ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাঁটুর ব্যথায় লেজার চিকিৎসা

প্রকাশিত: ১৩:০১, ২২ অক্টোবর ২০১৯

হাঁটুর ব্যথায় লেজার চিকিৎসা

হাঁটুর ব্যথা একটি সর্বজনীন রোগ। অধিকাংশ মানুষই কোন না কোন বয়সে হাঁটুর ব্যথায় ভোগেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় অস্টিও-আর্থ্রাইটিস। হাত, পা ও মেরুদ-ের ওজন বহনকারী যে কোন জোড়াই অস্টিও-আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে মানব দেহের ওজন বহনকারী গুরুত্বপূর্ণ জোড়া বা জয়েন্ট হওয়ায় হাঁটুতে অস্টিও-আর্থ্রাইটিস আক্রান্তের ঝুঁকি ও প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। হাঁটুর জোড়া ফুলে গিয়ে পুঁজ বা তরল পদার্থ জমা হওয়ার প্রধান কারণ অস্টিও-আর্থ্রাইটিস। মানবদেহের অস্থিসন্ধি বা জোড়ার তরুনাস্থি বা তরুনাস্থির নিচের হাড়ের ক্ষয়জনিত পরিবর্তন কিংবা মেকানিক্যাল অস্বাভাবিকতা সাধারণভাবে অস্টিও-আর্থ্রাইটিস হিসেবে পরিচিত। একে ক্ষয়জনিত বাত বা ক্ষয়জনিত জোড়ার রোগও বলা হয়। হাঁটুর ব্যথার লক্ষণ ও কারণ হাঁটুর হাড়ের জোড়ায় ব্যথা, স্পর্শকাতরতা, শক্ত হয়ে যাওয়া, অনড় অবস্থা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ফুলে গিয়ে তরল পদার্থ জমা হওয়া অস্টিও-আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ। এ রোগে আক্রান্ত হলে জোড়ার তরুনাস্থি হাড়ের উপরের অংশকে সঠিকভাবে সুরক্ষা দিতে পারে না। এতে হাড় অনাবৃত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাড়ের উপরিভাগের পিচ্ছিল তরুনাস্থি ক্ষয় হয়ে যায় এবং লিগামেন্ট আলগা বা শিথিল হয়ে পড়ে। রোগী চলাচল ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এমন কি নড়াচড়া করতেও কষ্ট অনুভব করে। রোগী সাধারণত অবিরাম অসহনীয় ব্যথা বা হাড়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাংসপেশি এবং লিগামেন্ট বা রগে (হাড় ও মাংসের সঙ্গে সংযুক্ত তন্তু) জ্বালাপোড়া অনুভব করে। আক্রান্ত জোড়া নড়াচড়া করলে বা স্পর্শ করলে ‘ক্র্যাক’ (ক্রেপিটাস) শব্দ হতে পারে। এ অবস্থায় রোগী মাংসপেশির খিঁচুনি ও রগের সঙ্কোচন অনুভব করতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে জোড়ার ভেতর পুঁজ জাতীয় তরল পদার্থ জমা হতে পারে। রোগ বেড়ে গেলে আক্রান্ত হাড় ফুলে উঠে, অচল ও ব্যথাময় হয়ে ওঠে। হাড়ের জোড়ার নিজস্ব মেরামত ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং মেকানিক্যাল চাপকে অস্টিও-আর্থ্রাইটিসের প্রধান কারণ বলে বিবেচনা করা হয়। এসব চাপের উৎসের মধ্যে রয়েছেÑ জন্মগত বা রোগের কারণে হাড়ের বিন্যাসে ত্রুটি, আঘাত, অতিরিক্ত ওজন, জোড়ার সাপোর্টিং মাংসপেশির শক্তিক্ষয় এবং সংযুক্ত স্নায়ু বা নার্ভ দুর্বল হয়ে যাওয়া। প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই বংশগত কারণকে এ রোগের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতিরিক্ত ওজনের (স্থ’ুলতা) সঙ্গে হাঁটু অস্টিও-আর্থ্রাইটিস বৃদ্ধির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সেক্স হরমোনের পরিবর্তনের কারণেও অস্টিও-আর্থরাটিসে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়তে পারে। এ কারণে ৪০ উর্ধ মহিলাদের ঋতুচক্র বন্ধ হওয়া (মেনোপজ) বা সার্জারি করে জরায়ু ফেলে দেয়ার পর একই বয়সী পুরুষের তুলনায় এ রোগে আক্রান্তের প্রবণতা অনেক বেশি। অস্টিও-আর্থ্রাইটিস যেভাবে হাঁটুর ক্ষতি করে অস্টিও-আর্থ্রাইটিস হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগ হলেও এটি তরুনাস্থির অত্যধিক ক্ষতি করতে পারে। এ রোগের ফলে জোড়ার অন্যান্য টিস্যুর গঠন ভেঙে যেতে পারে। আক্রান্তের প্রথম পর্যায়ে হাড়ের জোড়ায় সূক্ষ্ম জৈব রাসায়নিক (বায়োকেমিক্যাল) পরিবর্তন ঘটতে পারে। মানবদেহের সুস্থ তরুনাস্থি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঙ্কোচিত হয়ে ভেতর থেকে পানি বের করে দেয় এবং পুনরায় ফুলে উঠে ভেতরে পানি প্রবেশ করায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তরুণাস্থির ভেতরের পানির অংশ সামঞ্জস্যপূর্ণ (ব্যালেন্স) থাকে। এক্ষেত্রে কোলাজেন ফাইবার (ঈড়ষষধমবহ ভরনৎবং) সঙ্কোচিত হওয়ার শক্তি জোগায়। কিন্তু অস্টিও-আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হলে কোলাজেন মেট্রিক্স অসংগঠিত হয়ে পড়ে এবং তরুনাস্থির মধ্যে প্রোটিওগ্লাইকেন (ঢ়ৎড়ঃবড়মষুপধহ)-এর উপাদান কমে যায়। এতে কোলাজেন ফাইবার ভেঙে যাওয়ার ফলে পানির উপাদান বেড়ে যায়। প্রোটিওগ্লাইকেন নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত কোলাজেন কমে গিয়ে পানির উপাদান বাড়তে থাকে। প্রোটিওগ্লাইকেনের প্রতিরোধ প্রক্রিয়া না থাকলে তরুনাস্থির কোলাজেন ফাইবার আশঙ্কাজনকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং নিঃশেষ প্রক্রিয়া আরও বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে তুলনামূলক কম হলেও পার্শ্ববর্তী জোড়ায়ও প্রদাহ হতে পারে। এতে হাঁটুর তরুনাস্থির ভেঙে পড়া বা আক্রান্ত উপাদানগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং জোড়ার আবরণের সেল এগুলোকে বাইরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করে। এতে জোড়ার শেষ প্রান্তে স্পার্স (ঝঢ়ঁৎং) বা অস্টিওফাইটিস (ঙংঃবড়ঢ়যুঃবং) নামে নতুন হাড় গজিয়ে উঠে। হাড়ের এই পরিবর্তন ও প্রদাহের কারণে আক্রান্ত স্থানে ব্যথার সৃষ্টি হয় এবং নিস্তেজ করে ফেলে। রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা রোগের ইতিহাস ও ডাক্তারি পরীক্ষার পর প্রয়োজনে এক্স-রের মাধ্যমে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। জোড়ার স্থানের আকার ও আয়তন পরিবর্তন, জোড়ার পিচ্ছিল তরুনাস্থির নিচের হাড় শক্ত হয়ে যাওয়া (ংঁনপযড়হফৎধষ ংপষবৎড়ংরং), তরুনাস্থির নিচে গর্ত তৈরি হওয়া (ংঁনপযড়হফৎধষ পুংঃ ভড়ৎসধঃরড়হ) এবং নতুন হাড় গজানোসহ সাধারণ পরিবর্তনগুলো এক্সরের মাধ্যমে ধরা পড়ে। হাঁটুর ব্যথা নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা সাধারণত ব্যায়াম, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং ব্যথানাশক ওষুধের সমন্বয়ে অস্টিও-আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা করা হয়। এরপরও ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠলে এবং শারীরিক অক্ষমতা বা পঙ্গুত্বের পর্যায়ে চলে গেলে অপারেশনের মাধ্যমে জোড়া পুনঃস্থাপন করে রোগীর জীবনযাত্রা উন্নত করা হয়। অস্টিও আর্থ্রাইটিসের আধুনিক চিকিৎসা অস্টিও-আর্থারইটিসে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত তরুনাস্থির কার্যক্ষমতা ফেরাতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার মাইক্রো-ফ্র্যাকচার পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ কাটাঁেছড়া ও রক্তপাতহীন লেজার রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমে আক্রান্ত হাড় ও তরুনাস্থিতে প্রয়োজন অনুযায়ী অতি ক্ষুদ্র ছিদ্র করা হয়। ন্যানো-ফ্র্যাকচার পদ্ধতিতে লেজার রশ্মির মাধ্যমে হাড়ের জোড়ার উপরিভাগে (সারফেস) অস্টিও-আর্থ্রাইটিস আক্রান্ত খোলা অংশে লেজার বিম দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী অতিক্ষুদ্র ছিদ্র করা হয়। এই ছিদ্রের মাধ্যমে অস্থি ও তরুনাস্থির সংযুক্ত নিচের হাড়ে রক্ত সঞ্চালন এবং নতুন বোনমেরু কোষের উপস্থিতি বাড়িয়ে দেয়া হয়। সঞ্চালিত রক্ত ও বোনমেরু কোষ হাড়ে নতুন তরুনাস্থি তৈরি করে। উল্লেখ্য, বোনমেরু থেকে উৎপন্ন মেসেনচাইমাল স্টেম (গবংবহপযুসধষ ংঃবস) ঘনীভূত করে (পড়হপবহঃৎধঃব) প্রয়োগে আক্রান্ত জোড়ার হাড় পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে এবং পিআরপি (ঢ়ষধঃবষধঃব ৎরপয ঢ়ষধংসধ) ঘনীভূত (পড়হপবহঃৎধঃব) প্রয়োগের মাধ্যমে জোড়ার চারপাশের নরম টিস্যু ((ঝড়ভঃ ঃরংংঁব) ও লিগামেন্টগুলো (খরমধসবহঃং) স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এই পদ্ধতিতে আর্থোস্কোপ নামক যন্ত্রের মাধ্যমে হাড় ও জোড়ার অংশগুলোর নিরীক্ষণ করে লেজার রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। এই চিকিৎসায় যে ধরনের বা যে মাত্রার লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়ে থাকেÑ তাতে কোন রকম পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে। উন্নত বিশ্বে এই পদ্ধতির চিকিৎসার সফলতা ও জনপ্রিয়তা ব্যাপক। বাংলাদেশেও ইনস্টিটিউট অব লেজার সার্জারি এ্যান্ড হসপিটালে অত্যন্ত সফলভাবে লেজার রশ্মির মাধ্যমে অস্টিও-আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা করা হচ্ছে। ডাঃ মোঃ ইয়াকুব আলী লেজার সার্জারি বিশেষজ্ঞ, পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব লেজার সার্জারি এ্যান্ড হসপিটাল ফোন : ০১৭৭১২৫৯৭২০-১
×