ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ সদরের বিবৃতি

নিহত ৪ জনের মধ্যে দুই জনের মাথা থেঁতলানো

প্রকাশিত: ১১:১১, ২২ অক্টোবর ২০১৯

নিহত ৪ জনের মধ্যে দুই জনের মাথা থেঁতলানো

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ফেসবুক মেসেঞ্জারকে কেন্দ্র করে ভোলার বোরহানউদ্দিনে পুলিশের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষে যে চারজন নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে দু’জনের মাথা ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে থেঁতলানো ছিল বলে চিকিৎসকের বরাতে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। সদর দফতরের বিবৃতিতে জানানো হয়, সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। এতে পুলিশের দুই সদস্য মারাত্মক জখম হন। আক্রমণকারীদের গুলিতে মারাত্মক আহত এক পুলিশ সদস্যকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের বিবৃতিতে জানানো হয়, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে ডিআইজি বরিশাল রেঞ্জকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, এসবি, পিবিআই এবং জেলা পুলিশ থেকে একজন করে মোট চারজন কর্মকর্তা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটিকে সাত কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। সদর দফতর বিবৃতিতে জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট না করতে সাধারণ মানুষের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে পুলিশ সদর দফতর থেকে। সেইসঙ্গে কোন ধর্মীয় উপাসনালয়ে আক্রমণ না করতেও অনুরোধ করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা ঈদগাহ মাঠে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশসহ সাধারণ মানুষের হতাহতের ঘটনায় বাংলাদেশ পুলিশ সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ঘটনা সংক্রান্তে যে কোন প্রকার বিভ্রান্তি এড়াতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স প্রকৃত ঘটনাটি জনসমক্ষে তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছে। গত ১৮ অক্টোবর ‘ইরঢ়ষড়ন ঈযধহফৎধ ঝযাঁড়’ নামে নিজ ফেসবুক আইডি হ্যাক করে। এরপর সেই আইডির মেসেঞ্জারে ‘ধর্ম অবমাননাকর’ কথাবার্তা চালানো হয়। সেই কথোপকথনের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে দেয়া হলে সেটি ভাইরাল হয়। এরপর ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে ডাক দেয়া হয় বিক্ষোভ সমাবেশের। ওই তরুণ ওইদিনই রাত ৮টার দিকে ভোলার বোরহানউদ্দিন থানায় জিডি করেন। জিডি নম্বর- ৪৪০। জিডি করার সময় থানায় অবস্থানকালেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যের নম্বরে একটি কল আসে এবং তার কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে সে ওসিকে জানায়। ওসি বিষয়টি ভোলা জেলার পুলিশ সুপারকে জানায়। এরপর প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সেদিন রাতের মধ্যেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যের ফেসবুক হ্যাকার এবং তার কাছে চাঁদা দাবি করা শরীফ এবং ইমন নামে দুই যুবককে যথাক্রমে পটুয়াখালী এবং বোরহানউদ্দিন থেকে আটক করে পুলিশ। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে বোরহানউদ্দিন থানায় আনা হয়। পুলিশ সদর দফতরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এরইমধ্যে শুভর ফেসবুক এ্যাকাউন্টে কথিত কমেন্টের জেরে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমান উত্তেজিত হতে থাকেন। ফেসবুকে ধর্মীয় মন্তব্যের অভিযোগে মন্তব্যকারীর ফাঁসি দাবি করেন স্থানীয় আলেম সমাজ। পরদিন ২০ অক্টোবর সকাল ১১টায় ঈদগাহ মাঠ ময়দানে তারা প্রতিবাদ সভার ঘোষণা দেন। জেলা প্রশাসক, ইউএনও, থানার ওসি এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ আলেম সমাজের প্রতিনিধিগণের উপস্থিতিতে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় বোরহানউদ্দিন থানায় দীর্ঘ সময় বিষয়টি আলোচনা হয়। আলেম সমাজের অভিযোগের ভিত্তিতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যকে আটক দেখানো হয়। এ বিষয়ে উপযুক্ত আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা পেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী আলেম সমাজ তাদের পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ কর্মসূচী বাতিল করেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সমাবেশ বাতিল ঘোষণার পরও পুলিশ সর্বক্ষণিক সতর্ক থাকে। পরদিন ২০ অক্টোবর সকাল থেকেই কিছু লোক ঈদগাহ মাঠে জড়ো হতে থাকে। ময়দানের বিভিন্ন পয়েন্টে বসানোর জন্য ১৭টি মাইক আনে একটি মহল। যে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সমবেত লোকজনকে সরিয়ে নিতে বললে উপস্থিত আলেমগণ নিশ্চিত করেন যে, তারা কোন রকম বিশৃঙ্খলা করবে না। এরই মধ্যে পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় এবং যে কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে স্থানীয় পুলিশকে সহায়তা দিতে সকালেই বরিশাল থেকে রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি ভোলায় আসেন। অতিরিক্ত ডিআইজি ও ইউএনও’কে নিয়ে পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করে প্রয়োজনীয় সকল আইনী ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে তাদের বার বার আশ্বস্ত করেন। তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে সমবেত লোকজন ঈদগাহ মাঠ ত্যাগ করেন। উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য শেষে পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত ডিআইজিসহ অন্য কর্মকর্তারা মাদ্রাসার একটি কক্ষে অবস্থান নেন। এরই মধ্যে অন্য একটি গ্রুপ ঈদগাহ মাঠে প্রবেশ করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে উত্তেজিত করতে থাকেন। এক পর্যায়ে একদল লোক বিনা উস্কানিতে মাদ্রাসার অফিস কক্ষে অবস্থানরত কর্মকর্তাদের আক্রমণ করে। আক্রমণকারীদের একদল আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ ও অন্য কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় তাদের গুলিতে পুলিশের একজন সদস্য মারাত্মক জখম হন। মারাত্মক আহত হন পুলিশের আরেক সদস্য। বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজিও আহত হন। এই পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষা, সরকারী জানমাল রক্ষা ও উত্তেজিত লোকজনকে নিবৃত্ত করতে ইউএনও এবং এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে প্রথমে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে ও পরে শটগান চালায় পুলিশ। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। এতে চারজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক। অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। আহতদের অনেক বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) ও ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। নিহতরা হলো বোরহানউদ্দিন উপজেলার মহিউদ্দিন পাটওয়ারীর মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে মাহবুব (১৪), উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের দেলওয়ার হোসেনের কলেজপড়ুয়া ছেলে শাহিন (২৩), বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাহফুজ (৪৫) ও মনপুরা হাজিরহাট এলাকার বাসিন্দা মিজান (৪০)। নিহত চারজনের মধ্যে অন্তত দুইজনের মাথা ভোঁতা অস্ত্র দ্বারা থেঁতলানো বলে নিশ্চিত করেছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। আক্রমণকারীদের গুলিতে মারাত্মক আহত পুলিশ সদস্যকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে ডিআইজি বরিশাল রেঞ্জকে প্রধান করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, এসবি, পিবিআই এবং জেলা পুলিশ থেকে একজন করে মোট চারজন কর্মকর্তা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটিকে সাত কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনাস্থলসহ সারাদেশে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট না করতে এবং কোন অবস্থাতেই ধর্মীয় উপাসনালয়ে আক্রমণ না করতে সাধারণ জনগণকে অনুরোধ জানাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। পাশাপাশি, গুজবে কান না দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য সকলের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
×