিল। কিন্তু বিভিন্নভাবে তাদেরকে ভাসানচরে ভিডিও ফুটেজ ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি জানানোর পর এদের অনেকের মাঝে ভাসানচরে যাওয়ার ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে এবং কেউ কেউ তাদের নামও দিয়েছে প্রশাসনের কাছে। আগামী ডিসেম্বর থেকে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হবে বলে শরণার্থী ও ত্রাণ কমিশনার কার্যালয় সূত্রে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। তবে এর আগে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভাসানচর পরিদর্শনের কথা রয়েছে। রোহিঙ্গা নেতাদের কেউ কেউ স্বীকার করেছেন তাদের ক্যাম্প ইনচার্জরা ভাসানচরে যে ভিডিও চিত্র তাদেরকে প্রদর্শন করেছে তাতে তাদের মাঝে ভাসানচর নিয়ে উৎসাহ জন্মেছে। রোহিঙ্গাদের জানানো হয়েছে সোমবার পর্যন্ত আরআরআর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হিলির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ভাসানচরে নির্মিত রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী বাসস্থান প্রকল্প পরিদর্শন করেন। এখানে আরও উল্লেখ্য সরকার উখিয়া-টেকনাফের বিপর্যয় ঠেকাতে ভাসানচর প্রকল্প নিয়েছে। প্রায় ৩০ বছর আগে জেগে ওঠা এই চরটি অতীতে গোচারণ ভূমি ছিল। এখন এই দ্বীপ মানুষের জীবন ধারণের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। ১৩ হাজার একর বিশিষ্ট এই চরের মাত্র ১৭শ’ ২ একর এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে এই অভ্যন্তর ভাগে নির্মাণ করা হয়েছে বসতঘর। যা জাতিসংঘ প্রদত্ত নিয়মনীতির চেয়েও বাড়তি সুবিধা। এসব ঘরে প্রাথমিক পর্যায়ে ১ লাখ রোহিঙ্গা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই প্রকল্প ইতোমধ্যে সোলার সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিটি হাউস এই সিস্টেমে বিদ্যুতায়িত থাকবে। চরের একটি অংশ গবাদি পশুর চাষ শুরু হয়েছে। নির্মিত হাউসের প্রতিটি কক্ষ জাতিসংঘ নির্দেশিত স্টান্ডার্ড সাইজের যেখানে রয়েছে আধুনিক বাথরুম ও টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ এ প্রকল্পে রয়েছে ১৫শ’ ক্লাস্টার হাউস, হাউসের প্রতিটি কক্ষের হাউস ১৪ বাই ১২ ফুট যা জাতিসংঘ নির্দেশিত স্টান্ডার্ড সাইজের তুলনায় বেশি। প্রতিটি হাউসে ৫টি করে কক্ষ তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্প কাজে যুক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। নৌবাহিনী ৩৮ বেসরকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছে। তবে আনুষঙ্গিক আরও কার্যক্রম এখনও চলমান। প্রকল্প পরিচালক নৌবাহিনী কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন নিশ্চিত করে বলেছেন, এই প্রকল্প নিয়ে দেশে বিদেশে নানা অপপ্রচার হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হিলির নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল সরেজমিন পরিদর্শনের পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে এবং এই প্রকল্প ও দ্বীপ মনুষ্য ব্যবহারের উপযোগী করে মত ব্যক্ত করে গেছেন। অপরদিকে, জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের পরিদর্শনের পর গত ১৫ মার্চ মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এক বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এটি বসবাসেরও যোগ্য নয়। কিসের ভিত্তিতে সংস্থাটি এই ধরনের কথা বলেছে তার কোন ব্যাখ্যা মিলেনি। এদিকে, দিন যতই অতিক্রান্ত হচ্ছে ততই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বহু সদস্য মাদক ও মানবপাচার, চুরি-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে। এছাড়া যে ৩০ আশ্রয় শিবির রয়েছে এগুলোর অবস্থান উখিয়া-টেকনাফের। এই উখিয়া-টেকনাফের মানুষ রোহিঙ্গা ভারে ব্যাপকভাবে জর্জরিত। সেখানকার পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে আছে। ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে প্রাথমিকভাবে সরানো গেলে চলমান পরিবেশের বিপর্যয় কিছুটা হলেও লাঘব হবে। এই চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সরকার দ্রুততম সময়ে ভাসানচরে যেটিকে আগে ঠেঙ্গারচর বলা হতো সেই চরে গড়ে তোলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য সাময়িক বাসস্থান প্রকল্প। এই প্রকল্পের ভিডিও ফুটেজ সঙ্গে সরকারী সহযোগিতা থাকার বিষয়টি যতই প্রচার হচ্ছে ততই রোহিঙ্গাদের অনেকে সেখানে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। এই প্রক্রিয়ায় আরআরসি কার্যালয়ে যে সম্মুখীপত্র রোহিঙ্গারা দিচ্ছে সেই পত্রে লেখা থাকছে ভাসানচরে স্থানান্তরে আগ্রহী বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের তালিকা। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, এই প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত : উখিয়া-টেকনাফ থেকে রোহিঙ্গা ভার কমাতে এটি একটি ইতিবাচক দিক। দ্বিতীয়ত : রোহিঙ্গারা যেহেতু এদেশের নাগরিক নয়, তারা আশ্রিত মিয়ানমারে তাদের ফিরে যেতেই হবেÑ সেক্ষেত্রে তাদেরকে উখিয়া-টেকনাফ থেকে স্থানান্তর করে ভাসানচরে বাসস্থান দেয়া হলে তারা স্থায়ীভাবে বসতি গড়ার তৎপরতা চালাবে। এটি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর একটি বিষয়ে পরিণত হবে। উন্মুক্ত পরিবেশে থেকে এরা ভাসানচর সংলগ্ন হাতিয়া নোয়াখালীর বিভিন্নস্থানে ভবিষ্যৎ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বিদ্যমান।
×