ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্ঘটনা থামছেই না ॥ সড়ক নিরাপত্তায় স্তরে স্তরে গলদ

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২২ অক্টোবর ২০১৯

দুর্ঘটনা থামছেই না ॥ সড়ক নিরাপত্তায় স্তরে স্তরে গলদ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সারাদেশে ইচ্ছেমতো দেয়া হচ্ছে যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন। সরকারী হিসাবেই সাড়ে চার লাখ ফিটনেসবিহীন যান চলছে দেশজুড়ে। রাজধানী ঢাকায় চলছে এক লাখ ৬৩ হাজার লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি। প্রায় ৪২ লাখ বৈধ যানবাহনের বিপরীতে লাইসেন্স আছে ৩৪ লাখ চালকের। অর্থাৎ আট লাখের বেশি অবৈধ চালক রাস্তায় দাবড়ে বেড়াচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের সঙ্গে ‘দফা রফা’ খেলায় সড়ক-মহাসড়কে চলছে নিষিদ্ধ তিন চাকার অবৈধ যান। অনুমোদনহীন যানবাহনের ছড়াছড়ি সবখানেই। চালক সঙ্কট, লাইসেন্স প্রদান ও যানবাহন পরীক্ষায় গলদ, সড়ক নির্মাণে প্রকৌশলগত ত্রুটি, ট্রাফিক আইন না মানা, রাস্তার দুপাশ দখল, বেপরোয়া গতি, দুর্ঘটনা রোধে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ার মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা দিবস-’১৯। ’১৭ সাল থেকে প্রতিবছর ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস সরকারীভাবে পালিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্তরে স্তরে গলদের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য সবার আগে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া সব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে আন্তরিক হওয়ার বিকল্প নেই। পাশাপাশি পরিবহন মালিক, শ্রমিক, যাত্রীসহ সব পক্ষ থেকে দুর্ঘটনা রোধে সচেতন হতে হবে। অন্যথায় নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার বিষয়টি শুধু কথার কথাই থাকবে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচিত। দুর্ঘটনা হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কাগজেকলমে। বাস্তবে কতটুকু সড়ক নিরাপদ হয়েছে, সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। সড়ক দুর্ঘটনার মতো এই জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হলে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার এখনই সময়। ৪২ লাখ গাড়ি চালায় ৩৪ লাখ চালক ॥ বিআরটিএ তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা ৩৩ লাখ ৭১ হাজার ৮৯২। এর বিপরীতে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত দেশজুড়ে বিআরটিএ লাইসেন্স দিয়েছে ৪১ লাখ ৭৬ হাজার ৪২৫ গাড়ির। মোট গাড়ির মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা সাড়ে ২৭ লাখের বেশি। বাস প্রায় পাঁচ লাখ। আর অটোরিক্সার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৪০২। সব মিলিয়ে আট লাখের বেশি অবৈধ চালক। রাজধানী ঢাকায় রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত গাড়ির সংখ্যা ১৪ লাখ ৯৩ হাজার ২৩৩। এর মধ্যে ছয় লাখ ৯২ হাজার মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের সংখ্যা ২ লাখ ৮৮ হাজার ৪২০। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সব গাড়িই চলছে। কিন্তু চালক সঙ্কটে ৮ লাখ অবৈধ চালকই গাড়ি চালাচ্ছে। এর বাইরে অবৈধ যানবাহন ও চালকের সঠিক কোন পরিসংখ্যান বিআরটিএর হাতে নেই। সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিশ্রুতিরও বাস্তবায়ন নেই ॥ ’১৮ সালের আগস্টের শুরুতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র বিক্ষোভের পর পেরিয়ে গেছে এক বছরের বেশি। এর পর এ বছরের মার্চেও সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে আবার ছাত্র বিক্ষোভ হয়। দুটি বড় ঘটনায় পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে বা কতটুকু বদলেছে সে চিত্র নেতিবাচকই রয়ে গেছে। গত বছরের বিক্ষোভ দমনে সরকারের সর্বোচ্চ দফতর থেকে নানা প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছিল। দুর্ঘটনারোধে দেয়া হয়েছিল বেশ কয়েকটি নির্দেশনা। বাস্তবে দেখা গেছে সেসবের অনেককিছুরই বাস্তবায়ন হয়নি। ’১৮ সালের আগস্টের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ‘গবর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট’র সভায় সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ২০ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্য কয়েকটি সুপারিশ ছিল :- ঢাকায় বাস চলাচলের সময় গাড়ির মূল দরজা বন্ধ রাখতে হবে, নির্ধারিত বাস স্টপেজ ছাড়া যেখানেসেখানে যাত্রী ওঠানামা নিষিদ্ধ করা, গণপরিবহনে দৃশ্যমান জায়গায় চালক ও সহকারীর পরিচয় প্রদর্শন, মোটরবাইকে সর্বোচ্চ দুজন আরোহী এবং হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক, ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাসের আশপাশে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা, পথচারীদের চলাচলের সুবিধার জন্য ফুটপাথ হকারমুক্ত করা, রুট পারমিট এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহনকে দ্রুত ধ্বংসের সম্ভাব্যতা যাচাই। কিন্তু এসব নির্দেশের কোন কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। তা হচ্ছে মোটরসাইকেল আরোহীদের হেলমেট ব্যবহার। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না। এ অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। বিভিন্ন সময় পুলিশ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। তারা শুধু জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করছে, ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং লাইসেন্সবিহীন চালক ফের রাস্তায় ফিরে আসছে। বিআরটিএর সড়ক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক শেখ মাহবুব-ই-রাব্বানী দাবি করেন, সড়ক নিরাপত্তার বিধানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি আছে। তিনি বলেন, চালক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আমরা পরিচালনা করছি। পেশাদার লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে আমরা বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। আমরা এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম জোরদার করেছি। আগে যেখানে পাঁচ ম্যাজিস্ট্রেট ছিল, এখন আমাদের ১০ ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছে। প্রতিদিন মোবাইল কোর্ট চলছে। নানা অপরাধে চালকদের জেলে দেয়া হচ্ছে। শত শত গাড়ি ডাম্পিং স্টেশনে পাঠানো হচ্ছে। প্রচুর অভিযান চললেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে না বলে মনে করেন সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি মনে করেন, গণ-পরিবহনে শৃঙ্খলা আনার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, নির্দেশনার কমতি ছিল না। পুলিশেরও কিন্তু এ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রামের কমতি দেখিনি। হাজার হাজার মামলারও কমতি দেখিনি। কিন্তু সিস্টেম কারেকশনের জন্য প্রয়োজনীয় যেসব উদ্যোগ ছিল, সেগুলো না হওয়ায় এত উদ্যোগের পরও দৃশ্যমান কোন সুশৃঙ্খল পরিবেশ আমরা লক্ষ্য করছি না। সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্য মোটরযান শ্রমিকদের পাশাপাশি মালিক পক্ষকেও অনেকে দায়ী করেন। ১৮ লাখ দক্ষ চালকের অভাব ॥ পরিবহন মালিক সমিতির নেতারাও মনে করে সড়ক দুর্ঘটনা না কমার পেছনে দক্ষ চালকের অভাব রয়েছে। শিক্ষিত বেকাররা এ পেশায় আসতে চান না। তারা এই পেশাকে এখনও সামাজিক মর্যাদার জায়গায় দেখতে পান না। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, রাজধানীতে আমরা চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করেছি। এরপরও কিছু মালিক নির্দেশ মানছে না। তা সত্য। তিনি বলেন, কাউন্টারে টিকেট বিক্রির ব্যবস্থা করে না দিলে মালিকরা ফের চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানোর দিকে ঝুঁকবে। চালকের লাইসেন্স না থাকা কিংবা অপ্রাপ্ত বয়স্ককে গাড়ি চালানোর বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি সমস্যা সমাধানের জন্য। আমাদের দেশে এখনও ১৬ থেকে ১৮ লাখ চালকের অভাব। সেক্ষেত্রে মালিকদের পক্ষে ভাল-খারাপ চালক বাছাই করাও কিন্তু সমস্যা। একমাত্র সমাধান হলো শিক্ষিত বেকারদের এ পেশায় যুক্ত করে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সড়ক নিরাপত্তা অনেকাংশে বাড়বে। ভারি যানে চালক সঙ্কট ॥ পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য ভারি যানবাহনের বিকল্প নেই। এ যান দীর্ঘ সময় রাস্তায় চলে। এ জন্য যানবাহনের তুলনায় চালকের সংখ্যা বেশি থাকা জরুরী। অথচ দেশের প্রায় ৩৮ শতাংশের বেশি ভারি যান চালকের নেই কোন লাইসেন্স। মোটরযান আইনে ভারি যানবাহনের মধ্যে পড়েÑ বাস, ট্রাক, কভার্ডভ্যান, বিশেষ যানবাহন (লরি, মিক্সচার মেশিনবাহী যান)। বিআরটিএর তথ্যে জানা যায়, দেশে ভারি যানবাহন আছে ২ লাখ ৫২ হাজারের বেশি। এসব যানবাহনের বিপরীতে বৈধ লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ১ লাখ ৫৫ হাজার। অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ যানবাহন চলছে ভুয়া চালক দিয়ে। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ ভারি যানবাহনের বেপরোয়া গতি। মোটরযান আইন অনুসারে, একজন চালক একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি ভারি যানবাহন চালাতে পারবেন না। আধঘণ্টার বিরতি দিয়ে পুনরায় চালাতে পারবেন। তবে দিনে ৮ ঘণ্টা অর্থাৎ চালককে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি ভারি যান চালাতে দেয়া যাবে না। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব যানবাহন মালিকের। চার কারণে দুর্ঘটনা ॥ পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএ বলছে, চার কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। চলতি বছরের ২৪ জুন উচ্চ আদালতে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে এই তথ্য বিআরটিএ পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণের মধ্যে রয়েছেÑ সড়কে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল, লাইসেন্সবিহীন ও অনভিজ্ঞ চালকের হাতে গাড়ি তুলে দেয়া। প্রতিবেদন দাখিলের পর সারাদেশের ফিটনেসবিহীন, আন-রেজিস্টার্ড ও লাইসেন্স ছাড়া গাড়ির সংখ্যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আদালত। বিআরটিএর পরিচালক ও মুখপাত্র মাহবুব-ই রাব্বানী হাজির হলে বিআরটিএর কার্যক্রম, সড়কে দুর্ঘটনা, ফিটনেস ও আন-রেজিস্টার্ড গাড়ি নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয় আদালতের পক্ষ থেকে। সাড়ে চার লাখের বেশি ফিটনেসবিহীন যান ॥ ’১৮ সালের সরকারী পরিসংখ্যানের পাতা ওল্টালে দেখা যায় ৫১৪ দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৭ হাজার ২২১, আহত ১৫ হাজার ৪৬৬। বিআরটিএ প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে ফিটনেসবিহীন বাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৩৬৯, শুধু রাজধানীতেই এই সংখ্যা ১লাখ ৬৮ হাজার ৩০৮। সড়ক ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ॥ সওজের অধীন মোট সড়ক আছে ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ৮ হাজার ৮৬০ কিলোমিটার। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব জরিপ বলছে, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের মধ্যে ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার সড়কে যথাযথ সাইন-সংকেত নেই। কোথাও কোথাও থাকলেও তা ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ ৬২ শতাংশ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে যথাযথ সাইন-সঙ্কেত নেই। সওজ সূত্র জানায়, বিভিন্ন মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলমান থাকায় সেগুলোতে সাইন-সঙ্কেত বসানোর বিষয়টি ধরা আছে। এরপরও যে ৬২ শতাংশ সড়কে সঠিক সাইন-সঙ্কেত নেই এবং দুর্ঘটনার মারাত্মক ঝুঁকি আছে, সেসব সড়ক উন্নয়নে ৬৩২ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে ‘জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে প্রয়োজনীয় সাইন ও রোড মার্কিং স্থাপন এবং চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানসহ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ করিডর উন্নয়ন’। ’১২ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে জরিপ চালানো হয়। সে জরিপে তিন শ’ কিমি সড়ক মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সড়কে ঝুঁকি কমাতে বাঁক সোজাকরণ, সড়ক প্রশস্ত করাসহ নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে ১৫৪ কিলোমিটার সড়ক এখনও মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এসব স্থানে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানায় হাইওয়ে পুলিশ ও বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। এর জন্য এআরআইকে করণীয় ঠিক করে দেয়ার জন্য দায়িত্ব দিয়েছে সওজ। বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ॥ এ বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ২৪ হাজার ৯৫৪। ’১৬ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এই হিসাবে দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬৮ জনের বেশি। যদিও বেসরকারী বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি দুর্ঘটনার সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলা হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ২৪ হাজার ৯৫৪। ’১৬ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। জানতে চাইলে নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, দুর্ঘটনায় হতাহতের সঠিক কোন পরিসংখ্যান আমাদের দেশে হয় না। সরকারী যেসব পরিসংখ্যান আমরা পাই তা বিশ^াসযোগ্য নয়। বেসরকারী পর্যায়ে একেক সংগঠন একেক রকমের তথ্য প্রকাশ করে। যা বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যের সঙ্গে মিলছে না। তাই সরকারী সড়ক দুর্ঘটনা সঠিক তথ্য নিরূপণ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা রোধে যেসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর ফল পাওয়া যাবে দুর্ঘটনা কমা-বাড়ার মধ্য দিয়ে। সারাদেশে গত চার বছরে ২১ হাজারের বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যুর কথা বলছে যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতি। দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু চাই না ॥ এবারে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে মাসব্যাপী কর্মসূচী হাতে নিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন (নিসচা)। প্রতিষ্ঠানের প্রধান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ২৬ বছর আগে আমার স্ত্রী মারা যায়। তখন বাংলাদেশের মানুষ ছিল সাড়ে ১০ কোটি। গাড়ি কম, রাস্তা কম। এই ২৬ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে। তখন বছরে মানুষ মারা যেত ১৫ হাজার। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এখন প্রতিবছর সাড়ে ৫ হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। জনসংখ্যা ও গাড়ির সংখ্যা বাড়ার পরও দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে, এটাও সত্যি। তবে আমাদের লক্ষ্য, একটি মানুষও যাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা না যায়। এজন্য দুর্ঘটনা রোধে সরকারী উদ্যোগ বাস্তবায়নে আরও আন্তরিক হতে হবে। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ॥ সরকারী তথ্য অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমতির দিকে ছিল। ’১৪’র পর থেকে এই সংখ্যা আবার বাড়তে থাকে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ’১০ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষে মৃত্যুহার ছিল ১৪ দশমিক ১, যা ’১৫ সালে কমে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৮। ’১৫’র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বৈশ্বিক হিসেব করলে, সবচেয়ে নিরাপদ সড়ক ইউরোপে। আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার কিছু অঞ্চলের সড়ক পরিস্থিতি খারাপ। অতিরিক্ত গতি ॥ ১৯৯৮ থেকে ’১৫ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) বলছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার পেছনে অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব দায়ী। সম্প্রতি মহাসড়কে ছোট যানবাহনের চলাচলও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। এজন্য ’১৫ সালে মহাসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেয় সরকার। একই বছর জাতীয় মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, হিউম্যান হলার, নছিমন, করিমন ও ভটভটি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। কিন্তু এসব কার্যকর হয়নি। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন মহাসড়কে পুলিশের স্পীডগান কিছুদিন আগে দেখা গেলেও এখন নেই। ফলে ইচ্ছেমতো আপন গতিতে চলছে সব ধরনের যানবাহন। চার বছরে ২১ হাজার দুর্ঘটনায় ২৯ হাজার মৃত্যু ॥ ২০১৫ সাল থেকে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বিগত ৪ বছরে ২১ হাজার ৩৮৬ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৯ হাজার ৩১৫জন নিহত ও আহত ৬৯ হাজার ৪২৮। তবে সংঘটিত দুর্ঘটনার সিংহভাগই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় না বলে মনে করে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে সংগঠনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এদিকে ‘জীবনের আগে জীবিকা নয়, সড়ক দুর্ঘটনা আর নয়’ প্রতিপাদ্য নিয়ে তৃতীয়বারের মতো দিবসটি সারাদেশে সরকারীভাবে পালন করা হবে। দিবসটি উদ্যাপনে নেয়া হয়েছে নানান কর্মসূচী। এরমধ্যে রয়েছে ক্রোড়পত্র প্রকাশ, আলোচনা সভা, র‌্যালি ও সড়ক সচেতনতা কার্যক্রম। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০১৯’ উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০১৯’ উদযাপনের উদ্যোগকে রাষ্ট্রপতি স্বাগত জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন এ আয়োজন নিরাপদ সড়ক ব্যবহারে জনগণের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে সহায়ক হবে। ট্রাফিক আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর ॥ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি ট্রাফিক আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা দেশের সড়কগুলোকে নিরাপদ হিসেবে গড়ে তুলে সড়ক দুর্ঘটনা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হব। শেখ হাসিনা বলেন, উন্নত যোগাযোগ অবকাঠামো ও পর্যাপ্ত পরিবহন সেবা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এ উপলব্ধি থেকে স্বাধীনতার পর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বিধ্বস্ত সড়ক ও ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থাকে স্বল্প সময়ের মধ্যে সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করে সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারী কর্মসূচী ॥ আজ ২২ অক্টোবর দেশব্যাপী পালিত হবে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। দিবসের শুরুতে সকাল সাড়ে সাতটায় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের হবে। সকাল দশটায় ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে হবে আলোচনা সভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন।
×